চীনা নভোচারীরা যেভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন
2023-11-27 14:50:42

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের মহাকাশ গবেষণা ও অনুসন্ধানে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে চীনা গণমুক্তি ফৌজের নভোচারী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ১৫০০ জনেরও বেশি শ্রেষ্ঠ বিমানচালকের মধ্য থেকে প্রথম দফায় ১৪ জনকে বেছে নেওয়া হয় নভোচারী হিসেবে। ৫ বছরের প্রশিক্ষণের পর, তাঁরা চীনা নভোচারী হিসেবে মহাকাশ গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজে যোগ দেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনা নভোচারীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

 

নভোচারী বেছে নেওয়ার সময় তাদের শারীরিক অবস্থার পর্যালোচনা ও পরীক্ষা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক কঠোর। শারীরিক পরীক্ষায় পাস হলে আরও অনেক জটিল ও পরিশ্রমের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একজন উপযুক্ত নভোচারী হতে হয়। মানবজাতির মহাশূন্য যাত্রায় নভোচারীদের ভুমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য কেবল শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান শরীর আর স্থিতিশীল মানসিক যোগ্যতা দরকার তা নয়, বরং মহাশূন্যের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে দীর্ঘকাল ধরে কঠোর প্রশিক্ষণও গ্রহণ করতে হয়।

 

চীনা নভোচারীদের জন্য এ প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল। ২০০৩ সালে চীনের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে প্রথম নভোচারী ইয়াং লি ওয়েই সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে পৌঁছান। তখন থেকে চীনের মানববাহী নভোযানের উন্নয়নকাজ দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। তারপর ফেই জুন লং, নিয়ে হাই শেং, লিউ ইয়াং আর ওয়াং ইয়া পিংসহ মোট ১৮ জন চীনা নভোচারী সফলভাবে মহাশূন্যে যাত্রা সম্পন্ন করেন। তাঁরা চীনাদের মহাশূন্য স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবদান রেখেছেন।

 

২০১০ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দফার ৭ জন নভোচারী পদপ্রার্থী বেছে নেওয়া হয় এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৃতীয় দফার ১৮ জন নভোচারী নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে চতুর্থ দফার নভোচারীদের বাছাইয়ের কাজ চলছে।

 

প্রথম নভোচারী ইয়াং লি ওয়েই তাঁর প্রশিক্ষণ কোর্স স্মরণ করে বলেন যে, যদিও বিভিন্ন ধরনের জীবন রক্ষামূলক ব্যবস্থা রয়েছে, তবে মহাশূন্যের পরিবেশ উচ্চ বিকিরণ ও তাপমাত্রার ব্যাপক ব্যবধানের জায়গা, তাই নভোচারীরা বহু প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তার সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়ে ওঠেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক মহাশূন্যসম্পর্কিত জ্ঞানও অর্জন করতে হয়। মোট ১৩টি বিভাগে ৫০ ধরনেরও বেশি কোর্স রয়েছে। এটা যেন আরেকটি স্নাতক ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন। তার দৃষ্টিতে, নভোচারীদের প্রশিক্ষণ বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।

 

আরেকটি ব্যাপার হল কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ হলেও সফলভাবে মহাশূন্যে যাত্রা করা নিশ্চিত নয়, এর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়। প্রতিবার মহাশূন্য যাত্রার চাহিদা এবং নভোচারীদের প্রশিক্ষণ অবস্থা বিবেচনা করে জটিল প্রক্রিয়ায় উপযোগী নভোচারীদের ঠিক করা সম্ভব। তবে প্রত্যেক যাত্রার সময়ের ফাঁকা সময় তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই নভোচারীদের সাধারণত বহু বছর ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। তাদের দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা মহাশূন্য কর্তব্যের প্রতি তাঁদের আবেগ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নভোচারী লিউ ওয়াং টানা ১৪ বছর, চাং সিয়াও কুয়াং টানা ১৫ বছর অপেক্ষা করেছেন এবং নভোচারী তেং ছিং মিং মোট ২৪ বছর ১০ মাস পর এ সুযোগ পেয়েছেন।

 

