চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৪৬
2023-12-09 20:34:32

১. সংস্কৃতি সপ্তাহ

হাংচৌতে ‘সিল্ক রোড শিল্পীদের মিলনমেলা’

চীনের চেচিয়াং প্রদেশের হাংচৌতে অবস্থিত প্রাচীন লিয়াংচৌ শহর বহন করছে চীনের ৫ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে এখানে ছিল সমৃদ্ধ প্রাচীন চীনা সভ্যতা। ১৯৩৬ সাল থেকে এখানে আবিষ্কৃত হতে থাকে প্রাগৈতিহাসিক চীনা সভ্যতার নানা নিদর্শন। ২০১৯ সালে লিয়াংচৌর প্রাচীন নিদর্শন ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।

লিয়াংচৌ তথা প্রাচীন চীনা সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে সম্প্রতি হাংচৌতে হয়ে গেলো প্রথম লিয়াংচৌ ফোরাম। চীনের সভ্যতার ইতিহাসে লিয়াংচৌর গুরুত্ব তুলে ধরে অভিনন্দন বার্তা পাঠান চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

লিয়াংচৌ ফোরামের অংশ হিসেবে হাংচৌতে ‘সিল্ক রোড শিল্পীদের মিলনমেলা’ শিরোনামে একটি চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়, যেখানে বিশ্বের ৮৩টি দেশের ৮৪ জন শিল্পীর আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়। শিল্পীরা হাংচৌর সুবিখ্যাত পশ্চিম হ্রদ এবং লিয়াংচৌ শহরসহ নানা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে এ সব ছবি আঁকেন।

জার্মান চিত্রশিল্পী তানজা হেমান লিয়াংচৌর সাংস্কৃতিক সাইট ও নিদর্শন পরিদর্শন করে অভিভূত হন- তিনি জানান চীনের ক্যালিগ্রাফি তার আঁকার স্টাইলকেও প্রভাবিত করেছে। তিনি বলেন:

‘সবার আগে আমি বলতে চাই যে, লিয়াংচৌর প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এখানে আমরা প্রথম দিনেই এসেছিলাম এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এ নিয়ে আমি কাজ করবো’।

২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০০টি দেশের শিল্পী ‘সিল্ক রোড শিল্পীদের মিলনমেলা’য় অংশ নিয়েছেন। চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এর আয়োজক।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।

 

২. সিয়ামেনে হ্যখও সম্প্রদায়ের ওয়াংছুয়ান উৎসব

পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের সিয়ামেনের হ্যখও সম্প্রদায় সম্প্রতি তাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াংছুয়ান উৎসব উদযাপন করেছে। চতুর্বার্ষিক এ উদযাপনে ছিল লোক-পরিবেশনা, শোভাযাত্রা ও নৌকা-উৎসব।

 

দেবতা ওং ইয়া’র উপাসনা থেকে চালু হয় শতাব্দি প্রাচীন ওয়াংছুয়ান বা অং ছুয়ান উৎসবটি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এ দেবতা উপকূলীয় মানুষকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। ২০২০ সালে ওয়াংছুয়ান উৎসব ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়।

প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এবারের উৎসবেও ছিল সুনচিয়কং মন্দিরের সামনে ঐতিহ্যবাহী সিংহনৃত্য। তার আগে ছিল বর্ণিল সাজসজ্জায় সজ্জিত নৌকা নিয়ে শোভাযাত্রা। ৮ মিটার লম্বা ও ১ দশমিক ৮ মিটার চওড়া ওয়াংছুন নৌকাটি তৈরি করতে ৮ জন কারিগরের ৬ মাস সময় লাগে।

এবার উৎসবের বিশেষত্ব ছিল তাইওয়ানে খিনমেন দ্বীপের ২০ জন প্রতিনিধির যোগদান। এর মধ্য দিয়ে তাইওয়ান প্রণালীর দুই পারের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করেন আয়োজকরা।

হ্যখও সম্প্রদায় তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণে একটি থিম-ভিলেজ প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা করছে।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।

 

স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল গালা ২০২৪-এর লোগো উন্মোচন

ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন ড্রাগন বর্ষকে সামনে রেখে চায়না মিডিয়া গ্রুপ-সিএমজি সম্প্রতি স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল গালা ২০২৪-এর থিম ও লোগো উন্মোচন করে।

লোগোটির ডিজাইনার কু ইয়াংচিয়াং সম্প্রতি সিএমজির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। বলেন, ২০২৪ সালের স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল গালার থিম এবং লোগো মহান চীনা জাতির চেতনাকে প্রতিফলিত করে।

এবারের লোগোতে সচরাচর ব্যবহৃত হয় না এমন একটি অক্ষরকে ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ ‘ড্রাগনের উড্ডয়ন’। ডিজাইনা কু বলেন, এর মাধ্যমে আসলে ১৪০ কোটি চীনা মানুষের নতুন জাতীয় পুনরুজ্জীবনক রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

লোগোটি প্রকাশের পরপরই তা সবার নজর কাড়ে এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।

 

২. এবার চিরায়ত চীনা সাহিত্য

কবি সু শি: সং রাজবংশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র

সং রাজবংশের সময়কার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলেন সু শি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের চীনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক, রাজনীতিবিদ, ক্যালিগ্রাফার বা হস্তলিপিশিল্পী, চিত্রশিল্পী, এবং চিকিৎসক। তিনি সু তং ফো নামেও পরিচিত ছিলেন। তার ভ্রমণগদ্য থেকে সং রাজবংশের সময়কার চীন বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। 

১০৩৭ সালের ৮ জানুয়ারি সিচুয়ান প্রদেশের মেইশানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সু সুন এবং ভাই সু চা দুজনেই ছিলেন লেখক। গ্রামের বিদ্যালয়ে একজন তাও পুরোহিতের কাছে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি ও তার ভাই দুজনেই সরকারি চাকরির পরীক্ষায় কম বয়সে পাশ করে সম্রাট রানচোংয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এরপরে আরেকটি পরীক্ষাতেও সু শি উচ্চ মেধার পরিচয় দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন উচুঁ পদে চাকরি করে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি তার কবিতা লেখাও চলতে থাকে। একটি কবিতায় তিনি সরকারি কাজের সমালোচনা করেন। ফলে রাজরোষে পড়ে তাকে নির্বাসন দণ্ড মেনে নিতে হয়।

প্রায় বিশ বছর সুকে নির্বাসনে কাটাতে হয়। তবে সে সময়েই তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লেখা হয়। নির্বাসনে থাকার সময় সু শির লেখা একটি কবিতা শোনাচ্ছি আপনাদের।

পুত্রের জন্ম উপলক্ষ্যে

পরিবারে যখন একটি শিশুর জন্ম হয়

সবাই আশা করে সে বুদ্ধিমান হবে।

অথচ আমি বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে

আমার সারা জীবন নষ্ট করে ফেলেছি।

আমি শুধু আশা করি নবজাতক প্রমাণ করবে

সে অজ্ঞ এবং বোকা

তাহলে সে সুখে দিন কাটাবে

এবং বড় হয়ে দরবারে মন্ত্রী হবে।

এই কবিতায় প্রকারান্তরে রাজমন্ত্রীদের অজ্ঞ এবং মূর্খ বলে উপহাস করা হয়েছে। কারণ সুশি মনে করতেন একমাত্র বোকারাই চোখ বন্ধ করে চাটুকারিতা করতে পারে। বুদ্ধিমান বিচক্ষণ মানুষ কখনও নির্লজ্জভাবে চাটুকারিতা করতে পারে না। আর চাটুকারিতা না করলে মন্ত্রী হওয়া বা বড় পদে আসীন হওয়া সম্ভব হয় না। কবিতায় এ ধরণের সত্যভাষণ এবং প্রতিবাদ সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তার স্যাটায়ারধর্মী লেখাগুলোর কারণে তিনি জনসাধারণের প্রিয় হয়ে ওঠেন।

শুধু কবিতা নয় তাঁর আঁকা ছবি এবং ক্যালিগ্রাফিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তার কবিতা লোকের মুখে মুখে ফিরতো। ১১০০ সালে সু শি’র নির্বাসন দণ্ড মওকুফ হয়। তাঁকে নতুন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় ছেংতুতে। নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে  ছাংচোওতে ১১০১ সালের ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন  সু শি।

মৃত্যুর পর তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। দূর দূরান্তের মানুষ তার ছবি ও হস্তলিপি সংগ্রহে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তার কবিতা চীনা চিরায়ত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

---------------------------------------------------------------------------

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ।