কোভিড ১৯-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পথে চ্যালেঞ্জ হয়ে আসা কিছু বাধা অতিক্রম করে, চীনা অর্থনীতি আবারও দুর্দান্ত সম্ভাবনা দেখিয়েছে। চলতি বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে চীনের অর্থনীতি গতি ফিরে পেয়েছে এবং প্রত্যাশার চেয়ে বেশি- ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে একাধিক অনিশ্চয়তার পটভূমিতে, অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি চীনের ২০২৩ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসকে উন্নীত করেছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক ২০২৪ সালের জন্য আরও বেশি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন।
এ ইতিবাচক লক্ষণগুলো এসেছে প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল করতে এবং উন্মুক্তকরণের এগিয়ে নিতে চীনা সরকারের নেওয়া বেশ কিছু শক্তিশালী এবং বাস্তবসম্মত নীতি এবং পদক্ষেপের ফলস্বরূপ। এটি কেবল বিশ্বের আত্মবিশ্বাসই বাড়ায়নি বরং ‘চীনের পতন’ বিষয়ে দূরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচারকেও ভুল প্রমাণিত করেছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে, বৈশ্বিক অর্থনীতি ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট, মার্কিন রাজস্ব ও আর্থিক নীতির টালমাটাল অবস্থার প্রভাব এবং কিছু পশ্চিমা দেশের সরবরাহ চেইনের তথাকথিত "ডি-রিস্কিং" এর প্রভাব মোকাবিলা করেছে।
চীনা অর্থনীতিও ক্রমাগত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির চাপ, অবনতিশীল বাণিজ্য পরিবেশ, এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মন্থর চাহিদার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে, চীন স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, সামষ্টিক-নিয়ন্ত্রণ নীতির একটি ব্যাপক প্যাকেজ তৈরি করেছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্ভাবনা ২০২৩ শীর্ষক মধ্যবার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগ এই বছরের চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বছরের শুরুতে ৪.৮ থেকে ৫.৩ শতাংশে উন্নীত করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা আশা করে যে ২০২৩ সালে চীনের অর্থনীতি ৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যা পূর্বের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ সংখ্যা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫.২ শতাংশ করেছে। মরগান স্ট্যানলি তার পূর্বাভাস ৪.৮-৯ শতাংশ থেকে ৫.১ শতাংশে উন্নীত করেছে। সিটিগ্রুপ তার পূর্বাভাস ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫.৩ শতাংশ করেছে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির জোরালো এ ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য দেখা গেছে, চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এ বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বছরে ৫.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির মধ্যে সর্বোচ্চ। জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, চীনে ৪১ হাজার ৯৪৭টি নতুন বিদেশী-বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩২.১ শতাংশ বেশি। কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের চীনে প্রকৃত বিনিয়োগ যথাক্রমে ১১০.৩ শতাংশ, ৯৪.৬ শতাংশ, ৯০.০ শতাংশ, ৬৬.১ শতাংশ এবং ৩৩.০ শতাংশ বেড়েছে।
ব্রাজিলের সাও পাওলো স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক মার্কোস পাইরেস বলেন, চীনের অর্থনীতি ক্রমশই বাড়ছে শুধু তাই নয়, এর গুণগত মানও উন্নত হচ্ছে। চীনের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সেক্টর, নতুন শক্তি উৎপাদন সরঞ্জাম, ব্যাটারি এবং বৈদ্যুতিক যান শিল্পের দ্রুত বিকাশের দ্বারা চালিত। মাত্র কয়েক বছরে চীন এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছে।
‘বছরের শুরু থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা বলে আসছেন যে, চীনের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে চলেছে, চীনের অর্থনীতি একটি ‘টাইম বোমা’ এবং চীনের শহরগুলো ভূতের শহরে পরিণত হয়েছে’। অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিবিদ কুও শেংসিয়াংয়ের ভাষ্য মতে- এ সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য এবং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে তাদের সাধারণ জ্ঞানেরও কমতি রয়েছে।
আগামী ৩০ বছরে, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক যানবাহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আরও অনেক ক্ষেত্রে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের পরিচালক জেফ্রি শ্যাস।
বিশ্বব্যাপী আরও বেশি সংখ্যক ব্যবসায়ীরা এখন চীনের অটল সংকল্প এবং সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। চীনে বিনিয়োগকে তারা ভবিষ্যতের জন্য ভালো বিনিয়োগ বলেও মনে করেন।
প্রকৃতপক্ষে, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা, এর বিশাল বাজারের শক্তি, একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প ব্যবস্থার সরবরাহ সুবিধা এবং বিপুল সংখ্যক উচ্চ-মানের শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের প্রতিভা সুবিধাগুলো চীনের অর্থনীতির ভিত্তি।
ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অর্থনীতির অধ্যাপক খাইরি তুর্ক বলেন, "চীন এখন অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অপরিহার্য দেশ।"
যদিও সামনের পথে বিভিন্ন বাধা এবং অসুবিধা থাকবে, তবে চীন সঠিক উন্নয়নের পথ এবং দিকনির্দেশনা বেছে নিয়েছে এবং একটি উচ্চ-স্তরের উন্মুক্তকরণের প্রচার চীনকে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল দেশগুলোর প্রধান একটি দেশে পরিণত করবে।
মাহমুদ হাশিম
চীন আন্তর্জাতিক বেতার, ঢাকা স্টেশন।