১৯৯৮ সালে যখন চীনা নভোচারীদের দল গঠিত হয়, তখন তেং ছিং মিং প্রথম দফার পদপ্রার্থী ছিলেন। তখন তিনি ভাবতে পারেননি যে, তাঁর মহাশূন্য স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তবে, একজন উপযোগী নভোচারীতে পরিণত হওয়া বেশ সহজ ব্যাপার নয়। টানা ২০ বছরের বহু প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি। প্রতিবার আবদেন করেন, কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি চেষ্টা পরিত্যাগ না করে, দৈনিক প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়া চালিয়ে যান, নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা উন্নত করার চেষ্টা করতে থাকে। অবশেষে, ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর মহাশূন্য যাত্রার সুযোগ পান তেং। তিনি শেনচৌ ১৫ নভোযানের একজন নভোচারী নির্বাচিত হন। চলতি বছর তাঁর বয়স ৫৬ বছর হয়েছে। সারা জীবনের প্রচেষ্টায় মহাশূন্যের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার।

 

স্বপ্ন প্রত্যেক নভোচারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে নভোচারী লিউ পো মিং বলেন, স্কুলে পরিশ্রমের সাথে পড়াশোনা কেবল জীবনযাপনের জন্য নয়, প্রত্যেকের মনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যও। নারী নভোচারী ওয়াং ইয়া পিং বলেন, স্বপ্ন যেন মহাশূন্যের তারা, দেখে মনে হবে বেশ দূরে, তবে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে একদিন তাকে স্পর্শ করা সম্ভব।

 

যুব নভোচারীদের মধ্যে অনেকে ইয়াং লি ওয়েইকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। তারা ইয়াংয়ের মতো মহাশূন্যে যাত্রা সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন এবং নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়নে প্রয়াস চালান।

 

এসব নভোচারী গড়ে ১০ বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মহাশূন্যে যাওয়ার সুযোগ পান। তাদের অপেক্ষা থেকে বোঝা যায় নভোযানের কর্তব্য কতোটা জটিল ও গম্ভীর। গত ২০ বছরে চীনে মোট ১৮ জন নভোচারীকে মহাশূন্যে পাঠানো হয় এবং তাদের গড় বয়স ৪১ বছর। তাদের মধ্যে দু’জন নারীও রয়েছেন।

 

শেনচৌ ১৬ নভোযানে মোট ৩ জন নভোচারী রয়েছেন। তাদের ডাক নাম ‘ডক্টর ক্রু দল’। নভোচারী চু ইয়াং চু চীনের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন, যিনি চীনের প্রথম মহাকাশ ফ্লাইট প্রকৌশলী। তাঁর সাথে আরও দু’জন নভোচারী মহাকেন্দ্র চালুর পর প্রথম মানববাহী যাত্রা সম্পন্ন করেন এবং মহাশূন্যে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগত পরীক্ষাও করেন।

 

শেনচৌ-১৬ নভোযানে আরেকজন নভোচারী কুই হাই ছাও চীনের মহাকাশেকেন্দ্রের প্রথম পেলোড বিশেষজ্ঞ, যিনি কেবল পেইহাং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নয়, বরং চীনের প্রথম অসৈনিক নভোচারী, যিনি চশমাও পড়েন। তাঁর গল্প অনেক সাধারণ মানুষকে উত্সাহিত করতে পারে।

 

চীনা নভোচারীদের জীবনকাহিনী সম্পর্কে জানতে গিয়ে জেনেছি যে, নিয়ে হাই শেংয়ের পরিবার অনেক দরিদ্র। তবে, গণিতে তিনি খুব ভালো ছিলেন। তার বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির ওপর ভিত্তি করে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ নভোচারীতে পরিণত হন। লিউ ওয়াং ছোটবেলা থেকে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডক্টরেট স্নাতক শিক্ষার্থী লিউ ইয়াং নারীর সহনশীলতা ও আন্তরিকতায় চীনের মহাশূন্য কার্যক্রমে বিশেষ ভুমিকা পালন করে থাকেন।

 

২০০৩ সালে চীনের প্রথম শেনচৌ-৫ নভোযান সাফল্যের সঙ্গে মহাশূন্যে যাত্রা করে। গত ২০ বছরে চীনের নভোচারী দল প্রায় শূন্য থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। চীনা নভোচারীরা মহাশূন্য কর্তব্যের স্বাক্ষী এবং চীনা মহাশূন্য স্বপ্নের অনুশীলনকারী।

 

