দেহঘড়ি পর্ব-০৪৮
2023-12-10 15:46:07

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

হৃদরোগের টিসিএম দাওয়াই

কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগ হলো বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, প্রতি বছর আনুমানিক ১ কোটি ৮০ লাখ জীবন কেড়ে নেয় এই রোগ। হৃদরোগ বলতে আসলে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালীর ব্যাধিগুলোকে বোঝানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে করোনারি হৃদরোগ, সেরিব্রোভাসকুলার রোগ, রিউম্যাটিক হৃদরোগ ও হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত অন্যান্য রোগ। হৃদরোগজনিত মৃত্যর ৮০ শতাংশই ঘটে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণে।

পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থায় দেহের অঙ্গগুলোকে পৃথক শারীরিক একক হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা বা টিসিএমে অঙ্গগুলোকে শরীরের ভিতর বিশাল নেটওয়ার্কের আন্তঃসম্পর্কিত অংশ হিসাবে দেখা হয়। তবে হৃদযন্ত্রকে সামগ্রিক শারীরিক স্বাস্থ্যের কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হয়। এ চিকিৎসাব্যবস্থায় মনে করা হয়, শরীর সুস্থ থাকে তখন, যখন শরীরের মূল শক্তি বা ‘ছি’র দুটি উপাদান অর্থাৎ তাপশক্তি বা ‘ইয়াং’ এবং ঠান্ডাশক্তি বা ‘ইয়িন’-এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এই ভারসাম্য-নীতি মতে, যদি আপনার কোনও অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয় বা ঠিকমতো কাজ না করে, তবে অন্তত অন্য একটি অঙ্গও এর ফলে প্রভাবিত হবে।

হৃদরোগ প্রতিরোগ ও নিরাময়ে সবচেয়ে ভালো টিসিএম ব্যবস্থা হলো আকুপাংচার ও ভেষজ ওষুধ। মানুষের ওপর পরিচালিত বেশ কয়েকটি ক্লিনিকাল স্টাডিতে প্রমাণ মিলেছে, আকুপাংচার কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এবং বিভিন্ন হৃদরোগ নিরাময় করতে পারে। শক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে আকুপাংচারকে সবচেয়ে কার্যকর সহায়ক থেরাপি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর, অ্যারিথমিয়াস এবং সিস্টেমিক উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে আকুপাংচার বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।

হৃদরোগের জন্য যে ভেষজ ওষুধ টিসিএম চিকিৎসকরা দেন সেগুলো রোগীদের অবস্থাভেদে ভিন্ন হয়। টিসিএম প্রেসক্রিপশনের ধারণা হলো রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী বেশ কিছু ঔষধি ভেষজকে একত্রিত করে একটি ফরমুলা তৈরি করা। টিসিএমের সবচেয়ে স্বীকৃত তত্ত্ব হলো ‘চুন-চ্যন-চুও-শি’ অর্থাৎ সম্রাট-মন্ত্রী-সহায়তাকারী-কুরিয়ার। চুন রোগের প্রধান কারণ বা উপসর্গ দূর করে, চ্যন’ চুনের প্রভাবকে শক্তিশালী করে, ‘চুও’ চুনের সম্ভাব্য বিষাক্ত প্রভাব কমায় বা দূর করে এবং ‘শি’ ভেষজগুলোকে নির্দিষ্ট অঙ্গগুলোতে পৌঁছে দেয়। হার্ট ফেইলিওরের চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি ফরমুলা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বেশ কয়েকটি পেটেন্ট ওষুধ, যেমন বড়ি, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের মতে, হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান, অপর্যাপ্ত বা নিম্নমানের ঘুম এবং অনিয়ন্ত্রিত মানসিক চাপ। টিসিএমের নীতি মেনে প্রতিটি ঝুঁকিই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জেনে নেবো কীভাবে এসব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে সম্পর্কে:

নিষ্ক্রিয়তা দূর করার জন্য থাইচি, ছিকুং ও যোগ ব্যায়াম করা যায়। থাইচি ব্যায়ামের একটি মৃদু ধরন। এটি শারীরিক শক্তি, নমনীয়তা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং একটি সুস্থ জীবনযাপনে সাহায্য করে। থাইচিকে সাধারণত ‘গতির মধ্যে ধ্যান’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিক যে, মন ও শরীরের এই অনুশীলন অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময় ও প্রতিরোধ করতে পারে। অন্যদিকে ছিংকুং হলো শারীরিক-ভঙ্গিমা, নড়াচড়া, শ্বাস-প্রশ্বাস ও ধ্যানের একটি ব্যবস্থা যা স্বাস্থ্য, আধ্যাত্মিকতা ও মার্শাল-আর্ট প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আর যোগ ব্যায়াম বা ইয়োগা হলো মনঃসংযোগ করার মাধ্যমে একটি নিদিষ্টি নিয়মে অবস্থান করা এবং পদ্ধতিমাফিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনা করা। মনকে সুস্থ্য রাখতে নিয়মিত যোগ ব্যায়ামের কোনও বিকল্প নাই।

টিসিএমে মনে করা হয়, কয়েকটি খাবার রয়েছে যা শরীরে ইয়াং বা উষ্ণ শক্তির ঘাটতি পূরণের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডকে পুষ্ট করতে সাহায্য করে। এর মধ্য দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় সম্ভব হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লাল খাবার অর্থাৎ টমেটো, চেরি, লাল মটরশুটি, তরমুজ, আপেল, স্ট্রবেরি ও গরুর মাংস।

