চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৪৪
2023-11-25 14:53:50

১. সংস্কৃতি সপ্তাহ

সাংহাইতে সৌদি সংস্কৃতি উৎসব
সৌদি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য সাংহাইয়ে সউক উৎসবের আয়োজন করে সৌদি আরব, যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের আকৃষ্ট করে। সউক একটি আরব বাজার বা বিপণিবিতানকেন্দ্র।

ইভেন্টটি পর্যটন বৃদ্ধির জন্য সৌদি আরবের ব্যাপক প্রচেষ্টার অংশ। সৌদি পর্যটন কর্তৃপক্ষের এশিয়া-প্যাসিফিক বাজারের প্রেসিডেন্ট আলহাসান আলদাববাগ চীনা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্খি লক্ষ্যের ওপর জোর দেন।

চীনা ভাষা শেখা সৌদি নাগরিকের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান বলে জানান তিনি। সৌদি আরব এবং চীনের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন তুলে ধরেন সৌদি পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

সউক ফেস্টিভ্যালটি দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক হাইলাইটগুলোর একটি ধারণা দেয়। মন্ত্রমুগ্ধকর পরিবেশনা, আরবীয় ধূপ "বাখুর", কফি এবং খেজুরের ঐতিহ্যবাহী অফার যা আরবীয় আতিথেয়তার প্রতীক। এসব সৌদি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা নিতে আগ্রহী দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়।

সাংহাই আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যাল

মাসব্যাপী পারফরম্যান্সের পর শেষ হয়েছে ২২তম সাংহাই আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যাল। উৎসব জুড়ে ছিল প্রায় ১ হাজার ইভেন্ট। বিশ্ব মানের পারফর্মাররা এতে অংশ গ্রহণ করেন। 

আর্ট স্কাই, উৎসবের একটি প্রধান অংশ। শিল্পের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নত করার উপায় হিসেবে উৎসবে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল।

স্প্যানিশ অপেরা তারকা প্লাসিডো ডোমিঙ্গো, রোমানিয়ান সোপ্রানো অ্যাঞ্জেলা গেওরঝিউ এবং রাশিয়ান পিয়ানোবাদক ডেনিস মাতসুয়েভসহ বিখ্যাত শিল্পীরা উৎসবটি উপভোগ করেন। এতে মেরিনস্কি থিয়েটার এবং আমেরিকান ব্যালে থিয়েটারের মতো জনপ্রিয় সংস্থাগুলো চীনা দর্শকদের জন্য বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা প্রদান করে দর্শকদের বিমোহিত করে।

সপ্তম সিল্ক রোড এক্সপোজিশন

উত্তর-পশ্চিম চীনের সি’আন শহরে অনুষ্ঠিত সপ্তম সিল্ক রোড ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশনে, মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ থেকে তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি এবং বিশেষ পণ্যগুলোকে তুলে ধরা হয়।  আর এর জন্য একটি একচেটিয়া প্রদর্শনী অঞ্চলও স্থাপন করা হয়। 

একচেটিয়া প্রদর্শনী অঞ্চলে প্রদর্শিত বিষয়গুলোর মধ্য রয়েছে এশিয় দেশগুলোর খাদ্য, হস্তশিল্প, গয়না এবং অন্যান্য পণ্য।  এই ধরনের বিশেষ পণ্যের বিক্রয় শুধুমাত্র দর্শনার্থীদের ক্রয় চাহিদাই মেটায় না, বরং চীন এবং মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতার আরও সুযোগ প্রদান করে।

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

 

২. চিয়াংসিতে লোকগানের উৎসব

পূর্ব চীনের চিয়াংসি সম্প্রতি প্রদেশের উইউয়ান কাউন্টিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে স্থানীয় লোকজ গানের উৎসব ২০২৩। এতে মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে চীনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি প্রদর্শন করা হয়। 

ইভেন্টটি চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি চিয়াংসি প্রদেশের স্থানীয় সরকারের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেশীয় লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। লোকগানের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে অভিনব উপায়ে আঞ্চলিক গানগুলো পরিবেশন করা হয়।

উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিল্পী চংমেই জানালেন হ্য চ্য জাতিগোষ্ঠীর সংগীত প্রিয়তার কথা:

"আমরা আমাদের হ্য চ্য  জনগণের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য গান করি। আমরা গানে যা গাই ঠিক তেমনই, হ্য চ্য মানুষের জীবন মধুর চেয়েও মধুর। আমরা এখানে এসে খুব খুশি।"

উৎসবের এই সংস্করণে প্রায় ৪০০ জন অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দক্ষতার উত্তরাধিকারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা চীনা ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রের উপস্থাপনায় যোগ দেন।

