চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2023-12-25 19:49:49

 

 


৫০তম পর্বে যা থাকছে:

 

* চাঁদে গবেষণার জন্য ঘর নির্মাণ

* অস্ত্রোপচার করবে রোবট

* সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পোশাক তৈরি করেছে চীনা বিজ্ঞানীরা

 

চাঁদে গবেষণার জন্য ঘর নির্মাণ

চাঁদ নিয়ে নান্দনিক চর্চার পাশাপাশি বিস্তর গবেষণাও করেছে মানুষ। এসব গবেষণায় নানা কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে। তৈরি হয়েছে কত তত্ত্ব। পরে তা খারিজও হয়ে গেছে। তবে শেষ হয়ে যায়নি চাঁদ নিয়ে মানুষের অনুসন্ধানের আগ্রহ। এবার আরও অধিক গবেষণার লক্ষ্যে চাঁদে স্থায়ী গবেষণাকেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন।

 

চাঁদে স্থায়ী গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে থ্রিডি-প্রিন্টেড ইট দিয়ে ডিমের আকৃতির ঘর তৈরির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। মূলত চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি উষ্ণ, স্থিতিশীল জীবনযাপন এবং সঠিক কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে এমন ঘরের ডিজাইন করছেন তারা। সম্প্রতি শীর্ষ একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন জানিয়েছে, চাঁদে এ গবেষণাকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে অনুসন্ধানের জন্য ছ্যাং’ই-৬, ছ্যাং’ই-৭ এবং ছ্যাং’ই-৮ মিশনের পরিচালনা করা হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে নমুনা সংগ্রহের জন্য ছ্যাং’ই-৬ মিশন পরিচালনা করা হবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর পরিবেশ এবং সম্পদের বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য ২০২৬ সালে ছ্যাং’ই-৭ মিশন চালানো হবে। এ ছাড়া চাঁদের সম্পদ ব্যবহারের উপর পরীক্ষা চালানো এবং আন্তর্জাতিক চন্দ্র গবেষণাকেন্দ্রের একটি মৌলিক মডেল তৈরি করতে ২০২৮ সালে ছ্যাং’ই-৮ মিশন পরিচালনা করা হবে।

মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের ন্যাশনাল সেন্টার অব টেকনোলজি ইনোভেশন স্টেশনটির একটি নকশা তৈরি করেছে। ডিম আকৃতির এই ঘরগুলোকে ‘ইয়ুহুচুন’ বা মুন পট ভেসেল নাম দেওয়া হয়েছে। এ ঘরগুলো দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দ্বিতল এ অবকাঠামোটির লোড-বেয়ারিং বিম বা কলাম নেই। তবে শীর্ষে একটি গম্বুজ রয়েছে। ঘরের বহিরাবরণটি দুটি স্তরে বিভক্ত।

ন্যাশনাল সেন্টার অব টেকনোলজি ইনোভেশন কেন্দ্রের অধ্যাপক চৌ ছেং জানান, চাঁদের বিরূপ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ ধরনের কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

চন্দ্রপৃষ্ঠে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এর বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদের কম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, যা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এছাড়াও আছে বায়ুমণ্ডলীয় সুরক্ষাবিহীন ভ্যাকুয়াম পরিবেশ, চাঁদের কম্পন এবং তাপমাত্রার নাটকীয় পরিবর্তন। দিনের বেলা তাপমাত্রা ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে রাতের বেলা মাইনাস ১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। ফলে এরকম এক পরিবেশে গবেষণা কার্যক্রম চালাতে সেখানকার তাপমাত্রা-উপযোগী অবকাঠামোর কোনও বিকল্প নেই।

চৌ ছেং বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হলো কাঠামোর মধ্যে অন্যান্য উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে আনা যাতে এর ওজন কমানো যায় এবং একই সঙ্গে এর শক্তি বৃদ্ধি করা যায়।”

গবেষক দলের মতে, ঘরের উপরিভাগের কাঠামো আরও ভাল স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম এবং ভেতরের অংশ তাপনিরোধক হওয়ায় মহাকাশচারীরা উষ্ণ ও উপযোগী কাজের পরিবেশ পাবেন।

থ্রিডি-প্রিন্টেড এই ঘরগুলো ইট ব্যবহার করে তৈরি করা হবে। এই ইটগুলো চাঁদের মাটি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী দলটি।

চীনের চন্দ্র অনুসন্ধান কর্মসূচির প্রধান ডিজাইনারের মতে, আন্তর্জাতিক চন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রের মৌলিক মডেলটির প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০৪০ সালের মধ্যে গবেষণাকেন্দ্রের মৌলিক মডেলটি আরও বিকশিত করা হবে। এরপর বিজ্ঞানীরা সূর্য-পৃথিবী-চাঁদসহ মহাকাশের পরিবেশের উপর গবেষণা চালাতে সক্ষম হবেন। তৃতীয় পর্যায়ে গবেষণাকেন্দ্রটিকে ধীরে ধীরে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা-ভিত্তিক পরীক্ষামূলক স্টেশন থেকে একটি অ্যাপ্লিকেশন-ভিত্তিক এবং বহুবিধ কাজের উপযোগী একটি স্টেশনে পরিণত হবে।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

অস্ত্রোপচার করবে রোবট

ধরুন আপনি অপারেশনের জন্য অস্ত্রোপচার কক্ষের টেবিলে শুয়ে আছেন এবং সেখানে ডাক্তার উপস্থিত নেই। হঠাৎ একটি যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপারেশন শুরু করলো এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সফলভাবে সেটা শেষ করলো। চিন্তাটি খানিকটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও এখন এটি বাস্তব। প্রযুক্তির এই যুগে এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলাদা জায়গা করে নিচ্ছে রোবটিক্স। একসময় কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জটিল রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে নিরাময়েও ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের একটি হাসপাতালে আংশিক কিডনি অপসারণের অস্ত্রোপচার করেছে একটি রোবট।

দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রথমবারের মতো অস্ত্রোপচার রোবট তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। রোবটটির নাম দ্য ভিঞ্চি শি। সম্প্রতি চীনের কানসু প্রদেশের লানচৌয়ের সুন ইয়াত-সেন ইউনিভার্সিটি ক্যান্সার সেন্টারে এ রোবটটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই রোবটটি ছোট ধরনের অস্ত্রোপচারগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।

এই সার্জিক্যাল রোবটের সহায়তায় লিউ চুওয়েই এবং তার দল সফলভাবে আংশিক কিডনি অপসারণের অস্ত্রোপচারও করেছেন।

লিউ জানান, রোবট দিয়ে অস্ত্রোপচারের কাজ করা অনেক সুবিধাজনক। গতানুগতিক পদ্ধতির অস্ত্রোপচারের তুলনায় নতুন উদ্ভাবিত এ অস্ত্রোপচার রোবট দিয়ে যতোটা সম্ভব কম ছিদ্র করেই অস্ত্রোপচার করা যায়। এতে অস্ত্রোপচারে যেমন কম সময় লাগে, তেমনিভাবে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে। ফলে রোগীকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় না।

পাশাপাশি দ্য ভিঞ্চি শি অস্ত্রোপচার রোবটটি অপারেশন ট্রমা কমায় এবং এটি দিয়ে অস্ত্রোপচার করলে রোগীর শরীরে অস্ত্রোপচারের দাগও কম হয়। যেটুকু দাগ পড়ে তা একেবারেই দৃশ্যমান থাকে না।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোবটিক্স প্রয়োগের শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল জটিল ও সূক্ষ্ম অপারেশনগুলোকে রোবটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা। এই অপারেশনগুলোতে সুনিপুণ এবং স্থির হাতের প্রয়োজন হয়। হাতের একটু কাঁপাকাঁপি বা একটি ভুল রোগীর জীবন বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বিশেষ করে, হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি ছোট ভুলও অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। চীন এধরনের চিকিৎসায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।

এর আগে ১৯৯০ এর দিকে বিজ্ঞানীরা হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আবিষ্কার করেন একাধিক রোবট। তবে, ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত এগুলো পরীক্ষাধীন পর্যায়েই ছিল। ২০০০ সালের পর চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে রোবট ব্যবহার শুরু হয়।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পোশাক তৈরি করেছে চীনা বিজ্ঞানীরা

শীতকাল মানেই এক অন্যরকম অনুভূতি। শীত হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। তাইতো শীতকাল অনেকেরই পছন্দ। আবার একইভাবে একদল মানুষ গ্রীষ্মকাল পছন্দ করেন। তবে শীত কিংবা গ্রীষ্মকাল প্রকৃতিতে যেই ঋতুই বিরাজ করুক না কেন যদি ঠাণ্ডা বা গরম সহনীয় মাত্রার থেকে ছাড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। আর এ সমস্যার সমাধান করেছেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। তারা মানুষের জন্য এমন একটি পোশাক তৈরি করেছেন, যা মানুষের দেহকে প্রকৃতির যে কোনও বিরূপ আবহাওয়া, বিশেষ করে তাপমাত্রাজনিত যে কোনও অবস্থা, থেকে রক্ষা করবে।

প্রকৃতির চরম অবস্থা থেকে মানবদেহকে রক্ষা করতে সৌর-বিদ্যুৎ চালিত একটি নমনীয়, টেকসই পোশাক তৈরি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এ পোশাকটির বিশেষত্ব হলো বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা যেমন হোক এটি মানবদেহকে আরামদায়ক তাপমাত্রা সীমার মধ্যে রাখতে সক্ষম।

সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।

পোশাকটি নমনীয় সৌর সেল যুক্ত। এতে সূর্যালোক ছাড়া অন্য কোনও বাহ্যিক শক্তির প্রয়োজন পড়ে না।

এর আগে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত থার্মো-নিয়ন্ত্রিত পোশাকের তুলনায় চীনের নানখাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি নতুন এ পোশাকটি মানবদেহে উষ্ণতা বৃদ্ধি কিংবা দেহকে শীতল করতে সক্ষম। এর ফলে পোশাকটি সারাদিনের দুই ধরনের তাপমাত্রা সমন্বয় করতে পারে।

গবেষণার তথ্যানুসারে, অত্যন্ত দক্ষ এ ডিভাইসটি মাত্র ১২ ঘন্টা সূর্যালোক থেকে শক্তি গ্রহণ করে ২৪ ঘন্টা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা কাজ করতে পারে।

সর্বনিম্ন ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি মানুষের ত্বককে ৩২ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে রাখতে সক্ষম, যেটি মানবদেহের জন্য আরামদায়ক।

গবেষকরা বলছেন, নতুন এ ডিভাইসটি পরিবেশগত তাপমাত্রার ওঠানামার মধ্যেও মানবদেহকে নিরাপত্তা ও প্রশান্তি দিতে পারবে। এমনকি এ পোশাক বা ডিভাইসটি মহাকাশ বা অন্যান্য গ্রহের মতো চরম পরিবেশেও মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে।

এ পোশাকের মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণা, বিশেষ করে মহাকাশের যেখানে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে মানুষ এতোদিন যেতে পারেনি ওই সব স্থানে পৌছার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী