চার স্বাদের কুই চৌ প্রদেশ
2023-11-29 10:15:38

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের অন্তর্দেশীয় প্রদেশ কুই চৌয়ে কোনও সমতল ছিলনা। সেখানে ৮ ভাগ পাহাড়,এক ভাগ পানি আর এক ভাগ চাষের জমি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুই চৌ প্রদেশ নিজের বিশেষ ভৌগলিক অবস্থা অনুযায়ী চা, মরিচ, কাঁটাযুক্ত নাশপাতি ও ব্লুবেরিসহ বেশ কয়েকটি বৈশ্টষ্যময় কৃষিশিল্প উন্নয়ন করেছে এবং এ কয়েকটি শিল্প চীনের শীর্ষ স্থানে রয়েছে।

 

টক কাঁটাযুক্ত নাশপাতি, মিষ্টি ব্লু বেরি, চায়ের সুগন্ধ ও ঝাল মরিচ - এ চার ধরনের স্বাদ কুচৌকে চিত্রিত করে। কুই চৌয়ে ৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় চা, ৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচ, ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরে কাঁটাযুক্ত নাশপাতি ও ১৪ হাজার হেক্টরে ব্লুবেরি। এ চার ধরনের কৃষিপণ্য উত্পাদনের পরিমাণ চীনে বৃহত্তম এবং বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।

 

কুই চৌ প্রদেশের শিল্পের উন্নয়ন ও সলফতার রহস্য কী? কুই চৌর অনুর্বর জমি বড় আকারের কৃষির জন্য উপযোগী নয়। তবে তার অনেক প্রকৃতিগত সুবিধাও আছে। যেমন সেখানকার জলবায়ু আর্দ্র, গাছপালা সমৃদ্ধ, মাটি পরিষ্কার এবং বায়ুও ভাল। এসব সবুজ কৃষি ও ইকো কৃষি উন্নয়নের জন্য সুবিধাজনক।

 

কাঁটাযুক্ত নাশপাতি নাম থেকে বোঝা যায়, এই ফলটি কাঁটায় ঢাকা থাকে। এর রস খেতে টক ও একটু মিষ্টি। পাহাড়ি অঞ্চলের এ বন্য ফল আগে কেউ নিত না। কুই চৌ চীনে প্রথম বারের মতো এ শিল্পের চেইন তৈরি করেছে। ২০২২ সালে কাঁটাযুক্ত নাশপাতি শিল্পের বাজার দেড় হাজার কোটি ইউয়ানে পৌঁছায় এবং এ বন্য ফল বিখ্যাত ফলে পরিণত হয়।

 

কুই চৌ চিয়া সি গ্রামের বাসিন্দা রেন কুয়াং ওয়ে বলেন,আগে কেউ এ ফল চাষ করতো না এবং খেত না। কেবল কিছু মানুষ এ ফল দিয়ে ওয়াইন তৈরি করতো। পুষ্টিবিদ অধ্যাপক লুও তেং ই গবেষণা করে আবিষ্কার করেন যে, কাঁটাযুক্ত নাশপাতিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে এবং তার গবেষণার কারণে কাঁটাযুক্ত নাশপাতি বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে কুই চৌয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কাঁটাযুক্ত নাশপাতি গবেষণা কমিটি এবং ২০১৮ সালে কাঁটাযুক্ত নাশপাতিকে কুইচৌর ১২টি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

 

কুই চৌ প্রদেশের লুং লি জেলা কাঁটাযুক্ত নাশপাতি চাষের বড় একটি জেলা। ২০১২ সালে সেটি কাঁটাযুক্ত নাশপাতির জেলা হিসাবে খ্যাতি পায়। ফুল ফোটার সময় এখানে অনেক পর্যটক ফুল উপভোগ করতে আসেন এবং কাঁটাযুক্ত নাশপাতির ফুল, ফল, পাতা ও বীজ ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এমনকি তার শিকড় ও ছালেরও ঔষধি গুণ রয়েছে।

কাঁটাযুক্ত নাশপাতির জন্য কুই চৌর প্রাকৃতিক পরিবেশ সবচেয়ে উপযোগী এবং এখন অনেক দেশ কাঁটাযুক্ত নাশপাতির ব্যাপারে আগ্রহী। তারা প্রতি বছর এখান থেকে প্রচুর কাঁটাযুক্ত নাশপাতি রস আমদারি করে।

 

অন্য দিকে, মিষ্টি ব্লুবেরিও কুই চৌর বিখ্যাত একটি কৃষিপণ্য। এটি ফলের রানি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে ব্লুবেরি চাষ হয় আর চীনে এ ফলের আওতাধীন জমির আয়তন সবচেয়ে বেশি এবং চীনে বৃহত্তম ব্লুবেরি চাষের কেন্দ্র কুইচৌয়ে। সাধারণ ফল ও সবজির তুলনায় ব্লুবেরি অ্যান্থোসায়ানিন পরিমাণ ৪-৮ গুণ বেশি এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ব্লুবেরিকে ৫টি স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দক্ষিণ চীনের প্রথম ব্লুবেরি চাষকেন্দ্র কুইচৌয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কুইচৌয়ের ব্লুবেরি শিল্পের বয়স প্রায় ২০ বছর হয়েছে। কুই চৌর আবহাওয়া ও পরিবেশ ব্লুবেরির চাষের জন্যও ভাল এবং অনেক উন্নত প্রজননের মাধ্যমে স্থানীয় বেশিষ্ট্যের ব্লুবেরি তৈরি হয়েছে।

মা চিয়াং জেলা হলো ব্লুবেরি চাষের বড় একটি জেলা। স্থানীয় বাসিন্দা ইউয়াও জাতির নারী লং সুন লিয়ান এখন একটি ব্লুবেরি প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিতে কাজ করেন। এ কোম্পানি ব্লুবেরি জ্যাম, শুকনো ব্লবেরিসহ ৬ ধরনের পণ্য উত্পাদন করে। লং সুন লিয়ান এখন প্রতি মাসে ৩২০০ ইউয়ান বেতন পান। মা চিয়াং জেলায় ব্লুবেরি চাষের আওতাধীন ৫৭০০ হেক্টর জমি এবং ৩ হাজারের বেশি মানুষ এ শিল্প থেকে উপকৃত হয়েছে। বর্তমানে কুই চৌয়ে ব্লুবেরি সংশ্লিষ্ট শিল্পে জড়িত আছেন ১ লাখের বেশি মানুষ এবং প্রতি বছর উত্পাদন পরিমাণ ১০০ কোটি ইউয়ানের বেশি।

 

কুই চৌয়ে যেখানে সেখানে চায়ের সুগন্ধ পাওয়া যায়। কুই চৌ চীনের একমাত্র চা চাষ এলাকা, যেখানে উচ্চতা বেশি, রোদ কম, মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা বেশি। এখানে উচ্চ মানের গ্রিন টি উত্পাদিত হয়। মেই থান জেলা চীনের ১০০টি শক্তিশালী চা শিল্প জেলার মধ্যে প্রথম এবং ১৯৩৯ সালে চীনের প্রথম পরীক্ষামূলক চা কারখানা এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আধুনিক চা শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠে। মেই থান একসময় চীনের ৮টি বৃহত্তম চা রপ্তানি কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম ছিল।

কুই চৌয়ে এখন ৫টি চা শিল্প এলাকা রয়েছে এবং চা চাষের অধীন এলাকার পরিমাণ ৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরেরও বেশি। এর মধ্যে তিনটি জেলার চাষ-এলাকার আয়তন ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি। ২০২২ সালে কুইচৌয়ে চা উত্পাদনের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ টন এবং শিল্পের আকার ৬০ বিলিয়ান ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। ভরা মৌসুমে একজন কর্মী এক কেজি চা পাতা নিলে ৩২ ইউয়ান নিতে পারেন এবং প্রতিদিন ৫ কেজি নিতে পারেন। মেই থান জেলার বাসিন্দা সিং সি হুয়া আধা হেক্টর জমিতে চা চাষ করেন এবং তার চা প্রতি কেজির দাম হতে পারে ১২০ ইউয়ান। চার ঋতুতে তিনি ৪০ হাজার ইউয়ান উপার্জন করতে পারেন।

চিয়াং খৌজেলা চীনের ম্যাচা নগর এবং বিশ্বের ম্যাচা সুপার কারখানা। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যাচা কারখানা এখানে অবস্থিত। এখানে প্রতিবছর ৪ হাজার টন ম্যাচা উত্পাদিত হয় এবং ১ লাখের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

 

অবশেষে ঝাল স্বাদের মরিচের কথা বলি। কুই চৌর মানুষ মরিচ খেতে অনেক পছন্দ করে তারা প্রায় প্রতিদিন মরিচ খায়। এমনকি মরিচ ছাড়া কুইচৌ খাবারই হয় না।

প্রতিদিন সকালে স্থানীয়রা বাটি মাটন রাইস নুডলস খায় আর তাদের কাছে মরিচ মাটনের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ। কুইচৌয়ে মরিচ খাবার ইতিহাস ৪০০ বছরের প্রাচীন। প্রাচীনকালে স্থানীয় মানুষেরা লবণের বদলে মরিচ খেত বলে মরিচ খাবার অভ্যেস তৈরি হয়েছে।

কুই চৌ প্রদেশের চুন ই শহরে জাতীয় পর্যায়ের একটি মরিচ বাজার আছে। ৩ লাখ বর্গমিটারের এ বাজারে প্রতিবছর সাড়ে ৭ লাখ টন মরিচ ক্রয়-বিক্রয় হয়।

এখানে স্থানীয় মরিচ ছাড়া অন্য জায়গার মরিচও বিক্রি হয়; এমনকি বিদেশের মরিচ, যেমন ভারত, মিয়ানমার ও দক্ষিণ কোরিয়ার মরিচ। চীনের একমাত্র জাতীয় পর্যায়ের মরিচ বাজার হিসেবে এখানেই দেশের মরিচের দাম নির্ধারণ হয়। বিভিন্ন জায়গা কুই চৌ মরিচের দাম অনুযায়ী নিজেদের দাম ঠিক করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে কুই চৌয়ে মরিচ-চাষ এলাকার আয়তন ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরেরও বেশি এবং চীনের বৃহত্তম মরিচ-চাষ এলাকা। বিশ্বের মরিচ-চাষ এলাকার দশ ভাগের এক ভাগ এবং চীনের ছয় ভাগের এক ভাগ কুইচৌয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুই চৌর মরিচ উত্পাদনের পরিমাণ ৭৮ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে এবং বার্ষিক উত্পাদন পরিমাণ ২৭ বিলিয়ান ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

 

তাছাড়া, কুই চৌর মরিচ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিও চীনের মধ্যে শীর্ষে। কুই চৌয়ে বড় আকারের মরিচ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ৩০০টির বেশি এবং দেশ-বিদেশে তাদের পণ্য বিক্রি হয়।

 

টক,মিষ্টি, সুগন্ধ ও ঝাল - চারটি স্বাদের কুই চৌ আপনার কেমন লাগলো? সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই কুই চৌয়ে ভ্রমণ আসবেন।(শিশির/রহমান/রুবি)