টিসিএমে মনে করা হয়, খারাপ ঘুমের জন্য দায়ী ‘ইয়িন’ ও ‘ইয়াং’ শক্তির ভারসাম্যহীনতা। ঘুমের সমস্যার ওপর ভিত্তি করে টিসিএম চিকিৎসক প্রয়োজন অনুসারে একটি ভেষজ ফরমুলা দিতে পারেন। এছাড়াও, ভাল ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন, যেমন সময়সূচি মেনে ঘুমোতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে উঠা, ঘুমানোর আগে টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইল ডিভাইস বন্ধ করা এবং বিছানা ও শয়নকক্ষকে আরামদায়ক ঘুমের উপযোগী করা।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

চীনের শীর্ষ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বিনচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল

বিনচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএমইউএইচ) উত্তর চীনের শানতুং প্রদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় হাসপাতাল। একটি জেনারেল হাসপাতাল হিসাবে এটি চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাশিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং রোগ প্রতিরোধমূলক সেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

শানতুং প্রদেশের বিনচৌ শহরের কেন্দ্রস্থলে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকবার নাম বদলেছে এ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের। শুরুতে এটার নাম ছিল ছিংদাও মেডিকেল কলেজ-অধিভুক্ত বেইজেন শাখা হাসপাতাল, তারপর বেইজেন মেডিকেল কলেজ-অধিভুক্ত হাসপাতাল এবং সবশেষে বিনচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল। সর্বশেষ নামটি গৃহীত হয় ১৯৮৩ সালে।

শানতুং প্রদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশন ১৯৯৫ সালে এবং ২০১৩ বিনচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালকে সর্বোচ্চ স্তরের ‘এ’ শ্রেণির হাসপাতাল হিসাবে শ্রেণিবিন্যাস করে। এটি চীনের হাসপাতালগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর। ওই কমিশন ২০১৪ সালে এটিকে ‘আঞ্চলিক চিকিৎসা কেন্দ্রের নির্মাতা’ হিসাবেও স্বীকৃতি দেয়।

অসামান্য বিশেষজ্ঞ, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত কৌশল নিয়ে বিগত চার দশক ধরে প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ব্যাপক আধুনিক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে বিএমইউএইচ। চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও গবেষণাকে একই ছাদের নিচে এনে এ হাসপাতাল শানতুং প্রদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলের রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবার এক ভরসাস্থলে হয়ে উঠেছে।

১ হাজার ৮শ শয্যাবিশিষ্ট বিএমইউএইচ বছরে ১৩-১৫ লাখ রোগীকে বহির্বিভাগ থেকে সেবা দেয়, প্রায় ৮০ হাজার রোগীকে ভর্তি করে এবং ৩২ হাজার রোগীকে শল্যচিকিৎসা দেয়।

বিনচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রয়েছে ৩ হাজারেরও বেশি পূর্ণকালীন কর্মী, যাদের মধ্যে ৩৭৩ জন পূর্ণ বা সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৩৬ জন স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি পর্যায়ের সুপারভাইজার।

কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন যুগে জাতীয়ভাবে সুপরিচিত একটি আধুনিক হাসপাতাল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে বিএমইউএইচ।      

 

#ভেষজের গুণ

গুণের শেষ নেই একাঙ্গীর

একাঙ্গীর সমান কদর ভেষজ ও রান্নার মসলা হিসাবে। এশিয়ার রন্ধনশিল্পে এটি অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। আদা বা হলুদের মতো দেখতে এই মশলাটি ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং চীন, তাইওয়ান, জাপান, কম্বোডিয়া ও কোরিয়ায় উৎপন্ন হয়। একাঙ্গীর রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। চলুন জেনে নিই এর কতগুলো গুণ সম্পর্কে:

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: একাঙ্গীতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং অ্যালপাইন ও গ্যালাঙ্গিনসহ এক ডজনেরও বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়৷ গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভির বিরুদ্ধেও লড়াই করে এ ভেষজ।

ক্যান্সার প্রতিরোধী: একাঙ্গী হলো জিঙ্গিবেরাসি পরিবারের সদস্য, যার মধ্যে আদা, হলুদ ও এলাচ রয়েছে। এই গোষ্ঠীর উদ্ভিদে ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। একাঙ্গীতে থাকা গ্যালাঙ্গিন রাসায়নিক জিনোটক্সিসিটির বিরুদ্ধে লড়াই করে। এছাড়া এটি রক্ত বিশুদ্ধ করে, ঠান্ডাজনিত রোগব্যধি প্রতিরোধ করে, গলা ব্যথা, মাথা ধরা দূর করে।

শারীরিক অক্ষমতা দূর করে: পুরুষের শারীরিক অক্ষমতার চিকিৎসায় এ ভেষজ ব্যবহৃত হয় প্রাচীনকাল থেকে। ২০১৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, একাঙ্গীতে থাকা ইথানোলিক নির্যাস শুক্রাণু বৃদ্ধি করে ব্যাপকভাবে।

চেহারায় দ্যুতি বাড়ায়: একাঙ্গী চেহারায় দ্যুতি আনতে সক্ষম। মুখের দাগ ও চর্ম রোগ সারতে এটি বিশেষভাবে কার্যকরী। এছাড়া এ ভেষজ চুলের গোড়া মজবুত করে, চুল পড়া রোধ করে, খুশকি প্রতিরোধ করে এবং চুল উজ্জ্বল ও মসৃণ করে।

পেটের পীড়া দূর করে: ডায়রিয়া ও অন্যান্য পেটের অসুখ নিরাময়ে এটি ভীষণ কার্যকরী। একাঙ্গীর চা দেহের জড়তা কাটিয়ে কর্মমুখী হতে এবং কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে সহায়তা করে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।