চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৪৫তম পর্ব
2023-11-20 15:23:16

 

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৪৫তম পর্বে যা থাকছে:

 

 

* মঙ্গলগ্রহে অক্সিজেন তৈরির ইলেক্ট্রো-ক্যাটালিস্ট তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

* এশিয়ার গভীরতম তেল ও গ্যাস কূপের সন্ধান

 

* পরিবেশবান্ধব ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ আনলো চীন

 

 

 

মঙ্গলগ্রহে অক্সিজেন তৈরির ইলেক্ট্রো-ক্যাটালিস্ট তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-চালিত এক রসায়নবিদ রোবট দিয়ে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য একটি ইলেক্ট্রো-ক্যাটালিস্ট তৈরি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এর ফলে ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহ অনুসন্ধান এবং বহির্জাগতিক সভ্যতা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যয়ের সূচনা হবে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার সিন্থেসিসে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহের নাম মঙ্গলগ্রহ। রোমান যুদ্ধের দেবীর নাম অনুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। মঙ্গলগ্রহ দেখতে লাল কারণ এর মাটিতে আয়রন অক্সাইড নামের এক ধরনের পদার্থ রয়েছে।

পৃথিবীর ‘প্রতিবেশী’গ্রহ হিসেবে মঙ্গলগ্রহ অনুসন্ধান এবং গ্রহবিজ্ঞানে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। লাল এই গ্রহটিতে সম্ভাব্য মানব মিশন বা মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সমস্যা হলো অক্সিজেন স্বল্পতা।

মঙ্গলগ্রহে পানির উল্লেখযোগ্য মজুদ রয়েছে, তবে এ মজুদের প্রায় সবটাই রয়েছে হিমায়িত অবস্থায়। গ্রহটির বায়ুমণ্ডলেও খুব অল্প পরিমাণে জলীয় বাষ্প রয়েছে। চীনা বিজ্ঞানীরা এই ইলেক্ট্রো-ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করে পানিকে জলীয় বাষ্পে পরিণত করে অক্সিজেন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। যদিও অক্সিজেন-উৎপাদনকারী অত্যন্ত ভারী এ রোবটটি পৃথিবী থেকে বহন করে মঙ্গলগ্রহে নিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র ব্যয়বহুল নয়, মাধ্যাকর্ষণ বা গ্রাভিটি, আলো ও বাতাসের কারণে এই মিশন কঠিন হতে পারে।

চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ডিপ স্পেস এক্সপ্লোরেশন ল্যাবরেটরির সহযোগিতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-চালিত এ রোবট রসায়নবিদ তৈরি করেছেন। এর নাম রাখা হয়েছে ‘সিয়াওলাই’। রোবটটি উন্নত এআই প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় মেশিন দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে অক্সিজেন উৎপাদনকারী ইলেক্ট্রো-ক্যাটালিস্ট তৈরি করতে সক্ষম। এটি একটি মোবাইল রোবট। এর মধ্যে রয়েছে কম্পিউটিং মস্তিষ্ক, একটি ক্লাউড সার্ভার এবং বিভিন্ন কার্যসম্পাদনে সক্ষম একাধিক রাসায়নিক ওয়ার্কস্টেশন এবং এই রোবটটি উচ্চ পরীক্ষামূলক কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম।

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুও ই বলেন, “প্রথমবারের মতো আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মঙ্গলগ্রহের উল্কাপিণ্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো সংগ্রহ করার পর একটি ক্যাটালিস্ট তৈরি করেছি। অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য একটি ক্যাটালিস্ট তৈরি ও অপ্টিমাইজ করার জন্য আমরা একটি মেশিন এবং এআই প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারি। মঙ্গলগ্রহে মানব বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।”

এই বুদ্ধিমান রোবটির মাধ্যমে মহাকাশ অনুসন্ধানের পাশাপাশি নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। এই রসায়নবিদ রোবট মঙ্গলগ্রহের উল্কা ও অন্যান্য যৌগগুলোকে ব্যবহার করে এবং হিমবাহ থেকে অক্সিজেন তৈরি করতে পারে, যা মানুষ ব্যবহার করতে পারবে।

মঙ্গলগ্রহের বাতাস পৃথিবীর চেয়ে হালকা। ওখানকার বাতাসে অক্সিজেন নেই বললেই চলে। তার বদলে আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও আর্গন। পৃথিবীর মতো মঙ্গলগ্রহেও ঋতু পরিবর্তন হয়।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

এশিয়ার গভীরতম তেল ও গ্যাস কূপের সন্ধান

উত্তর-পশ্চিম চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের থারিম অববাহিকায় এশিয়ার গভীরতম তেল-গ্যাস কূপের সন্ধান পেয়েছে দেশটির পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি সিনোপেক। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পেট্রোলিয়ামের খোঁজ করতে গিয়ে ভূপৃষ্ঠের ৯ হাজার ৪৩২ মিটার গভীরে এই কূপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস রয়েছে। এটি চীনের আল্ট্রা বা অতি-গভীরে তেল ও গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধানে অগ্রগতির প্রমাণ।

 

সিনচিয়াংয়ের পেট্রোলিফেরাস থারিম অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত শেনতি-১ প্রকল্পের ‘ইয়েচিন ৩-৩এক্সসি’ কূপ থেকে প্রতিদিন ২০০ টন অপরিশোধিত তেল এবং ৫০ হাজার ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসের ১ তারিখ থেকে এর খনন কাজ শুরু হয়। ১৭৭ দিন খনন কাজ পরিচালনার পর এই কূপে পৌঁছাতে পেরেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দশ দিন ধরে তেলকূপ প্রাচীর বর্ধিত করা ও পরিষ্কার করা, তেলের টিউব স্থাপন করাসহ বিভিন্ন প্রস্তুতির পর এখন কূপটি তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত। ৯ হাজার ৪৩২ মিটার গভীর থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলনে সময় লাগবে তিন ঘন্টা।

এতো গভীরে পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। থারিম অববাহিকায় ৮ হাজার মিটারের নিচে মোট তেল ও গ্যাসসম্পদ নয় বিলিয়ন টন তেলের সমতুল্য, যা দেশের অতি গভীরে আবিস্কৃত সম্পদের অর্ধেকেরও বেশি।

সিনোপেক উত্তর-পশ্চিম চীন পেট্রোলিয়াম ব্যুরোর উপমহাব্যবস্থাপক ছাও চিছেং বলেন, “এই কূপের সফল পরীক্ষা আরও ভালোভাবেই প্রমাণ করে যে, থারিম অববাহিকা অতি-গভীর তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। আমরা অতি গভীরে তেল ও গ্যাসের মজুদ সম্পর্কিত অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও প্রকৌশল প্রযুক্তির জন্য একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছি। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে একেবারে গভীরে অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও গতি পেয়েছে।”

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীন গভীর তেল ও গ্যাস সম্পদের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৫০০ মিটারের বেশি গভীরতায় মোট ৩৫২টি তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। থারিম অববাহিকায় তেলসম্পদ ৬ হাজার মিটার থেকে ১০ হাজার মিটারের মধ্যে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এ অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের গভীরে পাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ৮৩ দশমিক ২ শতাংশই তেল।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

পরিবেশবান্ধব ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ আনলো চীন

উচ্চ দূষণ এবং উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের সনাতন ডিজেলচালিত লোকোমোটিভ বা রেলইঞ্জিনের পরিবর্তে প্রথমবারের মতো উচ্চ ক্ষমতার বৈদ্যুতিক শান্টিং লোকোমোটিভ এনেছে চীন। এই লোকোমোটিভটি মেটালার্জি, হারবার অপারেশন, বিদ্যুৎ, পেট্রোকেমিক্যাল ও খনির মতো শিল্প খাতের ব্যবহারকারীদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা কার্বন নির্গমন কমানোর পাশাপাশি শব্দ দূষণও কমিয়ে আনবে।

চীনের রেল প্রযুক্তিতে বড় অগ্রগতি নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব এই লোকোমোটিভ। এর একমাত্র জ্বালানির উৎস একটি উচ্চ ক্ষমতার লিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটারি। এই ব্যাটারি একটি ১ হাজার ২০০ কিলোওয়াটের আল্ট্রা-হাই-পাওয়ার লিকুইড-কুলড ফাস্ট চার্জিং ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সম্পূর্ণ চার্জে এটি দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে ১ হাজার ২০০ টন কার্গো ১২৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। এই লোকোমোটিভটি প্রথম ও শেষ-মাইল শান্টিং বা এক লাইন থেকে অন্য লাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এটি ডিজেলচালিত লোকোমোটিভগুলোর লাইনেই চলাচল করব।

ডিজেলচালিত লোকোমোটিভের তুলনায় নতুন এই লোকোমোটিভটি পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প-কার্বন নিঃসরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি। এর ফলে বছরে প্রায় ১৫০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমে যাবে। এটি কেবলমাত্র শক্তিশালী নয়, বরং স্মার্ট ও যথেষ্ঠ নিরাপদ। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মতে, এই লোকোমোটিভের ফলে বছরে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন কমবে তা বছরে ৮ হাজার ২০০টি গাছ লাগানোর সমতুল্য।

 

প্রথম অবস্থায় কয়লাসমৃদ্ধ শায়ানসি এবং শানসির প্রদেশের শেনমু-শুওচৌ রেলপথে চলবে এটি।

সিআরআরসি চুচৌ লোকোমোটিভ কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক খাং মিংমিং বলেন, “দেড় হাজার কিলোওয়াটের সর্বাধিক ট্র্যাকশন পাওয়ারসহ এটি চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক শান্টিং লোকোমোটিভ।”

অভিন্ন অপারেটিং ব্যবস্থার অধীনে এই লোকোমোটিভটি বছরে ১ মিলিয়ন ইউয়ান বা ১ লাখ ৩৮ হাজার ডলার জ্বালানি ব্যয় কমাবে এবং এর সামগ্রিক ব্যয়ের ২০ শতাংশ সাশ্রয় হবে।

 

||প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

||সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

প্রিয় শ্রোতা, এই ছিলো আমাদের এবারের বিজ্ঞানবিশ্ব। অনুষ্ঠান কেমন লাগছে আপনাদের, তা আমাদের জানাতে পারেন। এতোক্ষণ বিজ্ঞানবিশ্বের পুরো আয়োজন জুড়ে ছিলাম আমি শুভ আনোয়ার। নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী