যে কারণে চীনা যুবকরা চাকরির পাশাপাশি রাতের স্কুলে পড়তে আগ্রহী
2023-12-11 17:20:32

চীনা সমাজে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের জীবনযাপনের ধরন পাল্টাচ্ছে। তাদের স্টাইলের সঙ্গে প্রবীণদের সনাতন স্টাইলের প্রার্থক্য দিন দিন বাড়ছে। তরুণদের কেউ কেউ আজকাল অফিসের চাকরিশেষে রাতে নৃত্য ও গান চর্চা করেন, কেউ কেউ ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক শিল্পকর্মের ওয়ার্কশপে নিজের প্রিয় হাতের কাজ শেখেন, কেউ কেউ জিমে শরীরচর্চা করেন, আবার কেউ কেউ ভ্লগ শুটিং বা রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন মজার প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। তবে আরেকটি নতুন প্রবণতা এখন চীনা যুবকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, তা হল নাইট স্কুলে পড়াশোনা। অনেকে অফিসের কাজ শেষ করে নিজের প্রিয় বিষয়ে আবার নাইট স্কুলে পড়েন। তারা মনে করেন, এভাবে নতুন জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি লেখাপড়ার মাধ্যমে মানসিক চাপও কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে: কেন নাইট স্কুল, বিশেষ করে কর্মজীবী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয়ক কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

চলতি বছর চীনের সার্চ ইঞ্জিনে ‘নাইট স্কুল’-সংশ্লিষ্ট শব্দের সার্চের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৯৮০ শতাংশ বেড়েছে, সংশ্লিষ্ট পোস্টগুলোতে মন্তব্যের সংখ্যাও ২২৬ শতাংশ বেড়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার এপিপিতে যুবকদের নাইট স্কুলসংশ্লিষ্ট টপিকও ইন্টারনেটে বেশ জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের শাংহাই মহানগরে নাইট স্কুলের শরত্কালীন সেমিস্টারে মোট সাড়ে ৬ লাখ লোক অনলাইনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য নিবন্ধন করেন। এ শহরের ১৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৮২টি নাইট ক্লাসের ৯১১৭ জন শিক্ষার্থীর কোটা ঘোষণার আধা ঘন্টার মধ্যে বুকিং হয়ে যায়। অনেক নেটিজেন মনে করেন, অনলাইনে নাইট স্কুলের নিবন্ধন বসন্ত উত্সবের সময় জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার টিকিট কেনার চেয়েও বেশি কঠিন।

অনেক যুবক মনে করেন, নাইট স্কুল তাদের কাছে ‘শিল্পের প্রশিক্ষণ ক্লাস’। দীর্ঘকাল ধরেই চীনাদের মধ্যে শিল্পকলা শেখা জনপ্রিয়। বাচ্চাদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্তরাও আজকাল শিল্পকলা শেষেন। এই সেদিনও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে শিল্পকলার প্রশিক্ষণ কোর্সকারীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। তবে, বর্তমানে চীনা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নাইট স্কুলের জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয়ের কারণে অনেকে তাদের চাহিদাকে দমনও করছেন। তাই কম খরচে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ক্লাসের অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া চীনা তরুণ-তরুণীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

শুরুতে শাংহাই শহরের নাইট স্কুলের ক্লাসের ধরন বেশি ছিল না। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে, এখন অনেক নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। নতুন ধরনের ক্লাস চালু হওয়ায় ও ফি-ও তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায়, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আজকাল নাইট স্কুল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ৭ বছর ধরে শাংহাই নাইট স্কুলের ক্লাস সংখ্যা ১২টি, মোট ফি ৫০০ ইউয়ান। প্রতি ক্লাসের জন্য মাত্র ৪০ ইউয়ানের মতো। সবার জন্যই এই দাম আকর্ষণীয়। তা ছাড়া, নাইট স্কুলের ক্লাসের সময় সাধারণ রাতে। তখন ট্রাফিকের ঝামেলা কম থাকে। তাই কেবল শাংহাইয়ে নয়, কুয়াংচৌসহ বিভিন্ন বড় শহরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নাইট ক্লাস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কুয়াংচৌ শহরের নাইট স্কুলে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আর মধ্যবয়সীদের বেশি দেখা যায়। সাধারণত প্রতি শুক্রবার রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এ ক্লাস চলে। কর্মজীবী তরুণ-তরুণীদের জন্য এটা গ্রহণযোগ্য।

