বিজ্ঞানবিশ্ব ৪৯তম পর্ব
2023-12-17 21:16:11

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৪৯তম পর্বে যা থাকছে: 


* ইঁদুর তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* মহাকাশে চীনের মানব মিশনের ২০ বছর

*  মানুষের জীবনে নতুন সম্ভাবনা


ইঁদুর তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

বন্দী সিংহকে শিকারীদের জাল কেটে উদ্ধার করেছিল এক ছোট্ট ইঁদুর। গ্রিক গদ্যকার ঈশপের সেই বিখ্যাত গল্পকে এতোদিন কাল্পনিক মনে হলেও এবার তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। তবে এবার সিংহের জায়গায় মানুষকে সাহায্য করবে এক রোবট ইঁদুর। যেকোনো দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে সাহায্য করতে পারে এমন একটি রোবট ইঁদুর তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা।


চীন ও জার্মানির একদল গবেষক যৌথভাবে একটি রোবোটিক ইঁদুর তৈরি করেছেন। এ রোবটটির বিশেষত্ব হলো জীবন্ত ইঁদুরের মতো এর মেরুদণ্ড নমনীয়, ফলে এটি সব দিকে সহজেই নড়াচড়া ও চলাচল করতে সক্ষম। বর্তমানে পাওয়া অন্যান্য চার পায়ের রোবটের তুলনায় এ রোবটটি অনেক বেশি কার্যকর। মূলত এই বিজ্ঞানীরা একটি রোবটিক মেরুদণ্ড তৈরি করেছেন, যা থেকে এই চতুষ্পদ রোবট ইঁদুর তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের রোবটগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ কাজে লাগাতে পারবে, বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে।

সম্প্রতি সায়েন্স রোবোটিক্স জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

এই ছোট আকারের রোবটটি সরু টানেল বা রুক্ষ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যেতে সক্ষম এবং এমনকি লাথি মারার পরেও সে নিজেকে ঠিকঠাক তুলে নিতে পারে।

গবেষকরা ৪০ সেন্টিমিটার-দৈর্ঘ্যের এই রোবট ইঁদুরের নাম দিয়েছেন নিরমো। ইঁদুরটিকে একটি বাস্তব ইঁদুরের শারীরিক গঠনে তৈরি করা হয়েছে এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একেবারে আসল ইুদুরের মতো । এটি চটপটে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে চলাচল করতে ও ঘুরতে সক্ষম।

 


মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং সুন ইয়াত-সেন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা কৃত্রিম এই নিউরোরোবোটটি তৈরি করেছেন।

গবেষকরা ইঁদুরটির সামনের অনমনীয় অংশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র যাত্রাংশ রেখেছেন এবং এর পেছনের দিকে একটি মেরুদণ্ড রয়েছে, যা চারটি কটিদেশীয় এবং পার্শ্বীয় জয়েন্টে সজ্জিত। হাঁটু ও কনুইয়ের জয়েন্টে কৃত্রিম শিরা রোবটটিকে ইঁদুরের মতো নড়াচড়া ও চলাচল করতে সক্ষম করে তুলেছে। 

২২৫ গ্রাম ওজনের এ রোবটটি ১৩ ধরনের নড়াচড়া করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে কাঁধ বাঁকানো, হাঁটু বাঁকানো, কনুই, পার্শ্ব কিংবা ধনুকের মতো মেরুদণ্ড বাঁকানো, অনুভূমিক ঘূর্ণন এমনকি লেজ নড়াচড়াও করতে পারে।

গবেষণা নিবন্ধের লেখক বিং চেনশান জানান, নমনীয় এই মেরুদণ্ড রোবট ইঁদুরটিকে স্থির থাকতে, দ্রুত চলতে কিংবা বিভিন্ন দিকে ঘুরতে সহায়তা করে। এটি ইঁদুরটির কর্মক্ষমতাকে আরও বিকশিত করেছে। গবেষণাটি মূলত মেরুদণ্ড-ভিত্তিক চতুষ্পদ রোবটের বিকাশ ও ডিজাইনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

 

এর আগে রোবট ইঁদুর তৈরি করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন চীনের বেইজিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা। সে রোবটটি বানানো হয়েছিল অনুসন্ধান ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ধার অভিযানে ব্যবহারের জন্য। ব্যাটারিচালিত এই ইঁদুরের নাম দেওয়া হয়েছে স্মল-সাইজ কোয়াড্রাপড রোবটিক র‌্যাট বা স্কুরো। এটি সমতল ও অসমতল যে কোনো পথেই চলতে কিংবা যে কোনো গুহা বা গর্তের ভেতর ঢুকে যেতে পারে। এর আগে জাপান একটি রোবট তেলাপোকা তৈরি করেছিল, যা দুর্যোগের পরে মানুষকে উদ্ধার করতে সহায়তা করে।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান


মহাকাশে চীনের মানব মিশনের ২০ বছর

 

প্রাচীনকাল থেকেই মহাকাশ সম্বন্ধে মানবজাতির জানার আগ্রহ অনেক। আর এ আগ্রহের কারণেই সম্ভব হয়েছে মানববাহী মহাকাশ মিশনের, যার মাধ্যমে মানবজাতি মহাকাশ সম্বন্ধে জানতে পারছে। এই সুন্দর মহাকাশে এত অজানা বিষয় আছে, যা সবাইকে অবাক করে। অনেক দেশ মানববাহী মহাকাশ অনুসন্ধানের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে, সত্যিকার অর্থে সারা বিশ্বে শুধু তিনটি দেশ তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছে। আর চীন এগুলোর অন্যতম। চলতি বছর মহাকাশে মানব মিশনের ২০তম বার্ষিকী পালন করছে চীন। ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় দেশটির মহাকাশ প্রকল্প। এতে তিন ধাপের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারিত হয়, যার সবগুলো ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে দেশটি।

বর্তমানে বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে জটিল ও কঠিন প্রকল্পগুলোর একটি হলো মানববাহী মহাকাশ প্রকল্প। এই খাতের শক্তি একটি দেশের বিজ্ঞান ও অর্থনীতি খাতের শক্তির প্রতিচ্ছবি। ২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর প্রথম মানববাহী নভোযান শেনচৌ-৫-এর মাধ্যমে চীনা নভোচারী ইয়াং লি ওয়েই সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে পৌঁছান। এর সঙ্গে সঙ্গে মানববাহী মহাকাশ প্রকল্পে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের শক্তিমত্তা আর সক্ষমতার জানান দেয় দেশটি। এর মাধ্যমে বিশ্বে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে তৃতীয় দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় চীন।

শেনচৌ-৫-এর চীনা নভোচারী ইয়াং লি ওয়েই মোট ২১ ঘণ্টা ২৩ মিনিটে নির্ধারিত কক্ষপথে ১৪ বার ঘোরার পর নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এরপর একে একে কেটে গেছে ২০টি বছর। দীর্ঘ এই সময়ে সব মিলিয়ে মোট ১২টি মানব মিশনে ২০ জন চীনা মহাকাশচারী পৃথিবীর কক্ষপথে গেছেন।

ইয়াং লি ওয়েই বর্তমানে দেশটির মানববাহী মহাকাশ কর্মসূচির দায়িত্বে নিয়োজিত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। গত দুই দশকে চীনের মহাকাশ মিশনের অর্জনের জন্য অত্যন্ত গর্বিত তিনি।

 


তিনি বলেন, “আমাদের মানববাহী মহাকাশ কর্মসূচি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা অনেক নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং আমরা যা পরিকল্পনা করেছি প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়েছে। একজন মহাকাশচারী হিসেবে, আমি এই অর্জনগুলো দেখে খুবই আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করছি।”

এদিকে কয়েক দশকের প্রচেষ্টার পর চীন গত বছরের শেষের দিকে থিয়ানকং মহাকাশ স্টেশনটি সম্পূর্ণ করেছে।

পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে এটি অবস্থিত। বর্তমানে এর ওজন প্রায় ১০০ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে একটি প্রধান মডিউল ও দুটি ক্যাপসুল রয়েছে। এটি বেশ কয়েকটি পরিদর্শনকারী স্পেসশিপের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছে। চীনের এই মহাকাশ স্টেশনটি জাতীয় মহাকাশ-ভিত্তিক গবেষণাগার হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য কাজ করবে। চীনের মহাকাশ স্টেশন হলো ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের জন্য উন্মুক্ত প্রকল্প। বর্তমানে ১৭টি দেশ, ২৩টি সংগঠন, ৯টি প্রকল্প চীনা মহাকাশ স্টেশনের প্রথম দফা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ ছাড়া চীনা গবেষকরা একটি নতুন প্রজন্মের মানববাহী মহাকাশযান, একটি চন্দ্র অবতরণ মডিউল এবং একটি চন্দ্র রোভার ডিজাইন করছেন, যা ২০৩০ সালে চাঁদে দেশটির প্রথম সম্ভাব্য মানব মিশনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান


মানুষের জীবনে নতুন সম্ভাবনা


রোবট প্রযুক্তিতে বিশ্বজুড়েই খ্যাতি অর্জন করেছে উন্নয়নে অগ্রগামী দেশ চীন। দেশটির শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘রোবট প্লাস’ অ্যাপ্লিকেশন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে চলতি বছর রোবট-শিল্প ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, যা দেশটির মানুষের জীবনের সর্বত্রই রোবটের উপস্থিতি আরও নিশ্চিত করেছে। মানুষের মতো বা হিউম্যানয়েড রোবট এখন দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হরহামেশাই চোখে পড়ছে। বিভিন্ন শিল্প কারখানায়, হাটে-বাজারে এমনকি গৃহস্থালি কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রোবট।

শুধুমাত্র হিউম্যানয়েড রোবটই নয় এ সংযোজন লাইনে আরও বিভিন্ন ধরনের রোবট রয়েছে। এর মধ্যে রোবটিক আর্ম, অস্ত্রোপচারে সহায়তাকারী সার্জারি রোবট, উদ্ধার অভিযান এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করার জন্যও রয়েছে রোবট।

 

এ শিল্পে চীনের সর্বশেষ সংযোজন ‘জিআর-১ হিউম্যানয়েড রোবট। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শাংহাইয়ের একটি ল্যাবরেটরি এটি তৈরি করেছে। নতুন উদ্ভাবিত এ রোবটটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানানোসহ মানুষের অনেক আচরণ অনুকরণ করতে সক্ষম।

একটি রোবট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কু চিয়ে জানান, হিউম্যানয়েড এ রোবটটি মানব পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম। এটি মানুষের সাধারণ কিছু কার্যকলাপ সম্পাদন করতে পারে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি হলো কোনো ধরনের যান্ত্রিক পরিবর্তন ছাড়াই শুধুমাত্র সফ্টওয়্যারে একটি নতুন ফিচার যুক্ত করলেই এই রোবটটি সেই কাজটি সম্পাদনে সক্ষম হয়ে ওঠে। বর্তমানে খুবই ছোট পরিসরে এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

রোগীদের পুনর্বাসন ও বিনোদনের জন্য এই রোবটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে রোগীদের কব্জি বা গোড়ালির নড়াচড়ার মতো অনুশীলন করতে সহায়তা করবে এই স্মার্ট রোবট। এ ছাড়া বিভিন্ন কমিউনিটি হাসপাতালে এটি রোগীদের ব্যায়ামে সহায়তা করবে।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান


নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। 



প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার


অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল


স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান


সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী