উত্তর-পশ্চিম চীনের একটি প্রাদেশিক-স্তরের অঞ্চল সিনচিয়াং- যেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্থলবন্দর রয়েছে।
হরকোস, আলাসানকৌ, খুনচেরাব, থরোকার্ট, ইরকেশতাম - সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্টের এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো চীন এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এবং এর বাইরেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিনিময়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে। সিনচিয়াং পাইলট মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের সাম্প্রতিক উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে এই বন্দরগুলো চীনের পশ্চিমমুখী উন্মুক্তকরণে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।
দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ে খুনচেরাব পাস- চীন-পাকিস্তান সীমান্তের একটি স্থলবন্দর, যেখানে গড় উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ৭০০ মিটার। এটি দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার।
পাকিস্তানি একজন ব্যবসায়ী হোসেন বাসিত এ বন্দর দিয়ে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকেন। তিনি বহু বছর ধরে পাকিস্তানি ভোক্তাদেরকে তাদের পছন্দের চীনা জিনিসপত্র যেমন কাপড়, বিছানার চাদর এবং গৃহস্থালির যন্ত্রপাতির যোগান দিচ্ছেন।
বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সন্তোষ প্রকাশ করেন বাসিত। তিনি জানান, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সহজ হওয়ায় এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় তিনি এখন আগের চেয়ে বেশি চীনে আসছেন পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য।
বাসিতের মতো সহজে সীমান্ত অতিক্রমের বিষয়টি অন্য ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারীদেরও জানা রয়েছে। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল যাত্রী শুল্ক ছাড়পত্র পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে, খুনচেরাব পাস দিয়ে ৪০ হাজারের বেশি অভ্যন্তরীণ এবং বহির্গামী যাত্রী রেকর্ড করা হয়েছে।
সিনচিয়াং শুল্ক ছাড়পত্রের দক্ষতা উন্নত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এ বছরের ১৪ আগস্ট থেকে হরকোস সিনচিয়াংয়ের প্রথম সড়ক বন্দর হিসেবে দিনরাত ২৪ ঘন্টা মালামাল পারাপার শুরু করে। নভেম্বর থেকে দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের থরোকার্ট বন্দরও ২৪ ঘন্টা খোলা থাকছে।
কাজাখ ট্রাকচালক সালামাত আবদিলদা জানান, আগে তাকে পণ্যবোঝাই ও শুল্ক ছাড়পত্র পেতে বন্দরে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু এখন মাত্র দু’তিন দিনে কাজ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলের তার সময় বাঁচছে এবং আয় বেড়েছে বলে জানান সালামাত।
হরকোস কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বন্দরটির মধ্য দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১.৩৬ মিলিয়ন টন। যা বছরে ১১৫.৩ শতাংশ বেড়েছে।
অন্যান্য বড় বন্দরগুলোতেও বেড়েছে বাণিজ্য। উরুমুছি কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে সিনচিয়াংয়ে আমদানি ও রপ্তানির মোট মূল্য ২৮৭.৩৩ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৩৯.৬৭ বিলিয়ন ডলার) হয়েছে, যা বছরে ৪৮.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য সিনচিয়াং তার পরিবহন পরিকাঠামোরও উন্নয়ন করছে। আলাতাও পাস নামেও পরিচিত আলাশঙ্কৌর রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণাধীন রয়েছে যা, চীনকে মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
উন্নত অবকাঠামো এবং শুল্ক পরিষেবার সাথে, আলাশঙ্কৌ অনেক বিনিয়োগ উদ্যোগকে আকৃষ্ট করেছে। শুধুমাত্র চলতি বছর, আলাশঙ্কৌ সমন্বিত মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে ১৩০টিরও বেশি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সিনচিয়াংয়ের উন্নয়নে স্থলবন্দরগুলোর ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে আরো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উরুমুছি কাস্টমসের প্রধান হাও ওয়েইমিং বলেন, সীমান্ত বন্দরে ‘সবুজ চ্যানেলের’ মাধ্যমে কৃষিপণ্যের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর করা হবে, অন্যদিকে খনিজ ও অটোমোবাইলের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যও সহজ করা হবে।
উপরন্তু সিনচিয়াংয়ের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি একটি পাইলট মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এফটিজেড) প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। চীনের ২২তম এবং দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে প্রথম পাইলট এফটিজেড প্রতিষ্ঠার এ উদ্যোগ এ অঞ্চল ও চীনের উন্মুক্তকরণে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রায় ১৮০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে নির্মিয়মান পাইলট এফটিজেড কাশগর প্রিফেকচার, উরুমুছি এবং হরকোসের আইকনিক এলাকাগুলোকে নিয়ে গঠিত। আশা করা হচ্ছে এটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে সিনচিয়াংয়ের সংযোগ স্থাপন এবং স্থানীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে।
চীনের নবীনতম এ পাইলট এফটিজেড এক অঞ্চল, এক পথ উদ্যোগের (বিআরআই) মূল এলাকা উন্নয়নে সহায়তা করবে এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে একটি ‘সোনালী চ্যানেল’ নির্মাণের পাশাপাশি চীনের পশ্চিমমুখী উন্মুক্তকরণের সেতুবন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের স্টেট কাউন্সিল এ বিষয়ে একটি সাধারণ পরিকল্পনাও প্রকাশ করেছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমি’র নির্বাহী ডিন, অর্থনীতিবিদ চুয়াং রুই বলেন, ‘পাইলট এফটিজেডের উদ্বোধন সিনচিয়াংয়ের অনন্য অবস্থানগত শক্তিকে আরও সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে এবং এই অঞ্চলটিকে চীনের নতুন উন্নয়ন দৃষ্টান্ত হিসেবে সক্রিয়ভাবে গড়ে তুলতে ও সংহত করতে প্রস্তুত।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।