নাইট স্কুলের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করার আগে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জরিপ করা হয়। তাদের প্রিয় বিষয় বিবেচনা করে যথাযথভাবে ক্লাসের ধরণ সমন্বয় করা হয়। এভাবে তরুণ-তরুণীদের নাইট স্কুলের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়ছে।

মোদ্দাকথা, নাইট স্কুলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা মধ্যবয়সী ও তরুণ-তরুণীদের শিল্পকলা শেখার আগ্রহের প্রতিফলন। আরও অনেক তরুণ-তরুণী ব্যস্ত জীবনের মূল কাজে জড়িত থাকার পাশাপাশি নিজের প্রিয় বিষয় নিয়ে পড়াশোনা বা গবেষণা করবেন বলে আশা করা যায়। নাইট স্কুল প্ল্যাটফর্মে তরুণ-তরুণীরা সাধারণ পড়াশোনা ছাড়াও অনেক নতুন বিষয় নিয়ে পড়তে পারেন।

এ সম্পর্কে বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষণাকেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক চাং হুয়া চুন বলেন, নাইট স্কুল তরুণ-তরুণীদের আত্মার খোরাক যোগাতে ও তাদের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম। তাঁরা নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রিয় শখের বিষয় আরও ভালো করে শিখতে পারে, যা চীনের ‘আজীবন শিক্ষা’ ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

বস্তুত, নাইট স্কুল জনসংস্কৃতির সম্প্রচার ও আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম। এখানে সাধারণ মানুষ আজীবন লেখাপড়ার সুযোগ পেতে পারে। নাইট স্কুলে কেবল নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা যায় তা নয়, বরং তরুণ-তরুণীরা নিজেদের জীবন আরও সমৃদ্ধ ও মজাদার করতে পারে; সুখী হতে পারে। তাই নাইট স্কুল কেবল বহুমুখী ও গুণগত মানের লেখাপড়ার প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং আজীবন শিক্ষাকে সম্ভব করে তোলে।

কুয়াংচৌ শহরের একটি যুব নাইট স্কুলে হিপ-হপ ক্লাসের শিক্ষার্থী সিয়াও ইয়ান বহু যুব-শিক্ষার্থীর একজন। হিপ-হপ  তাঁর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ সম্পর্কে সিয়াও ইয়ান স্মরণ করে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি নৃত্য বেশ পছন্দ করি। বাড়িতে আয়নার সামনে নিয়মিত নৃত্য করি। তবে আমার চরিত্র অন্তর্মুখী এবং আমি একটু মোটা। তাই অনেকের সামনে দাঁড়িয়ে নৃত্য করতে ভয় পাই এবং কখনও এ স্বপ্ন পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ারও করিনি। তবে নৃত্যের কথা কখনো ভুলে যাইনি।’ হঠাত্ একদিন নাইট স্কুলের নৃত্য ক্লাসের নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান সিয়াও ইয়ান। তখন তিনি নৃত্য ক্লাসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হিপ হপ শেখার শুরুর দিকে তিনি ভালো করে নৃত্য করতে পারতেন না। বিভিন্ন ভঙ্গিও ঠিকঠাক করতে পারতেন না। তবে ধীরে ধীরে টানা আধা মিনিটের মতো নৃত্যের ভঙ্গি শিখতে পারেন এবং নৃত্যের মজাও অনুভব করতে শেখেন। মেয়ে সিয়াও ইয়ানের জন্য নাইট স্কুলে নৃত্য শেখার সিদ্ধান্ত নৃত্যের চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে সিয়াও ইয়ান বলেন, “চলতি বছর আমি নতুন চাকরি নিয়েছি। একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। তাই জীবনযাপনের ছন্দ ও অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হই। অনেক সময় বাড়িতে কাজ নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। নাইট স্কুল আমার নৃত্যের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এবং আমার মন ও শরীর শান্ত হয়েছে। ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দিতে আমি খুব পছন্দ করি।”

এ সম্পর্কে সহকারী অধ্যাপক চাং মনে করেন, নাইট স্কুলের স্নাতকপত্র থাকে না, কেবল বিভিন্ন দক্ষতা বা শখ শেখার জন্য ক্লাসে যোগ দেয় শিক্ষার্থীরা। তাই তাদের জন্য লেখাপড়ার প্রক্রিয়া আরও মজার ও তাত্পর্যপূর্ণ। নাইট স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসে কোনো উচ্চ কার্যকারিতা বা কেপিআই থাকে না, তাই শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপও থাকে না। অনেক তরুণ-তরুণী এমন ক্লাসের মাধ্যমে মানসিক চাপ বরং কমান এবং নতুন উন্নয়নের সম্ভাবনা খুঁজে পান। সেটি উচ্চ চাপের চাকরির পাশাপাশি এক ধরনের আরামদায়ক পদ্ধতি।

তরুণ-তরুণীদের নাইট স্কুল কেবল আধুনিক যুগে তরুণ-তরুণীদের নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহের প্রতীক নয়, বরং চীনের বিভিন্ন এলাকায় জনসাংস্কৃতিক পরিষেবা ব্যবস্থা উন্নয়ন আর শিল্পকলা শিক্ষার উন্নয়নের প্রতিফলন।

শাংহাই মহানগরের নাইট স্কুলে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে স্থানীয় সুপরিচিত সিনিয়র শিল্পী বা হস্তকর্মশিল্পী। ব্রিজ খেলা, চীনা অপেরা, দক্ষিণ চীন স্টাইলের ঐতিহ্যিক মিষ্টিসহ বিভিন্ন মজার ক্লাসে দক্ষ ও সুপরিচিত সিনিয়র শিক্ষক যোগ দেন এসব ক্লাসে। এভাবে যুব শিক্ষার্থীদের জন্য আরও ভালো শিক্ষার সুযোগ আছে। শিক্ষকরা ক্লাসের মাধ্যমে আরও জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের জনসাংস্কৃতিক পরিষেবার ব্যবস্থা দ্রুত উন্নত হয়েছে। চীন সরকার জনসাংস্কৃতিক পরিষেবা উন্নয়নের বিভিন্ন সরকারি দলিল ও পরামর্শ প্রকাশ করেছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনাদের জীবনযাপনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষারও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে।

চীনের পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা একাডেমির অধ্যাপক লি লি কুও মনে করেন, নাইট স্কুলের জনপ্রিয়তার পিছনে বিভিন্ন শহরের সাংস্কৃতিক পরিষেবা ও সামাজিক কমিউনিটির শিক্ষার উদ্ভাবনের ভূমিকা আছে। বর্তমানে জ্ঞানের বিস্ফোরণের যুগে নতুন প্রযুক্তি, ধারণা ও নতুন শিল্প ক্রমশ বাড়ছে। তাই নাইট  স্কুল তরুণ-তরুণীদের নতুন জ্ঞান অর্জন, জ্ঞানের কাঠামো উন্নতকরণ, এবং দৃষ্টি বিস্তারের ভালো প্ল্যাটফর্ম।

ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিক শিল্পের উন্নয়নে আরও শ্রেষ্ঠ শিক্ষাসম্পদ ও সাংস্কৃতিক পরিষেবা দিতে হলে বিভিন্ন দলের লেখাপড়ার চাহিদা মেটানো জরুরি। এভাবে দক্ষ ব্যক্তির উন্নয়নে উত্সাহ দেওয়া যায়। অধ্যাপক লি মনে করেন, নাইট স্কুলের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পক্ষের যৌথ প্রয়াস দরকার। তাই চলমান নাইট স্কুলগুলোর জন্য সমাজের বিভিন্ন মহলের সমর্থন দরকার। এটা যে সাময়িক ব্যাপার না হয়, দীর্ঘমেয়াদি বিষয় হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পরিবার, স্কুল ও সামাজিক শিক্ষার বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত করে চীনাদের আজীবন পড়াশোনার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব; সম্পূর্ণভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংস্থা ও বিভিন্ন মহলের শ্রেষ্ঠ সম্পদ কাজে লাগিয়ে শ্রেষ্ঠ জনসাংস্কৃতিক পরিষেবা থেকে অধিক থেকে অধিকতর মানুষের উপকার করা সম্ভব।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)