‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ৪৪
2023-11-14 19:20:10

 

এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে    

১। তরুণ শহর হয়ে উঠেছে উচেন

২। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে হংকং-চুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ

৩। কুনমিংয়ের জেড পাথর গ্রিন লেক পার্ক

 

বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ 

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"।

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।  

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৪৪তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।     

১।  তরুণ শহর হয়ে উঠেছে উচেন

প্রাচীন জলের শহর নামে খ্যাত উচেন শহর। পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশের প্রাচীন শহর এটি। এ শহরের রয়েছে এক হাজারেরও  বেশি সময়ের ইতিহাস।

একসময় প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি এবং প্রাচীন স্থাপত্যকে দুর্বলভাবে সংরক্ষিত করায় তেমন মানুষের আগমন ছিল না এই শহরে। কিন্তু দুই দশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিকাশে এবং প্রাচীন স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণে কিছু প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পরবর্তীতে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক  সৌন্দর্যের সমন্বয়ের উচেন এখন চীনের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

                                                                                                                                                                                                              

প্রাচীন এই শহরে প্রতিবছরের মতো চলতি বছরও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বার্ষিক নাট্য উৎসব। উচেনে চলমান থিয়েটার উত্সব প্রাকৃতিক জলের শহরে বিপুল সংখ্যক দর্শককে আকর্ষণ করে। বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমনে উচেন শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাপনেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন  তারা। 

এই শহরেরই বাসিন্দা থ্যাং চিয়ানিউ। তিনি তার স্বামীকে নিয়ে একটি হোমেস্ট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই কাজ করছেন তারা। উচেনের প্রাচীন বাড়িগুলোর আদলে তৈরি তাদের হোমেস্ট। মনোমুগ্ধকর দোতলা বিল্ডিং যেখানে সাতটি অতিথি কক্ষ রয়েছে এবং প্রতিদিনই এই রুমগুলো বুক করা হয়ে থাকে।

 

থ্যাং বলেন,  "আমাদের আয় বাড়ছে। অনেক পর্যটক আসায় আমাদের ব্যবসা বেড়েছে। আমরা এই ব্যবসা করে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং দুটি গাড়ি কিনেছি। পাশাপাশি আমরা সঞ্চয়ও করেছি কিছু টাকা।

এই শহরে থ্যাং দম্পতির মতো নৈসর্গিক এলাকার মধ্যে সুসংরক্ষিত পুরানো বাসস্থানে প্রায় অর্ধশত হোমস্টে রয়েছে। ঘুরতে এসে এই হোমেস্ট পর্যটকদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরতে আসা এলি ওয়াং বলেন, "এই  জলের শহরে আমরা নৌকায় গিয়েছিলাম। এখানকার সুস্বাদু খাবার খেয়েছি। এখানে প্রথমবারের মতো অনেক নতুন জিনিস দেখেছি। এখানকার স্থানীয়দের কিছু নাচ এবং ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার আমাকে মুগ্ধ করেছে। এসব পরিবেশনা অস্ট্রেলিয়ায় আগে কখনো দেখা হয়নি। এখানে আসার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই অভিভূত।

সরকারী পরিসংখ্যান বলছে সম্প্রতি থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল শুরু হওয়ার পর থেকে, প্রাকৃতিক এই শহরে প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজারেও বেশি দর্শনার্থী  এসেছে।

উচেন ট্যুরিজ্যম কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এবং থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের প্রতিষ্ঠাতা চেন সিয়াং বলেন,   "উচেন তরুণ হয়ে উঠেছে। অতীতে, লোকেরা বলত উচেন ছিল শুধুমাত্র একটি মনোরম জায়গা, কিন্তু এখন তারা বলে যে এখানে থিয়েটার উত্সব অনুষ্ঠিত হয়।

বাহারী সব খাবার, চীনা ঐতিহ্যের পোশাক ও শিল্পকর্ম খুঁজে পেতেও এই শহরে ঘুরতে আসেন অনেকে। আবার কেউবা শুধুমাত্র নৌকায় শহরতেও ঘুরতেও খুঁজে নেন এই শহরকে।

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- মাহমুদ হাশিম

২। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে হংকং-চুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ

সমুদ্রের ওপর বিশ্বের অন্যতম বড় সেতু চীনের হংকং-চুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ। ২ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে, শক্তিশালী মাত্রার টাইফুন কিংবা ভূমিকম্প প্রতিরোধী এ সেতুটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে চার লাখ টন স্টিল, যা দিয়ে ৬০টি আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করা সম্ভব। বর্তমানে সেতুটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী আসছেন এটি দেখতে এবং ছবি তুলতে। বলা যায় ছবি তোলার ‘হট স্পটে’ পরিণত হয়েছে এটি।

৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। নয় বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে উন্মক্ত করে দেওয়া হয় জনসাধারণের জন্য।

এই সেতুটি টানেল সমুদ্র ক্রসিং হিসেবে পরিচিত, যা চীনের হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল, চুহাই শহর এবং ম্যাকাও বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলকে যুক্ত করেছে। যাত্রাপথে সেতুটি আরও ১১টি বড় শহরকে যুক্ত করেছে।

দক্ষিণ চীনের ৫৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এ সেতুর সুবিধা ভোগ করছেন। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও স্থাপত্য বিস্ময়ের কারণে সেতুটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সেতু পারাপারের পাশাপাশি এটি দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন। এর ফলে এ অঞ্চলে পর্যটন বাজার আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

সু কুইপিং নামে একজন ট্যুর গাইড জানান, অনেক দর্শনার্থী আইকনিক হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতুতে ছবি তুলতে আসেন। এ কারণে পর্যটন মার্কেট আরও বাড়ছে।

সেতুটির প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পার্ল নদীর ওপর দিয়ে গেছে আর জাহাজ চলাচল অব্যাহত রাখার সুবিধার্থে ছয় দশমিক সাত কিলোমিটার রাখা হয়েছে সাগরের নীচে টানেলে এবং এর দু অংশের মধ্যে সংযোগস্থলে তৈরি করা হয়েছে একটি কৃত্রিম দ্বীপ। আর বাকী অংশ সংযোগ সড়ক, ভায়াডাক্ট আর ভূমিতে টানেল যা চুহাই ও হংকংকে মূল সেতুর সঙ্গে যুক্ত করেছে।

চুহাই ট্র্যাভেল এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-চেয়ারম্যান প্যান ইয়ানছিয়ান বলেন,.বন্দরটি পর্যটনের জন্য গেম-চেঞ্জার। এটি মূল ভূখণ্ডের পর্যটকদের হংকং ও ম্যাকাও ভ্রমণ আরও সহজ করেছে। এটি চুহাই শহরের পর্যটন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে হংকংয়ের পর্যটন সংস্থা, সামাজিক গোষ্ঠী এবং ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করেছে। এছাড়াও হংকং থেকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এখন প্রতি সপ্তাহে এবং ছুটির দিনগুলো এই সেতুর মাধ্যমে পশ্চিম কুয়াংতোং প্রদেশে ঘুরতে যাচ্ছে।

প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এ সেতু পাড়ি দিচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব মানুষ হংকং-ম্যাকাওয়ে ভ্রমণে যান তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকে এই সেতু।

সেতুটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পর্যটকদের ম্যাকাও ও চুহাইয়ের মধ্যে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বা ছাড়পত্র নিতে হয়। পর্যটকদের জন্য নিয়মিত বাস সার্ভিসের পাশাপাশি রয়েছে শাটল বাস সার্ভিস

প্রতিবেদন- শুভ আনোয়ার

সম্পাদনা-আফরিন মিম

 

৩।  কুনমিংয়ের জেড পাথর গ্রিন লেক পার্ক

কিছুটা প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে সবাই ছুটেন পার্কে।  সবুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা। সবুজ প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এমনই একটি পার্ক গ্রীন লেক পার্ক ।

ইয়ুননান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত  গ্রিন লেক পার্ক বা সুই হু পার্ককে বলা হয় কুনমিংয়ের জেড পাথর। উহুয়া পাহাড়ের পশ্চিম দিকে এই পার্ক। বিংশ শতাব্দিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এই পার্ক।

এই পার্কে রয়েছে চারটি ছোট লেক । যেগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত। লেকগুলোর উপরে দৃষ্টিনন্দন পাথরের সেতু রয়েছে। পাথরের সেতুগুলো ঐতিহ্যবাহী চীনারীতিতে নির্মিত।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের শহরের ক্যাম্পাস থেকে খুব কাছেই এই পার্ক। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটকের উল্টোদিকেই এর অবস্থান।

শীতকালে এই পার্কের জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির মেলা বসে। কালো-গলা গাংচিলরা উড়ে আসে। শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা উড়ে আসে কুনমিংয়ের এই পার্কের জলাশয়ে। পরিযায়ী পাখিদের জন্য রুটি ও অন্যান্য খাবার বিক্রি হয় এখানে। পর্যটকরা এসব খাবার কিনে পাখিদের খাওয়ান। তাদের হাত থেকেই অনেক সময় পাখিরা খাবার খায়।

এখানে প্রায়ই বিভিন্ন মেলা বসে। এখানে  চীনা লোকজ অপেরার পরিবেশনা দেখা যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। লোকজ সংগীতের আসরও বসে প্রায়ই। এখানে ইয়ুননান প্রদেশের বিখ্যাত দেশ প্রেমিক কবি নিয়ে আর এর একটি ভাস্কর্য রয়েছে। আরও রয়েছে চীনা লোকজ ঐতিহ্যের ধারক কিছু দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য।

গ্রিন লেক পার্কের একটি অংশে শিশুদের জন্য কিছু রাইডের ব্যবস্থাও আছে। সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো লেকের সঙ্গেই ঐতিহ্যবাহী চীনা রীতিতে নির্মিত একটি স্থাপনা।

গ্রিনলেক পার্কের সঙ্গের রাস্তাটিও বেশ বিখ্যাত। এটি মূলত রেস্টুরেন্ট স্ট্রিট এবং শপিং এলাকা। অনেকগুলো রেস্টুরেন্টে রুফটপ বা ছাদে বসে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে পার্কের দৃশ্য দূর থেকে দেখতে দেখতে মজাদার খাবার খাওয়া যাবে। চীনের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি চায়ের দোকানও রয়েছে এখানে।

রেস্টুরেন্টগুলোতে চীনের বিখ্যাত রাইস নুডুলস, আলুর নুডুলস, ফ্লাওয়ার কেক ইত্যাদি পাওয়া যায়। রয়েছে মুসলিম রেস্টুরেন্টও। এসব রেস্টুরেন্টে হুই মুসলিম জাতির বিশেষ মুখরোচক খাবার পাওয়া যাবে।

প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা- আফরিন মিম 

 

 

ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী