প্রতিবন্ধী দাবাড়ু সিয়ে হাইথাও
2023-12-07 10:10:17

যদি জীবনকে দাবার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে খারাপ সূচনা হয়েছিল একটি বিরল রোগে আক্রান্ত সিয়ে হাইথাওয়ের।

২০০০ সালে জন্মগ্রহণকারী হাইথাও ১ বছর বয়সে স্পাইনাল মাসল অ্যাট্রোফি (এসএমএ) বা মেরুদণ্ডের পেশীর ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন। এটি একটি বিরল বংশগত রোগ। চীনে নবজাতকদের ৬ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে ১ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়। এসএমএ এখনও একটি দুরারোগ্য এক ব্যাধি। এ রোগ উপশম এবং শরীরের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদী ও মানসম্মত চিকিত্সা প্রয়োজন।

নিজের রোগ প্রসঙ্গে হাইথাও বলেন, “প্রথমে শুধু হোঁচট খেতাম। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটার সক্ষমতা হারাই। ওষুধ ও কিছু পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ ছাড়া অন্য কোনও বিশেষ ভাল চিকিত্সার ব্যবস্থা সেই সময়ে ছিল না। অসুস্থ হওয়ার পর আমার মা তাঁর চাকরি ছেড়ে বাড়িতে আমাকে দেখাশোনা করেছিলেন। সেই সময়ে আমার মায়ের জন্য এটি অবশ্যই একটি খুব কঠিন কাজ ছিল। আমার বাবা-মাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাত চাই। তাদের জন্য এটি সহজ ছিল না।”

২০১৬ সালের আগে বিশ্বের কোনও দেশ এসএমএ চিকিৎসায় কোনও লক্ষ্যযুক্ত ওষুধ তৈরি করতে পারেনি এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে তখনকার ‘রক্ষণশীল চিকিত্সা’ তেমন কার্যকর ছিলো না।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাইথাওর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। রোগের কারণে পেশীর ক্ষয় ও দুর্বলতা তাকে ধীরে ধীরে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ করে ফেলে এবং তিনি যে কাজগুলো স্বাধীনভাবে করতে পারতেন, তা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।

মানুষ বলে থাকে যে, ঈশ্বর যখন আপনার জন্য একটি দরজা বন্ধ করে দেন, তখন আপনার জন্য আরেকটি জানালা খুলেও দেন।

২০০৮ সালে, একটি ‘গো’ আগ্রহের ক্লাস চালু হয় এবং হাইথাও প্রথমবার দেখেই ‘গো’র প্রেমে পড়ে যান। তিনি বলেন, “এতে আমি বুঝতে করি, ‘গো’ এমন একটি খেলা, যেখানে সক্ষম শারীরিক মানুষের সাথে সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায়”

তাইথাওয়ের মা বলেন, “সে দাবা খেলতে পছন্দ করতো এবং আমরা তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি। যতক্ষণ সে সুস্থ ও সুখী থাকে, ততক্ষণ আমরাও ‍সুখী থাকি।”

পরিবারের সমর্থন হাইথাওকে কোনও চিন্তা ছাড়াই ‘গো’র জগতে নিজেকে নিমজ্জিত করার সুযোগ দেয়। আগ্রহের ক্লাস শেষ হওয়ার পর, তিনি নিজ উদ্যোগে বই পড়তে শুরু করেন।

ইন্টারনেটে দাবা খেলার সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও হাইথাও নেট ব্যবহারকারীদের সঙ্গে অনলাইনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দেড় বছর দাবা শেখার পর তিনি অপেশাদার পঞ্চম শ্রেণির সার্টিফিকেট পান।

আকস্মিক এক সুযোগে হাইথাওয়ের পরিচয় হয় ওয়াং ইউ হুই নামের একজন পেশাদার দাবা খেলোয়াড়ের সঙ্গে। হাইথাওয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানার পর ওয়াং ইউ হুই নিজের ফোন নম্বর ও ই-মেইল অ্যাড্রেস তাকে দেন এবং বিনামূল্যে তাকে দাবা খেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এভাবে তাদের দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ দশ বছর ধরে অনলাইনে ‘গো’ সম্পর্কিত আদান-প্রদান চলতে থাকে। শিক্ষক ওয়াং বাতিঘরের মতো হাইতাওয়ের অগ্রগতির দিকে গুরুত্ব দেন।

২০১৫ সালে ওয়াং ইউ হুই বেইজিংয়ে ‘গো’র অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি স্বীকার করেন, হাইথাও তার মধ্যে শিল্প সৃষ্টির উদ্দীপনা তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি যদি হাইথাওয়ের মতো সারা দেশে হাজার হাজার শিশুর মধ্যে যারা ভালোভাবে ‘গো’ শিখতে চায়, তাদের সাহায্য করতে চাই, তাহলে ইমেলের উপর নির্ভর করতে তা সম্ভব না। যদিও মনে হচ্ছে আমি হাইথাওকে সাহায্য করছি, আসলে আমরা একে অপরকে সাহায্য করছি।”

নিজের উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন ওয়াং ইউ হুই। প্রায়শই তিনি উপলব্ধি করতেন, তিনি আর ধরে রাখতে পারবেন না। তবে, তিনি হাইথাওয়ের কথা ভেবে পূর্ণ শক্তি ফিরে পান। কারণ হাইথাও একজন পেশাদার খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

ওয়াং ইউ হুই বলেন, “হাইথাও একজন সৈনিকের মতো। এমনকি যদি সে দাবার গুঁটি ধরতেও না পারে, যতক্ষণ সে ভাবতে পারে, সে দাবা ভাবনায় দাবাই খেলতে থাকবে। আমি যখন অসুবিধায় পড়ি, তখনও হাইথাওকে নিয়ে ভাবি। আমার অসুবিধার মানে কী? আমি প্রায়ই বলি যে, হাইথাও আমার আদর্শ ও আমার শিক্ষক। এটি কোনও ভদ্র শব্দ নয়। গত ১২ বছরে আমি সত্যিই তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।”

২০১৭ সালে হাইথাওয়ের অসুস্থতা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে, যার ফলে তিনি দাবার গুঁটি ধরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন এবং সেগুলো রাখতে অন্যদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় তার। শ্বাসকষ্ট ও পিঠে ব্যথা সাধারণ ব্যাপার।

শারীরিক অবস্থার অবনতি এই তরুণকে পরাজিত করতে পারেনি। হাইথাওয়ের কাছে গর্বের ব্যাপার হলো ১৮ বছর বয়সে তিনি অনলাইনে দাবা পাঠের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো টাকা উপার্জন করেন।

এ প্রসঙ্গে হাইথাও বলেন, “নিজের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারছি, এতে পরিবারের সবাই খুব খুশি। ছোটবেলা থেকেই তারা চিন্তিত যে, ভবিষ্যতে আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো। এখন আমার চাকরি আছে এবং শিক্ষকতা একটি সম্মানিত পেশা।”