চালু পথ না ধরে সঠিক পথে থাকুন; ঐতিহ্যকে সম্মান করুন, সেকেলে অভ্যাসকে নয়
2023-11-30 15:05:36

 

‘উদ্ভাবন’ আজ চীনে একটি বহুলব্যবহৃত শব্দ। ক্রিস-ক্রসিং হাই-স্পিড রেল নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী চিকিত্সা-প্রযুক্তি পর্যন্ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে চীন সবখানেই উপকৃত হয়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন - এই উদ্ভাবনী শক্তির পিছনে রহস্য কী?

আচ্ছা, এবার একসঙ্গে চায়না ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাবলিকেশন্স অ্যান্ড কালচারের কুয়াংচৌ শাখা গ্রন্থাগারে চলে যাবো এবং আমার নতুন বন্ধু ‘হংকং-০১’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পিকিং ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব নিউ স্ট্রাকচারাল ইকোনমিক্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মি. ইউ পিন হাইয়ের সাথে চীনা সভ্যতার উদ্ভাবন ও ক্রমবিকাশের কারণগুলো অন্বেষণ করবো।

উদ্ভাবন চীনা জীবনকে বদলে দিয়েছে। উদ্ভাবন কি সবসময়ই চীনা ইতিহাসের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল?

জবাবে মি.ইউ পিন হাই বলেন, আমরা চীনারা সব সময় উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের গুরুত্বকে মূল্যায়ন করি। তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে শাং রাজবংশের প্রথম সম্রাট থাং আসলে তার বাথটাবে একটি লাইন লিখে রেখেছিলেন যাতে সেটা তার মনে থাকে। লাইনটি হলো “গৌ রি সিন,রি রি সিন,ইউ রি সিন”। এর প্রকৃত অর্থ হলো আপনি যদি একদিনে খানিকটা উন্নতি করতে পারেন, তাহলে প্রতিদিন তা করবেন না কেন, যাতে আপনি অতীতে ইতিমধ্যে যা অর্জিত হয়েছে তার ভিত্তিতে উন্নতি করতে পারেন?

চীনের ইতিহাসে চীনা চরিত্রের উদ্ভাবন ও জনপ্রিয়তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রায় দু’হাজার বছর আগে হান রাজবংশের সময় আমরা কাগজ আবিস্কার করেছিলাম। পরবর্তীতে থাং রাজবংশের সময়ে আমরা কাঠের ব্লকের মাধ্যমে প্রিন্টিং প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করি।

প্রায় এক হাজার বছর আগে সোং রাজবংশের সময়ে বি শেং চলনযোগ্য টাইপিং উদ্ভাবন করেন। এরপর, চীনা অক্ষরের ব্যাপক প্রচলন হয়।

আমি সত্তরের দশকের শেষ দিকে ক্যানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতাম। আমি চীনা ভাষায় একটি কমিউনিটি সংবাদপত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু স্থানীয় প্রিন্টিং হাউস আমাকে কোনও সাহায্য করতে পারে না, কারণ তাদের সে ধরনের টাইপসেটিং ছিল না। ১৯৮০ সালে হংকংয়ে ফিরে আসার পর আমি পত্রিকায় কাজ নিই। তখনও তারা লেটারপ্রেস প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করত। এটি এই ধরনের টাইপসেটিংয়ের মতো।

আমিই প্রথম হংকংয়ে সংবাদপত্র প্রকাশে কম্পিউটার টাইপসেটিং প্রবর্তন করি। এটি কেবল ব্যাপকভাবে কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করেনি, বরং এটি কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে চীনা চরিত্র নির্মাণের সংমিশ্রণের শুরু।

উদ্ভাবন হলো মহা বিমূর্ত ধারণা এবং এর ব্যবহারিক ও ডাটা ব্যবহারের সম্মিলন।

যখন আমরা উদ্ভাবন সম্পর্কে কথা বলি, তখন সেটা কেবল বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের কথা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি, উদ্ভাবন সবসময়ই নানা ক্ষেত্রে চীনের ওপর প্রভাব ফেলে থাকে। চীনের উন্নয়নের সাথে সাথে উদ্ভাবনের চেতনা উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু কীভাবে আমরা এটিকে আরও ব্যাপকভাবে বুঝতে পারবো?

জবাবে মি.ইউ পিন হাই বলেন, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, ‘বুক অব ওয়েইতে’  প্রথমবারের মতো উদ্ভাবন বা ‘ছুয়াং সিন’ শব্দটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মূল বাণী হলো আমাদের সব খারাপ জিনিস ত্যাগ করা উচিত এবং আমাদের দেশ শাসনের একটি নতুন ও উদ্ভাবনী উপায় ক্রমাগত খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা করা উচিত।

আমি আপনাকে একটি সমসাময়িক উদাহরণ দিতে পারি। আমি নিশ্চিত যে, আপনি নিশ্চয়ই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিসির প্রস্তাবিত এক দেশ দুই ব্যবস্থার কথা শুনেছেন। এটি একটি খুব উদ্ভাবনী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, কারণ অতীতে এমন কিছু ছিল না।

এই ব্যবস্থায় হংকং ও ম্যাকাও মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এবং আগের ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে এটাকে গ্রহণ করা হয়। হংকং ও ম্যাকাওয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুন্দর সমন্বয় হয়েছে। আর এটাই উদ্ভাবন।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা হংকংয়ে। হংকং মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করেছি যে, হংকংবাসীরা কীভাবে নিজেদের মালিক হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার ‘দ্বৈত প্রচলন’, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং কুয়াংতোং-হংকং-ম্যাকাও গ্রেটার বে এরিয়া স্ট্যাটেজি প্রবর্তন করেছে। এক দেশ দুই ব্যবস্থার কারণে  হংকং সুষ্ঠুভাবে এসব উদ্ভাবনী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারে এবং এসব ব্যবস্থা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে।

আমরা চীনের উন্নয়ন দেখেছি। কিন্তু আজকে চীনের উন্নয়নের পথে চীনা সভ্যতার উদ্ভাবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব কী বলে আপনি মনে করেন?

জবাবে মি.ইউ পিন হাই বলেন, চীন ছিল কৃষিভিত্তিক একটি সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। ছিং রাজবংশের শেষ দিকে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে চীন পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করে। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় যে, শহরের সর্বহারা ও শ্রমিক কারা এবং তারা কীভাবে এ ব্যবস্থায় যোগ দেয়। আমরা কৃষকদের অনেক বেশি বুঝতে পারি। তাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, মার্কসবাদ আমাদের দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

কিন্তু বিগত ৪০ বা ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে,চীনের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য অর্থাৎ চীনা সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ঐতিহ্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চীনা ঐতিহ্যের চিন্তাধারা ও মার্কসবাদী চিন্তাধারার মধ্যে অনেক মিল আছে। শুধু তাই নয়, মার্কসবাদী চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে আমাদের সমাজ ও আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে খুব ভালোভাবে সংমিশ্রত হয়েছে।

এখন আমরা চীনের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য ও মার্কসবাদ অর্থাৎ চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মার্কসবাদের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে এটা বুঝেছি। আমি বিশ্বাস করি যে, এটি আধুনিক চীনে অর্জিত সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।

এই উদ্ভাবন ঘটলেই চীন আধুনিক দেশে পরিণত হতে পারতো। আর এটাই আজ ঘটছে।

আমরা এখনই চীনের উপর এর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি এবং এমন প্রভাব এখনও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটা বিশ্বে কি নিয়ে আসে?

জবাবে মি.ইউ পিন হাই বলেন, আমি মনে করি, আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, প্রতিটি দেশ ও প্রতিটি জাতির সামনে এগিয়ে যাওয়ার নিজস্ব পথ থাকবে। আমরা অন্যদের কাছ থেকে শিখতে পারি, কিন্তু তা হুবহু নকল করতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা দেশগুলো আর্থিক সমস্যায় অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে তাদের অনেক অসুবিধা রয়েছে। কেন? আমি মনে করি, এগুলোর কারণ তাদের দেশ শাসনের পদ্ধতি সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। তাদের যা করা উচিত তা হলো নিজ নিজ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা, অন্য দেশের ওপর উত্পীড়ন না করা। তাদের নিজস্ব ধারণাটিকে প্রভাবশালী ধারণা বলে মনে করা উচিত না।

প্রতিটি দেশের উন্নয়নের নিজস্ব পথ থাকতে হবে। আমরা অন্য দেশের ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিই না, কারণ ধারণা রপ্তানি করা একটি খুব কঠিন ব্যাপার। আমাদের সকলেরই আলাদা সংস্কৃতি আছে, আমাদের সকলের আলাদা ইতিহাস আছে, আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিও আলাদা।

তাই আমি মনে করি,সব সময় অভিযোজনযোগ্যতা ও অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে সচেতন থাকুন, নতুন ধারণার প্রতি উন্মুক্ত থাকুন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণা করুন। আমি মনে করি, সবাই জানে কীভাবে উদ্ভাবনী হতে হয়। যতক্ষণ আপনি নিজেকে গোঁড়ামিতে আটকাবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও আমদানিকৃত চিন্তাধারায় সীমাবদ্ধ নিজে সীমাবদ্ধ হবেন না।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার উদ্ভাবনী চরিত্র চীনা জাতির হাজার হাজার বছর ধরে স্থায়ী একটি মহান সভ্যতা তৈরি ও গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।

বিশ্ব আজ ক্রমাগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং চীন এই প্রবণতার অগ্রভাগে রয়েছে। যেমনটি আমরা উপরে আলোচনা করলাম, উদ্ভাবন সবসময়ই সভ্যতার অগ্রগতির পূর্বশর্ত এবং বিশ্বের অগ্রগতির চালিকাশক্তি।

লিলি/রহমান