জাতিকে বিভক্ত করা যায় না, সভ্যতাকে ব্যাহত করা যায় না
2023-11-22 15:32:37


 

মানবজাতির দীর্ঘ সময়ের সভ্যতায় বিভিন্ন জায়গার মানুষ এক একটি উজ্জ্বল সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। তবে এটি স্বীকার করতে হয় যে, ইতিহাসে চীনের মতো দীর্ঘমেয়াদী ঐক্য বজায় রাখতে পেরেছে এমন বড় দেশ তেমন বেশি নয়। কেন চীনের সভ্যতা কখনও ব্যাহত হয়নি এবং তাতে উচ্চ মাত্রার ঐক্য বজায় রয়েছে?

 

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চীনের ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাবলিকেশন্স অ্যান্ড কালচারের সদরদপ্তরে এসেছি আমরা। এই স্থানটি গ্রন্থসম্পদের ডেটাবেস এবং চীনা সংস্কৃতির জিন ব্যাংক হিসাবে পরিচিত। এখানে চীনা সভ্যতার ঐক্যের অতীত ও বর্তমান খুঁজে পাই আমরা।

 

আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছেন একজন অতিথি। তিনি ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা গবেষণালয়ের পরিচালক চাং ওয়ে ওয়ে। পাশাপাশি তিনি চীনের বিখ্যাত একজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ।

 

আমরা সবাই জানি, চীন এমন একটি দেশ, যেটি ঐক্যের ওপর ভীষণ গুরুত্ব দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, চীনা সভ্যতার ঐক্য কখন শুরু হয়? এটি কি চীনের প্রথম রাজা ছিন শি হুয়াংয়ের দেশের একীকরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল?

 

অধ্যাপক চাং জানান, আসলে খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে ছিন সি হুয়াং চীনের একীকরণ বাস্তবায়ন করেন। তাঁর সময় লিখিত ভাষা ও পরিমাপের একক একীভূত করা হয়, যা চীনা সভ্যতার ঐক্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

তবে তারও আগে চীনে ঐক্যের চেতনা জন্ম নেয়। চীনের প্রথম একীকরণের ৪ হাজার বছর আগে থেকে দেশটির বিভিন্ন জায়গায় নানা সভ্যতা দেখা যায়। যেমন ইয়াং চি নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইয়াং শাও সভ্যতা এবং লিয়াং চু সভ্যতা, লিয়াও হ্য নদীর পাশে হুং শান সভ্যতা ইত্যাদি। ভিন্নতা থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় যে ড্রাগন ইমেজ দেখা যায়, তা বিশাল এ ভূমিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিনিময়ের প্রমাণ। তাই আমরা বলি, অনেক আগে থেকে চীনের সভ্যতায় ঐক্য বিদ্যমান।

 

ড্রাগনের কথা যখন আসে, আমাদের মনে পড়ে যায় যে, পশ্চিম ও পূর্বের ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে ড্রাগন নিয়ে মানুষের ধারণাও ভিন্ন। প্রাচীন আমলে মানুষ ড্রাগন নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতো। তারা মনে করতো, ড্রাগনের রহস্যময় শক্তি আছে। চীনে এক সময় বিছিন্নতা দেখা গেলেও আবার তারা ঐক্যে ফিরে আসে।

 

এর প্রসঙ্গে অধ্যাপক চাং ওয়ে ওয়ে বলেন, ড্রাগন চীনা সংস্কৃতিতে সবসময় ইতিবাচক শক্তির প্রতীক। চীনের প্রথম একীকরণ বা মহান একীকরণের আগে বিভিন্ন সভ্যতায় ড্রাগনের ছবি দেখা যায়। ‘কুং ইয়াং চুয়ান’ শিরোনামের একটি বইতে প্রথম বারের মতো মহান একীকরণের কথা উল্লেখ করা হয়।

 

বিভিন্ন রাজবংশের সময় চীনের মানচিত্রও বদলায়। ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাবলিকেশন্স অ্যান্ড কালচারের সদরদপ্তরে আমরা ‘সি লিও ছিউ লু’ নামে একটি বই পাই। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল মিং রাজবংশের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এখানে লিউ ছিউ দ্বীপ ও তিয়াও ইউয়ু তাও দ্বীপে ভ্রমণের কথা উল্লেখ করা হয়। এমন বই আরও অনেক আছে। যেমন ‘লিন হাই সু থু চি’ শীর্ষক বইয়ে তাইওয়ান সম্পর্কে সবচেয়ে আগের রেকর্ড পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে প্রকাশিত বইটিতে তাইওয়ানকে চীনের একটি অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

 

চীনের সভ্যতা বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে উপাদান গ্রহণ করেছে এবং সেগুলো চীনের সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে। চীনের দীর্ঘ ইতিহাসে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষ পরস্পরের কাছ থেকে শিখেছে।  বিভিন্ন জাতির মানুষের রক্তের সংমিশ্রণে সংস্কৃতিও এক হয়ে ওঠে। ধর্মের দিক থেকে দেখলে দেখা যায় তারা প্রথমে শামানবাদ, তারপর বৌদ্ধধর্ম এবং অবশেষে ইসলাম ধর্মের প্রতি ঝুঁকেছে।

একথা শুনে আপনারা হয়ত জানতে চাইবেন, এতগুলো জাতি ও সংস্কৃতির অভিন্ন উন্নয়নের পথে কোন সংঘাত ছিল না?

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক চাং ওয়ে ওয়ে বলেন, ইউরোপের ধর্মের তুলনায় চীনের ধর্ম-ঐতিহ্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ধর্মীয় যুদ্ধ ছিল না। সংস্কৃতিতে অভিন্ন বিষয় অন্বেষণের পাশাপাশি পার্থক্যের ওপর সভ্যতা নির্মিত হয় এখানে। চীনারা মনে করে, ধর্ম রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। চীনাদের একটি চর্চা হলো অমিল পাশে রেখে মিল অন্বেষণ করা। তাই সভ্যতায় বৈচিত্র্যের পাশপাশি রয়েছে ঐক্য।

 

অধ্যাপক চাং আরেকটি উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, “আমি শাংহাইয়ের মানুষ এবং আমি বেইজিং ও কুয়াংচৌতেও বাস করেছি। এ তিনটি জায়গার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্য জার্মানি, ফরাসি ও ইংরেজির মধ্যকার পার্থক্যের চেয়েও বেশি। হাজার বছর ধরে আমরা ঐক্যের সভ্যতা উপভোগ করে আসছি। অবশ্য এখনও আমাদের মধ্যে নানা পার্থক্য ও মতভেদ রয়েছে। তবে আমরা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে মজা করতে পারি এবং এমন পার্থক্য উপভোগ করতে পারি। এটিও আমাদের সভ্যতার বৈচিত্র্যের একটি প্রমাণ।”

 

চীনা মানুষেরা হাজার বছরের ঐক্যের সভ্যতা উপভোগ করে এবং এভাবে ঐক্যবদ্ধ চীনা জাতি গড়ে উঠেছে। ‘দেশ’ শব্দটির চীনা প্রতিশব্দ হলো ‘কুও চিয়া’। দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত ‘দেশ’র চীনা প্রতিশব্দ। এর মধ্যে কুও মানে দেশ বা রাজ্য এবং চিয়া মানে পরিবার। তাই চীনাদের মতে, দেশ মানে হাজার হাজার পরিবারের একতাবদ্ধ হওয়া। চীনারা মনে করে, এক একটি পরিবারকে ভালভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হলে ভালভাবে একটি দেশ পরিচালনা সম্ভব হয়।

আধুনিক সময়ে, চীন যুদ্ধের শিকার হওয়া বৃহৎ দেশগুলোর একটি। আমরা এটাকে ‘লজ্জার এক শতাব্দী’ বলি। দেশ ও পরিবার হারানোর বিষয়টি সব চীনাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। আর আজ পরিবার মানে দেশ, দেশ মানে পরিবার এমন ধারণা চীনে এক মতৈক্যে পরিণত হয়েছে।

 

চীন সকল দেশের ঐক্যের মধ্য দিয়ে মানবজাতির অভিন্ন সমৃদ্ধি বাস্তবায়ন করতে চায়। যুদ্ধ ও রক্তক্ষরণের সময় যখন চীন বিচ্ছিন্নতায় পড়ে। শান্তি, সহাবস্থান, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সবসময় ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত। বিচ্ছিন্নতা শুধু বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ বয়ে আনে। চীনা মানুষদের একটি জিনগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে ঐক্য এবং বিশ্বাস করা যায়, দেশটিতে সমৃদ্ধি আসবেই।

 

বলা যায়, চীনের ইতিহাস মানে নানা জাতির মানুষের সংযুক্তি, উন্নয়ন এবং তাদের মধ্যে ঐক্য সুসংবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস। সংস্কৃতি ও জাতির একীকরণের ভিত্তিতে দেশের একীকরণ হয়। সংস্কৃতি ও জাতীয়তার ঐক্য দেশের ঐক্যের ভিত্তি হয়ে উঠেছে, যেখানে দেশের ঐক্য সংস্কৃতি ও জাতীয়তার ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করেছে।