৩৫ বছর আগে যখন চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইউননান প্রদেশের খুনমিং শহরের সীমান্তবর্তী গ্রাম তৌনানে প্রথম অর্কিড রোপণ করা হয়েছিল, তখন কি কেউ ভেবেছিলেন যে, ৩৫ বছর পর গ্রামটি এশিয়ার বৃহত্তম ফুল-বাজারে পরিণত হবে? নিশ্চয়ই না! আজকের অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে আমি আপনাদেরকে এই গ্রামের ফুল-বাজার হয়ে ওঠার গল্প শোনাবো।
তৌনান গ্রামের ফুল-বাজারে ৫৬ বছর বয়সী হুয়া মিং শেং ছেলে'র উদ্ভিদের দোকানে বসে আছেন। দোকানটির বিভিন্ন উদ্ভিদ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতিদিন দোকানে অনেক মানুষর ভিড় হয়। হুয়া মিং শেং অকাতরে সবার প্রশ্নের জবাব দেন। আসলে ৩৫ বছর আগে তথা গত শতাব্দীর আশির দশকে হুয়া মিং শেংও উদ্ভিদ সম্পর্কে জানতে খুবই কম। তখন তিনিসহ তৌনান গ্রামের বাসিন্দারা জীবিকা নির্বাহের জন্য সবজি চাষ করতেন।
১৯৮৭ সালে তখন ২৪ বছর বয়সী হুয়া মিং শেং শহরের বন্ধু'র সাহায্যে ৯০ ইউয়ান আরএমবি পুঁজি নিয়ে ফুলের চাষ শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ফুল বিক্রি করে আমার প্রথম আয় হয়েছিল ১৫০ থেকে ১৬০ ইউয়ান। তখন এ আয়ও কম ছিল না। তখন এক কিলোগ্রাম সবজির দাম ছিল মাত্র ০.১ ইউয়ান। এ ছাড়া, সবজি পরিবহনের খরচ ছিল। সে তুলনায় ফুল চাষ করা সহজ ও মুনাফা বেশি।
মুনাফা অর্জনের পর হুয়া মিং শেং কাছাকাছি এলাকার আরো বেশি জমি ভাড়া করেন। এ ছাড়া, তিনি চীনা বিজ্ঞান একাডেমির খুনমিং উদ্ভিদ গবেষণালয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ফুল চাষের কলা-কৌশল শিখে নেন। তিনি এখন শুধু যে ফুলের চারা রোপনকারী একজন কৃষক তা নয়, বরং কৃষি প্রযুক্তিবিদ। তিনি সমগ্র তৌনান গ্রামের বাসিন্দাদের ফুল চাষে নেতৃত্ব দেন এবং তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ধীরে ধীরে তৌনান গ্রামে ফুল চাষ ও বিক্রির ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফুল ব্যবসায়ীরা নিয়মিত গ্রামে আসতে থাকেনা। ফুল ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে তৌনান গ্রামে বিশেষ ফুল-বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তৌনান গ্রামের প্রথম ফুল-বাজার যাত্রা শুরু করে। এর পর তৌনান গ্রামের বাসিন্দারা বুঝতে পারেন যে, বাজারজাত করা হচ্ছে ফুলশিল্প উন্নয়নের একমাত্র পদ্ধতি। ১৯৯৯ সালে ইউননান প্রদেশের তৌনান ফুল শিল্প গোষ্ঠীর পূর্ববর্তী তৌনান ফুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে তৌনানে ধীরে ধীরে একটি ফুল-কেন্দ্রিক শিল্প ক্লাস্টার গড়ে ওঠে। তৌনান ফুল শিল্প গোষ্ঠীর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক তং রুই বলেন, "তৌনান ফুল-বাজার গড়ে ওঠার পর ধীরে ধীরে প্যাকিং, পণ্য পরিবহন, কৃষিসার ও গ্রিনহাউস সরঞ্জামের শিল্পও তৌনান গ্রামে উন্নত হতে থাকে। ফুলকে কেন্দ্র করে এখানে একটি শিল্প এলাকা গড়ে ওঠে।"
তৌনান গ্রামে বিগত কয়েক দশকে ব্যবসার কাঠামোতেও সংস্কার সাধিত হয়েছে। গ্রামে নেদারল্যান্ডস্ থেকে ফুল নিলাম-কৌশল এসেছে। খুনমিং আন্তর্জাতিক ফুল নিলামকেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক চাং লি বলেন, উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ বিডিংয়ের মাধ্যমে ফুল বিক্রি হয়। চাং লি বলেন, "চাষীদের কাজ হচ্ছে কেবল ফুলের চাষে করা ও উত্পাদিত ফুলের মান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা। তাঁরা বিক্রি নিয়ে চিন্তামুক্ত। ১০ হাজারেরও বেশি চাষীকে প্রতিদিন বাজারে আসতে হয় না। তাঁরা শুধু নিজ নিজ বাড়িতে ফুল প্যাকিং করেন। আমরা বিশেষ গাড়ি পাঠিয়ে তাঁদের কাছ থেকে ফুলগুলো সংগ্রহ করে আনি।"
বর্তমানে তৌনান আন্তর্জাতিক ফুল-বাজার ও ফুলকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, এমনকি বাকি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুল-ব্যবসায়ীরা তৌনান ফুল-বাজারে ব্যবসা করেন। তৌনান গ্রামের ফুল চীনের ৮০টিরও বেশি বড় ও মাঝারী আকারের শহরের ৭০ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। গ্রামটির ফুল ৪৬টি দেশ ও অঞ্চলে রফতানি হয়। বাজারটি টানা ২০ বছর ধরে ফুল-উত্পাদন ও ব্যবসায় চীনের এক নম্বর স্থানে রয়েছে।
কিন্তু তৌনান গ্রামবাসীদের কাজের গতি কখনো কম হয়নি। তৌনান এখন নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তৌনান আন্তর্জাতিক ফুল শিল্প ক্ষেত্রের পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ফান শেং থিয়ান বলেন, "ভবিষ্যতে তৌনান হবে আমাদের সমগ্র ইউননান প্রদেশের প্রতীক। তৌনানএ ফুল ফোটার শব্দ শোনা যায়, ফুলের সুগদ্ধ পাওয়া যায়। এখানে এলে মনে হয় ফুলের জন্মস্থানে এসেছি। আমরা এখানে থাকার ও ব্যবসার পরিবেশ আরও উন্নত করতে চাই এবং সেলক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।"
এ পর্যন্ত তৌনানে ২ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলো ফুল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখানে ফুল চাষের পাশাপাশি, ফুলের প্যাকিং, পরিবহন, ও গবেষণা হয়। ফুলকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটনশিল্পও উন্নত হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের শেষ দিকে তৌনান শুধু যে জাতীয় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যময় নগরে পরিণত হবে, তা নয়; বরং এশিয়া ও বিশ্বের প্রথম পর্যায়ের ফুল বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হবে।