নভেম্বর ২৮: চার বছরেরও বেশি সময় পর আবার বৈঠকে বসলেন চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ। ২৬ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অনুষ্ঠিত ১০তম চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে তিনটি দেশ ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও গভীর করার বিষয়ে ধারাবাহিক ঐক্যমতে পৌঁছায় এবং অভিন্ন স্বার্থজড়িত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে মতবিনিময় করে। জনমত বলছে যে, এবার ত্রিপক্ষীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের পরবর্তী পর্বের বৈঠকের পূর্বশর্ত ও পরিবেশ তৈরি করেছে।
“প্রতিবেশীদের দূরে সরানো যায় না”, এটাই হলো উল্লেখিত তিনটি দেশের প্রকৃত বাস্তবতা। ১৯৯৯ সালে চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতার ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধাপে ধাপে এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থায় পরিণত হয় এবং উপরোক্ত তিন দেশসহ এশিয়ার আধুনিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি যুগিয়েছে।
বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্যাটার্নে গভীর পরিবর্তন ঘটেছে। এ অঞ্চলের বাইরের কিছু বড় দেশ তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এশিয়ায় সংঘাত ও বিভাজন উস্কে দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা এবং নেতাদের বৈঠকের ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ‘স্থগিত’ করা হয়। পর্যবেক্ষকরা উল্লেখ করেন যে, সম্প্রতি সানফ্রান্সিসকো বৈঠকে চীন ও মার্কিন শীর্ষনেতাদের অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ মতৈক্য চীন-জাপান এবং চীন-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগের পরিবেশ তৈরি করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মন্থর এবং চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাস্তব সহযোগিতা গভীর করার পাশাপাশি শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। এসব কারণে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্চ-স্তরের যোগাযোগ পুনরায় চালু করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীল, পারস্পরিক উপকারী এবং জয়-জয় সম্পর্ক রয়েছে। তিনটি দেশের মোট জনসংখ্যা এবং জিডিপি পূর্ব এশিয়ায় যথাক্রমে আনুমানিক ৭০ ও ৯০ শতাংশ; তিনটি দেশ একে-অপরের শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিপূরকতা এবং উচ্চ শিল্প একীকরণ-সহ একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার, তিনটি দেশ দৃঢ়ভাবে বহুপক্ষীয় মতবাদ এবং অবাধ বাণিজ্যকে সমর্থন করে। দীর্ঘদিন ধরে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। ২০২২ সালে চীন ও জাপান এবং চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩৫৭.৪ বিলিয়ন এবং ৩৬২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতা তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক মহল এবং জনগণকে বিশাল ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। পাশাপাশি, আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
এবারের বৈঠকে চীন ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করে চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার আলোচনা গভীর করতে ৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এসব প্রস্তাবের বিষয় আর্থ-বাণিজ্যিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং টেকসই উন্নয়নসহ নানা বিষয় জড়িত এবং তা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।
চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে মতভেদ থাকা খুব স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক চেতনা মেনে চলা এবং সহযোগিতার সামগ্রিক পরিস্থিতির মাধ্যমে মতভেদের প্রতিরোধ করা।
এবারের বৈঠকে চীন কিছু নীতিগত ইস্যু উত্থাপন করেছে। যেমন, নিজ নিজ উন্নয়নের পথ এবং কেন্দ্রীয় স্বার্থকে সম্মান করা এবং সঠিকভাবে সমস্যার সমাধান করা উচিত্, আদর্শিক দেয়াল দিয়ে বিরোধিতা করা এবং জোটগত আঞ্চলিক সহযোগিতার গঠন প্রতিরোধ করা উচিত্।
২০ বছর আগে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করে। এতে বলা হয় যে, তিন পক্ষের সহযোগিতার উদ্দেশ্য উন্নয়নকে বেগবান করা, পূর্ব এশিয়ার সহযোগিতা জোরালো করা এবং আঞ্চলিক ও বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি রক্ষা করা। এটাই তিনটি দেশের সহযোগিতার আসল উদ্দেশ্য। শতাব্দীর পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া হলো প্রতিবেশী দেশ, যারা কাছাকাছি থাকা এবং অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া আরো বেশি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন দেখিয়ে চীনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে এবং তিনটি দেশের সহযোগিতার ক্রমাগত উন্নয়ন বেগবান করবে বলে আশা করে চীন।
লিলি/তৌহিদ/রুবি