বাচ্চাদের পড়াশোনা প্রসঙ্গে

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি আইনের খসড়া প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, প্রিস্কুল পর্যায়ে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় বাচ্চাদের পড়ানো হবে না, তাদের বয়সের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ জ্ঞান ও তথ্য দিতে হয়। তবে কোনো কোনো পিতামাতা মনে করেন, কেবল অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আরও আগে বিভিন্ন জ্ঞান আয়ত্ব করা বাচ্চার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। কোনো কোনো পিতামাতা বলেন যে, যদিও বর্তমানে চীনের প্রাথমিক স্কুলে শূন্য থেকে শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে অনেক বাচ্চা স্কুলে ভর্তির আগেই লেখাপড়া শুরু করে। যারা অন্যদের চেয়ে আগে স্কুলের বিষয় শিখতে পেরেছে, তাদের জন্য স্কুলের পড়াশোনা শুরুর দিকে সহজতর হয়। ফলে অনেক বাচ্চার বাবা-মা প্রিস্কুল পর্যায় থেকে চীনা ভাষা, গণিত ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন অতিরিক্ত ক্লাসে যোগ দিতে নিজেদের বাচ্চাদের উত্সাহ দেন বা বলতে গেলে বাধ্য করেন।

 

তবে, এমন পদ্ধতি কি বাচ্চাদের জন্য ভালো? এ নিয়ে একটি খবরে দেখা গেছে, চীনের উহান শহরের একজন বাচ্চা ৫ বছরের মধ্যে ১.২ লাখ ইউয়ান খরচ করে মোট ১৭টি বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়েছে। যখন এ ছেলে ৫ বছর বয়সের তখন সে প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর সব কোর্স সম্পন্ন করে ফেলে এবং ইংরেজি পরীক্ষায় চমত্কার স্কোর করে। তবে, অতিরিক্ত ক্লাস থাকায় সে প্রতি সপ্তাহে মাত্র অর্ধেক দিন ছুটি কাটাতে পারে এবং প্রতিদিন রাত ৯টায় তাকে বাসায় ফিরতে হয়। প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে তার পরীক্ষার ফলাফল বেশ ভালো। তবে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ক্লাসে সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারাতে থাকে সে এবং কখনই বাড়ির কাজ শেষ করতে পারে না। তার মা বাচ্চাকে শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিমান বাচ্চা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু সে শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।

 

এ গল্প শুনতে একটু আলাদা, তবে সেটি অতিরিক্ত ক্লাসের ক্ষতির প্রতিফলন। যদি বাচ্চারা অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে নতুন জ্ঞান জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাদের মানসিক সমস্যা ঘটবে এবং এসব সমস্যা বাচ্চার স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। কিছু কিছু বাচ্চা অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পেয়েছে, সমবয়সের বাচ্চার চেয়ে অনেক আগে উচ্চবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, তবে তারা বড় হওয়ার পর অনেকের মধ্যে চারিত্রিক দুর্বলতা বা মানসিক সমস্যা দেখা গেছে।

 

তাই বলা যায়, লেখাপড়ায় দক্ষতার চর্চা জ্ঞানের পরিমাণের  চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে লেখাপড়ায় দক্ষতা এবং জ্ঞান অর্জনের পরিমাণ একই ব্যাপার নয়। মানুষের মাথার উন্নয়ন নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা অনুসরণ করে। যখন প্রিস্কুল পর্যায়ে বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বিকশিত হয়নি, তখন তাদের চেতনা, স্মৃতি ও বোঝায় কিছু দুর্বলতা থেকে যায়। অনেক ছোট বয়সের বাচ্চার অতিরিক্ত পড়াশোনার মূল বিষয় মুখস্ত করা। তবে দীর্ঘকাল ধরে এটা  বাচ্চাকে ব্যাপক মানসিক চাপের সম্মুখীন করে। তারা পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

 

লন্ডনে আয়োজিত এক ফোরামে বিশেষজ্ঞরা জানান, ৩ বছর বয়সের আগে বাচ্চার বুদ্ধি বিকাশের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়। এ সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হবার আগ্রহ গড়ে তোলা আরও বেশি জরুরি। বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে শেখার আগ্রহ তৈরি সহজ। বাচ্চার সাথে পার্কে গাছপাতা সংগ্রহ করা, কার্টুন চলচ্চিত্র দেখা, বিভিন্ন খেলাধুলার পদ্ধতি শেখা ভালো। এসব অভিজ্ঞতা থেকে বাচ্চারা বিশ্ব অনুসন্ধানে আগ্রহী হবে।

 

বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা তার জীবনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। তাই ছোটবেলা থেকে যথেষ্ঠ খেলাধুলার সময় পাওয়া বাচ্চার চরিত্রের ওপর আরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে পরে নতুন জিনিস ও প্রযুক্তি গ্রহণ তাদের জন্য সহজতর হয়।

 

মোদ্দাকথা, স্বাধীন চিন্তাভাবনা, সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা, আত্মপ্রকাশ, ও নিজে নিজে লেখাপড়ার আগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ের ওপর পিতামাতার উচিত মনোযোগ দেওয়া।

 

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)