আয়োজকরা জানান, এটি ঐতিহ্যবাহী সংগীতের অবৈষয়িক ঐতিহ্য প্রকল্পগুলো প্রদর্শন এবং প্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সংগীতের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ বৃদ্ধির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।  

লোকসংগীত চীনা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিকাশে একটি অনন্য এবং রঙিন সংগীত শিল্পে পরিণত হয়েছে।  চীনা লোকগীতিগুলোকে দেশীয়, উদ্ভূত এবং পুনঃউৎপাদনমূলক গানে ভাগ করা যেতে পারে, যার মধ্যে দেশীয় লোকগানগুলো চীনা জনগণের জীবন ও কর্ম থেকে তৈরি করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

 

৩. চিরায়ত চীনা সাহিত্য

ওয়াং পো: থাং যুগের স্বভাব কবি

চীনের থাংশিরেন বা থাং যুগের কবিদের মধ্যে অন্যতম সেরা কবি ছিলেন ওয়াং পো।  মাত্র ২৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল কবি ওয়াং পোর। কিন্তু তার লেখা এখনও চীনের চিরায়ত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

চীনের থাং রাজবংশের বিখ্যাত কবি ওয়াং বোর বা ওয়াং পোর জন্ম ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এক অভিজাত পরিবারে। তার জন্মসাল নিয়ে অবশ্য পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।

ওয়াংপো, ইয়াং চিয়ং, লু চাওলিন এবং লুও বিনওয়াং এই চারজন লেখকের নাম সব সময় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।

তার বাবা ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। ওয়াং পো বেড়ে উঠেছিলেন বইকে সঙ্গী করেই। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ছয় বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং ন’বছর বয়সে বই লেখেন। পনের বছর বয়সে তাকে রাজদরবারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করতে পারতেন। একবার এক গভর্নরের আমন্ত্রণে ভোজসভায় যোগ দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রচনা ও কবিতা লিখে সবাইকে মুগ্ধ করে দেন ওয়াং বো।

 তার লেখা ‘থাং হুয়া গোশিয়ু’ বইটি হাজার বছর ধরে চীনা পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা হলো  ‘সং তুশাওফু চি রেন শুচৌ’। তিনি ইয়াংসি নদী নিয়ে এমন একটি কবিতা লেখেন যা চিরকাল ধরে এই নদীর সৌন্দর্য বহন করে নিয়ে চলেছে অনাগত কালের পাঠকের মনে।

তিনি একটি কবিতা লিখে সেটি বেশ কিছুদিন ধরে রেখে দিতেন। তারপর পরিমার্জনা করে সেটি প্রকাশ করতেন। বই পড়ার সময় তার অভ্যাস ছিল নোট নেয়া। তার লেখা এ ধরনের বারোটি নোটবুক রয়েছে যা সাহিত্যপাঠের চিরন্তন কৌশল হিসেবে মনে করা হয়। 

৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। সম্ভবত বাবার সঙ্গে দেখা করে রাজদরবারে ফেরার পথে নৌকাডুবিতে তার মৃত্যু হয়েছিল। তার একটি কবিতা এখানে দিচ্ছি।

কবিতাটির নাম ‘ফেয়ারওয়েল টু প্রিফেকট ডু’ বা প্রশাসক তুকে বিদায়

প্রাচীরঘেরা নগরী ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ বহুদূরে

নদীর তীরবর্তি কুয়াশাঢাকা ভূমিতে।

এই বিচ্ছেদে আমি বিষণ্ন ও আতঙ্কিত

কারণ আমরা দুজনেই ছিলাম এখানে আগন্তুক।

যদি তোমার এমন বন্ধু থাকে যে ছিল মনের কাছাকাছি

তাহলে পথের দূরত্ব তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না

এই রাস্তার মোড়ে আমরা পরষ্পরকে বিদায় জানাই

নারীদের মতো চোখের জল ফেলো না বন্ধু।

এই কবিতায় কবি ওয়াং পো তার এক বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছেন। তার বন্ধুর নাম তু। জেলাপ্রশাসক হিসেবে চাকরি নিয়ে শহর ছেড়ে দূরবর্তি অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। কে জানে কবে আবার তার সঙ্গে দেখা হবে? বন্ধুর প্রতি বিদায় জ্ঞাপন এবং তার বিচ্ছেদে কবিতা লেখার রীতি ছিল প্রাচীন চীনে।

তিনি মূলত ব্যক্তিগত অনুভব নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সেই সময়ে প্রচলিত ‘কোর্ট পোয়েটরি’ বা দরবারি কবিতার ধারাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

কিছু কবিতায় তিনি সেই সময়কার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তার অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন। তিনি চীনের থাং রাজবংশের প্রধান চারজন কবির অন্যতম। চীনা পাঠ্যবইতে তার কবিতা হাজার বছর ধরেই অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

---------------------------------------------------------------------------

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ।