দেহঘড়ি পর্ব-০৪৫
2023-11-19 15:00:16

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’ এবং চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

ফ্রোজেন শোল্ডারের নানা চিকিৎসা টিসিএমে

ফ্রোজেন শোল্ডার কাঁধের একটি রোগ। এ রোগ হলে কাঁধে ব্যথা হয় এবং কাঁধ শক্ত হয়ে যায়, যার ফলে কাঁধ নাড়ানো অসুবিধা হয়। তবে আক্রান্ত স্থানে স্পর্শ করা হলে সাধারণত তেমন ব্যথা অনুভূত হয় না। এই রোগকে অ্যাডেসিভ ক্যাপসুলাইটিসও বলা হয়। ফ্রোজেন শোল্ডার সাধারণত পঞ্চাশোর্ধদের হয় এবং এর লক্ষণ ধীরে ধীরে দেখা দেয়। সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারে পুরো লক্ষণ দেখা দিতে। কাঁধের চারপাশে পেশী ক্ষয়ের কারণে সাধারণত এটা হয়। হিউমারাস বা বাইসেপ রগ ফেটে যাওয়ার কিংবা কাঁধে আঘাত বা অস্ত্রোপচারের কারণেও এটা হতে পারে। কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে এ রোগের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায় না। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এ রোগ।

উপসর্গ

ফ্রোজেন শোল্ডারের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঁধে ব্যথা এবং কাঁধ নাড়াচাড়ায় সমস্য। কখনও কখনও এ রোগ হাতের নড়াচড়া পর্যন্ত প্রায় অসম্ভব করে তোলে। এ রোগের তিনটি পর্যায় থাকে। ফ্রোজেন শোল্ডারের প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যথা ছয় সপ্তাহ থেকে নয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং ব্যথা বাড়ার সাথে সাথে কাঁধ নাড়াচাড়া করার গতি কমে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যথা ধীর গতিতে বাড়তে থাকে এবং কাঁধ আরও বেশি শক্ত হয়ে যায়। এই পর্যায় সাধারণত চার মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তৃতীয় পর্যায়ে উপসর্গগুলো সরে যেতে থাকে এবং কাঁধের গতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। এ পর্যায়টি সাধারণত পাঁচ থেকে ২৬ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

টিসিএমের দৃষ্টিতে ফ্রোজেন শোল্ডার

ঐতিহ্যবাহী চীনা মেডিসিন বা টিসিএমে মনে করা হয়, ফ্রোজেন শোল্ডার হয় ঠান্ডাজনিত কারণে শরীরের মেরিডিয়ান পথে মূল প্রাণশক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত বাধাগ্রস্ত হলে। ‘ছি’ হলো তাপজনিত শক্তি ‘ইয়াং’ ও ঠান্ডাজনিত শক্তি ‘ইয়িন’র সমন্বিত শক্তি। ফ্রোজেন শোল্ডার সাধারণত পঞ্চাশোর্ধদের মধ্যে বেশি দেখা যায় বলে চীনা ভাষায় এ রোগকে উ শি চিয়ান বা পঞ্চাশের কাঁধও বলা হয়। শরীরে যখন ‘ইয়াং’ শক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, তখন বয়স্ক ব্যক্তিরা বাতাস, ঠান্ডা ও ক্লেদের কাছে বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠেন বলে এ রোগ তাদের বেশি হয়।

চিকিৎসা: টিসিএমে ফ্রোজেন শোল্ডারের বেশ কয়েক ধরনের চিকিৎসা আছে। যেমন আকুপাংচার, ভেষজ ওষুধ, মক্সিবাস্টন, কাপিং থেরাপি, থুইনা ও ঐতিহ্যবাহী ব্যায়াম। প্রত্যেক রোগীর আলাদা আলাদা লক্ষণ বিশ্লেষণ করে একজন টিসিএম চিকিৎসক নির্ধারণ করেন এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি তার প্রয়োজন হবে।

আকুপাংচার: ঠান্ডা, বাতাস, ক্লেদ এবং ‘ছি’ ও রক্তের স্থবিরতার কারণে সৃষ্ট ফ্রোজেন শোল্ডারের চিকিত্সায় সহায়তা করে আকুপাংচার। কারণ আকুপাংচার ‘ছি’ ও রক্তচলাচলের পথ সুগম করে এবং রক্ত সঞ্চালনকে উন্নীত করে, যার ফলে ইয়িন ও ইয়াংয়ের মধ্যে ভারসাম্য আসে। নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে নিয়মিত আকুপাংচার দেওয়া হলে, তা কেবল কাঁধের গতি ফিরিয়ে আনে না, এর ব্যথা উপশম করতেও সাহায্য করে।

ভেষজ চিকিৎসা: ফ্রোজেন শোল্ডারের ব্যথা যদি খুব বেশি হয় এবং ফিজিওথেরাপি নেওয়া কঠিন হয়, তাহলে একজন টিসিএম চিকিত্সক প্রাকৃতিক ব্যথা উপশমকারী ও প্রদাহবিরোধী পদ্ধতি হিসাবে চীনা ভেষজ ওষুধ দিতে পারেন। আর আকুপাংচারের সঙ্গে এ ভেষজ ব্যবহার করা হলে, রোগমুক্তির গতি দ্রুত হয়।

মক্সিবাস্টন: শরীরের ঠান্ডা দূর করার মাধ্যমে ইয়াং শক্তির ঘাটতি পূরণ করে ফ্রোজেন শোল্ডার সারাতে সাহায্য করে মক্সিবাস্টন। মক্সিবাস্টন আসলে বাহ্যিক তাপ থেরাপির একটি ধারা। এ চিকিৎসায় ত্বকে বা তার কাছাকাছি নির্দিষ্ট উপাদানগুলোকে পোড়ানো হয়। এটি ‘ছি’ ও রক্তের প্রবাহ ঠিক করতে সাহায্য করে।

কাপিং থেরাপি: এ ধরনের থেরাপি আকুপাংচারের মতো আকুপয়েন্ট ও মেরিডিয়ানের উপর নির্ভর করে। এই চিকিত্সাটি প্রায়শই ত্বকের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলিকে উদ্দীপিত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি পরোক্ষ চিকিৎসা অর্থাৎ আক্রান্ত স্থানের সরাসরি চিকিত্সা না করে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যথা উপশম করা হয় এ চিকিৎসার মাধ্যমে।

থুইনা: থুইনা হলো চীনা মাসাজের একটি বিশেষ রূপ। এটি নির্দিষ্ট আকুপয়েন্টগুলোকে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে ফ্রোজেন শোল্ডার চিকিত্সায় সাহায্য করে।

ঐতিহ্যবাহী ব্যায়াম: ফ্রোজেন শোল্ডারের চিকিৎসায় টিসিএম ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব দেয় তবে এক্ষেত্রে ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অত্যধিক প্রসারণ রোগের অবনতি ঘটাতে পারে। ফলে মৃদু ও স্বল্প প্রসারণ ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন এবং তারপর ধীরে ধীরে সময় ও তীব্রতা বাড়ান। থাই চি এবং ছিকুংয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী ব্যায়ামও ফ্রোজেন শোল্ডারের চিকিৎসায় ভালো ফল দেয়। এ ব্যায়াম ব্যথা কমাতে ও গতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পিকিং ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

পিকিং ইউনিয়ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (পি ইউ এম সি এইচ) হলো চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অবস্থিত সর্বোচ্চ ধাপের একটি প্রথম শ্রেণির পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষ বলছে, অত্যাধুনিক ক্লিনিক্যাল সেবা প্রদান, উদ্ভাবনী বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কঠোর চিকিৎসা শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানটি।

চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এ হাসপাতালটিকে জাতীয় রেফারেল কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে মনোনীত করেছে। এটি জটিল ও বিরল ব্যাধিগুলোর ডায়াগনস্টিক ও চিকিৎসার কেন্দ্র, চিকিৎসা খাতে উচ্চশিক্ষার একটি ভিত্তি এবং মানসম্মত আবাসিক প্রশিক্ষণ, ক্লিনিকাল গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মূল জাতীয় কেন্দ্র। প্রাচীনতম চীনা হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি এটি। চীনের জ্যেষ্ঠ নেতা ও বিদেশি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এই হাসপাতালটি।

অসাধারণ শৃঙ্খলা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং অসামান্য বিশেষত্বের জন্য খ্যাতি রয়েছে এ হাসাপাতালের। সরকারি হাসপাতালের জাতীয় কর্মক্ষমতা মূল্যায়নে এটি তিনবার প্রথম স্থান পেয়েছে। ফুদান বিশ্বদ্যিালয়ের হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘চীনের হাসপাতাল র‍্যাঙ্কিংয়ে’ পিকিং ইউনিয়ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল টানা ১৩ বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে।

রকফেলার ফাউন্ডেশন ১৯২১ সালে এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠাতাদের লক্ষ্য ছিল এটিকে ‘এশিয়ার সেরা চিকিৎসাকেন্দ্র’ হিসাবে গড়ে তোলা। বিগত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ হাসপাতাল লালন করে আসছে ‘নির্ভুলতা, ক্রমোন্নতি, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা’ এবং ‘দেশ ও জনগণের জন্য চিকিৎসা অনুশীলন ও জ্ঞান অন্বেষণের’ আকাঙ্ক্ষাকে। অধ্যাপকবৃন্দ, কেস ফাইল ও লাইব্রেরি – এই ‘তিন সম্পদ’ নিয়ে গর্বিত পিকিং ইউনিয়ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

এই চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানটি ডা.  চাং চিয়াওছিয়ান এবং ডা. লিন ছিয়াওচিয়ের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক পথিকৃৎকে তৈরি ও লালন করেছে। এছাড়াও, বহু বিখ্যাত চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপক গড়ে তুলেছে এ হাসপাতাল, যারা এখন গোটা চীনে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

বর্তমানে এ হাসপাতালের চারটি ক্যাম্পাস রয়েছে, যেগুলোর মোট আয়তন ৬ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার। এখানে কর্মরত ৪ হাজার ৩শ’র বেশি কর্মী, যাদের মধ্যে রয়েছেন চীনের বিজ্ঞান একাডেমি এবং চীনের প্রকৌশল একাডেমির ৩ জন শিক্ষাবিদ। আর এ হাসপাতালে রয়েছে ৫৮টি ক্লিনিকাল ও চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি ক্লিনিকাল স্পেশ্যালিটি এবং ৬টি জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্ল্যাটফর্ম। নয়টি বিভাগে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয় এ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানটি।    

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।