‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বৈশ্বিক মানবাধিকারে চীনা বুদ্ধি ও শক্তি যোগাচ্ছে
2023-12-13 18:27:49

বেল্ট অ্যান্ড রোড’ একটি শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্মুক্ততা, নবায়ন ও সভ্যতার পথ এবং মানবজাতির অভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়নের একটি পথ।

চীনা মানবাধিকার উন্নয়ন তহবিল ও সিনহুয়া বার্তা সংস্থার জাতীয় হাই-এন্ড থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সম্প্রতি যৌথভাবে প্রকাশ করে ‘আরও ভাল বিশ্বের জন্য - মানবাধিকারের দিক থেকে ১০ বছরের‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ দেখা’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়,  গেল ১০ বছরে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ একটি প্রত্যাশা থেকে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। নানা দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবিকার মান উন্নয়নে অবদান রেখেছে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, উন্নয়নের অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং বিশ্ব মানবাধিকার উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করেছে।

বেঁচে থাকার অধিকার হলো সব মানবাধিকার উপভোগের ভিত্তি। মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পোশাক যোগানো, চাকরি ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এখনও অনেক দেশের জন্য জরুরি একটি কাজ। প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল ১০ বছরে, ধারাবাহিক  ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ প্রকল্পের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মানুষের জীবিকা ও চিকিত্সার মান উন্নত হয়েছে। কর্মসংস্থান ও আয় বেড়েছে, যাতে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী রয়েছে অসংখ্যা এমন প্রাণবন্ত উদাহরণ।

 

বুরুন্ডির জিহাঙ্গা জেলায় কৃষক শায়ার নেগেনদাকুমানা ধান ক্ষেতের বাম্পার ফলন দেখে ভীষণ আনন্দিত। ২০১৮ সাল থেকে চীনের কৃষি বিশেষজ্ঞের তার গ্রামকে ধান চাষের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বেছে নেন এবং স্থানীয় কৃষকরা চীনা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে হাইব্রিড ধান চাষের কৌশল শেখেন। তারা দ্রুত ক্ষুধা-সমস্যা সমাধান করেন এবং প্রচুর খাদ্য চাষ করে, নতুন বাড়িঘরও নির্মাণ করেন।

সেনেগালের তেনে ফুলার গ্রাম শহরের থেকে দূরে গরম ও জনশূন্য একটি জায়গা। আগে গ্রামে পানি সরবরাহের সরঞ্জাম পুরাতন হয়ে গেলে পানি সংগ্রহে গ্রামবাসিদের দেড় কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রাম যেতে হতো। পানি নিতে লাইন থাকতে হতো ভোর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত। এ কারণে গ্রামের শিশুরাও স্কুলে যেত না। কয়েক বছর আগে চীনের অর্থায়নে সেনেগালে চালু হয় একটি গ্রাম কূপ খননের প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় তেনে ফুলার গ্রামের প্রথম কূপ বসে। গ্রামবাসীরা এখন প্রতিদিন পরিস্কার পানি পান করতে পারে এবং এ প্রকল্পের সাহায্যে সেনেগালের ৭ ভাগের এক ভাগের মানুষের খাবার পানির সমস্যার সমাধান হয়েছে।

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় চীনের সহায়তায় আফ্রিকান ইউনিয়নের আফ্রিকান রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সদরদপ্তরের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ কাজ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়। এটি আফ্রিকায় প্রথম আধুনিক অফিস ও পরীক্ষাগার এবং সম্পূর্ণ সরঞ্জামসমৃদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াকজিরা তোতোফা বলেন, কেন্দ্র নির্মাণ শেষ হবার খবর শুনে সবাই খুশি ও উত্তেজিত। আমাদের চিকিত্সা সেবার  মান উন্নত হবে। আমার পরিবারের সদস্য ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন তাই আমি ছোটবেলা থেকে রোগ ভয় পাই।

দশ বছরে, অবকাঠামোর উন্নয়ন থেকে জীবিকা উন্নয়নের প্রকল্প পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও চিকিত্সা সহায়তা দেয়া পর্যন্ত, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রস্তাব এক একটি প্রকল্প ও ফলাফলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগেোর মানুষের জীবন ও জীবিকার মান উন্নীত করে।

সেনেগালের চীনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আমাদৌ ডিওপ মনে করেন, আফ্রিকা এমনকি বিশ্বের অনেক জায়গার জীবিকার মান, স্বাস্থ্যের মান ও সংস্কৃতি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রস্তাবের কারণে উন্নত হয়েছে। এটিও ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণের মাধ্যমে মানবাধিকার উন্নয়নের অনুশীলন।

অন্যদিকে উন্নয়নের অধিকার হলো মানবাধিকারের সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ উন্নয়নের মাধ্যমে সংঘাত নির্মূল করতে চায়। উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় এবং উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের সুন্দর জীবনের চাহিদা পূরণ করা যায়।

থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্পাদন ও জীবনযাপনের অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যায়, স্থানীয় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে এবং ব্যাপকভাবে সহযোগিতা যোগায়, যাতে মানুষের জীবিকার মান উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশসহ নানা ক্ষেত্রের অধিকার নিশ্চিত করে।

কেনিয়ায় এমন একটি গান আছে - ‘মোম্বাসা–নাইরোবি আমার বাড়িতে চালু হয়েছে রেলপথ’। গানে চীন ও কেনিয়ার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত মোম্বাসা–নাইরোবি রেলপথের কথা উল্লেখ করা হয়। এর আগে দুটি জায়গার মধ্যে যাতায়াত করতে বাসে ১০ ঘন্টার সময় লাগত আর এখন ট্রেনে করে মাত্র ৪ ঘন্টা লাগে। চালু হবার পর গেল ৬ বছরে, এ রেলপথ পরিবহনের গতি দ্রুততর করেছে এবং রেলপথের পাশে শহরের অর্থনীতিও দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে।

কাজাখস্তানের আস্তানা ছিল ঠাণ্ডার নগর, বাতাসের নগর। প্রতি শীতকালে এখানে প্রচুর ঠাণ্ডা পড়তো। জমি লবণাক্ত হওয়ার কারণে প্রতিরোধক বন সৃষ্টি করা কঠিন একটি কাজ ছিল। চীনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সিনচিয়াং প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক গবেষণালয় ও কাজাখাস্তানের ট্যানসেফুলিন কৃষি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারা এমন গাছের চারা কাজাখাস্তানে আনা হয় এবং স্থানীয় জমির মান উন্নয়ন করতে দু দেশের বিশেষজ্ঞরাও সহযোগিতা করেন। দু পক্ষের প্রচেষ্টায় কাজাখাস্তানের রাজধানীকে কেন্দ্র করে একটি প্রতিরক্ষামূলক বন তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানুষের জীবনযাপনের উপর বাতাসের প্রভাব কমে।

পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী মোরসবি বন্দরে, উপকণ্ঠের গুল্মে চীনের সাহায্যে নির্মিত একটি স্কুল আছে। স্কুলে রয়েছে টেনিস মাঠ, বাস্কেটবল মাঠ, স্পোর্টস হল ও রাগবি মাঠ। আগে দীর্ঘসময়ে অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এ স্কুলের কিছু ক্লাসরুম ভেঙে যায় এবং টেবিল ও চেয়ারও যথেষ্ট ছিল না। অনেক শিক্ষার্থী মাঠে বসে ক্লাস করতো। পুর্নির্মাণের পর এখন স্কুলে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠদান শুরু হয়েছে। মোট ৫০টি ক্লাসের ৩ হাজার জন শিক্ষার্থী এখানে লেখাপড়া করে।

আঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদার, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, গণসংস্কৃতি নির্মাণ, শিশু ও নারীদের অধিকার জোরদার…. বিশ্বব্যাপী আরও বেশি শহর ও অঞ্চলে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রস্তাবের কারণে নতুন রূপ দেখা যায়।

নাইজেরিয়ার চীনা গবেষণালয়ের পরিচালক চার্লস ওনুনাইজু বলেন, চীনারা বলে, ধনী হতে চাইলে প্রথমে রাস্তা নির্মাণ করতে হয়। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ বিভিন্ন দেশ, জাতি এমনকি গোত্রের মধ্যে যোগাযোগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে শক্তিশালী করছে, যা সংঘাত নিমূল ও যৌথ উন্নয়নের জন্য সহায়ক।

কম্বোডিয়া-চীন সমপর্ক উন্নয়ন সমিতির প্রধান সেমোনিল মনে করেন, চীন উন্নয়নের রহস্য খুঁজে পেয়েছে এবং তা বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ প্রস্তাব নানা দেশের জন্য সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয় মানুষের জীবনও এর কারণে অনেক উন্নত হয়েছে।

প্রত্যেকে সম্পূর্ণভাবে মানবাধিকার উপভোগ করবে - এটা মানবসমাজের মহান একটি স্বপ্ন। মানবাধিকার উন্নয়ন ও রক্ষা মানবজাতির অভিন্ন কাজ এবং এর জন্য সবার প্রচেষ্টার দরকার।

বর্তমানে ক্ষুধা, দারিদ্র, যুদ্ধ, পরিবেশ দূষণসহ অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি। উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতা, সমন্বয়হীনতা, টেকসইহীনতা এমন নানা সমস্যাও রয়েছে। মানবাধিকার উন্নয়ন ও প্রশাসন কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখে। থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’যৌথ নির্মাণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

মানুষের সুখী জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। পাকিস্তান ইসলামবাদ শান্তি ও কূটনৈতিক গবেষণালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ আসিফ নূর বলেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দারিদ্রবিমোচন, মানুষের জীবিকার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষায় আর্থিক সমর্থন দেওয়াসহ নানা  ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’যৌথ নির্মাণ।

বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং সহযোগিতা উন্নয়নের বাধা দূর করার সবচেয়ে ভাল উপায়। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণের মাধ্যমে একটি সহনশীল, বাস্তব ও ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। সুইসজারল্যান্ডের বিদেশি সাংবাদিক সমিতির চেয়ারম্যান পিটার কেনি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’যৌথ নির্মাণের আওতায় আফ্রিকান দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের উপর বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন। তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণের মাধ্যমে আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের অবস্থাও ভিন্ন। হাঙ্গেরির জন ভন নিউম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরেশিয়া কেন্দ্রের পরিচালক হরভাথ লেভেন্ট বলেন, বিশ্বের উন্নয়ন কোন দিকে যাবে তা কয়েকটি দেশের সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিশ্বের নানা দেশ একসঙ্গে সেটা বেছে নেয়। চীন-উত্থাপিত

‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ প্রস্তাব ও উদ্যোগ বিভিন্ন সভ্যতা ও দেশের প্রতি সম্মান এবং অভিন্ন উন্নয়নের প্রত্যাশা প্রকাশ করে।

কোনও দেশ বড় বা ছোট হোক, তার শক্তি বেশি বা কম হোক, উন্নয়ন দ্রুত বা ধীর হোক সবাই আন্তর্জাতিক সমাজের একটি সদস্য। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ যৌথ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কোনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শর্ত থাকে না। সবাই সমান অংশগ্রহণকারী ও উপকারভোগী। এটা যৌথ আলোচনার মাধ্যমে একটি ন্যায় সৃঙ্খলা গড়ে তোলে।

কেবল নানা দেশ সমানভাবে সহযোগিতা করলে, অভিন্ন উন্নয়ন হলে সমৃদ্ধি স্থায়ী হতে পারে এবং মানবাধিকার পুরোপুরি উপভোগের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে পারে। (শিশির/রহমান/রুবি)