ডিসেম্বর ১: চীনা জনগণের পুরনো বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ২৯ নভেম্বর মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ১০০ বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে খ্যাতিমান কূটনীতিক হিসেবে কিসিঞ্জার চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির মধ্যস্থতায় অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। কিসিঞ্জারের মৃত্যুতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এক শোক বার্তা পাঠিয়েছেন। শোক বার্তায় তিনি বলেন, কিসিঞ্জারের নাম সব সময় চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এবং ড. কিসিঞ্জারকে সব সময় চীনা জনগণ মনে রাখবে।
অনেক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, কিসিঞ্জার ছিলেন একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব যিনি একটি বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একজন পেশাগত কূটনীতিক হিসেবে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং সে স্বার্থের জন্য কাজ করেছিলেন। যাইহোক, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে, যতদিন সত্যিকারের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা থাকে ততদিন বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব হয়।
কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা উদ্ভূত বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে তার সঠিক উপলব্ধি থেকে। একজন ক্লাসিক বাস্তববাদী হিসেবে কিসিঞ্জার আদর্শগত কুসংস্কার অতিক্রম করে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অসহিষ্ণুতা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকারের জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞ কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফ ভাঙা নিঃসন্দেহে কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নজরকাড়া অর্জন। ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন এবং ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের ব্যবস্থা করতে চীনের সঙ্গে কাজ করেন। ফলে ‘প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে হ্যান্ডশেক’ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। বিগত ৫০ বছরে কিসিঞ্জার শতাধিক বার চীন সফর করেছেন এবং চীনা জনগণের ‘পুরনো বন্ধু’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এই বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং বেইজিংয়ে কিসিঞ্জারের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি সবেমাত্র তার শততম জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন প্রেসিডেন্ট সি।
কিসিঞ্জারের জীবনীকার ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক থমাস এ’ শোয়ার্টজের মতে, মার্কিন সরকারের কাছে কিসিঞ্জার যা নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল চীনকে বোঝা। এই বোঝাপড়া ছিল চীনা ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে। কিসিঞ্জার বিশ্বাস করতেন, চীনা সংস্কৃতিতে সম্প্রসারণবাদী প্রবণতা নেই, তবে এটি একটি চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী সমাজ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা।
বর্তমানে এমন একটি সময় চলছে যখন চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঞ্জারের মতো আরও রাজনীতিবিদ প্রয়োজন, যারা দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণ অতিক্রম করতে পারেন, চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে পারেন এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থ বিবেচনা করতে পারেন।
ড. কিসিঞ্জারের জীবন আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে। একজন আমেরিকান কূটনীতিক হিসেবে তিনি মার্কিন স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় গভীর জ্ঞান রাখতেন। তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়কালে মার্কিন কূটনীতিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বস্তুনিষ্ঠভাবে অবদান রাখে।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে চতুর্থ মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় ড. কিসিঞ্জার অল্প সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত করেছিলেন এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আঞ্চলিক দ্বন্দ্বগুলো যাতে বড় সঙ্কটে পরিণত না হয়, সেজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিসিঞ্জারের রেখে যাওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উত্তরাধিকার হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও স্মার্ট কূটনৈতিক কৌশল এসব পার্থক্য কাটিয়ে উঠতে পারে, একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা করে এবং পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জাস্যপূর্ণ বলে মনে করে সিএমজি সম্পাদকীয়।
লিলি/রহমান