চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2023-11-13 17:07:48

 

 


৪৪তম পর্বে যা থাকছে:

 

* মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় মডেল তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* জরুরি উদ্ধারে উভচর বিমানের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করছে চীন

* বিশ্বের প্রথম কাইমেরিক বানর তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

 

মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় মডেল তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশের আদলে একটি নতুন সংখ্যাসূচক মডেল তৈরি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। মূলত ‘নমুনা-প্রত্যাবর্তন’ বা স্যাম্পল রিটার্ন মিশনের গবেষণায় সহায়তা করার জন্য এমন মডেল তৈরি করেছে দেশটি। সম্প্রতি ‘চাইনিজ সায়েন্স বুলেটিন’ জার্নালে এ গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

২০২৮ সালে মঙ্গলগ্রহের নমুনা পৃথিবীতে আনার জন্য থিয়ানওয়েন-৩ মিশন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন (সিএনএসএ)।

সে লক্ষ্যে চীনের বিজ্ঞান একাডেমির আওতাধীন বায়ুমণ্ডলীয় পদার্থবিদ্যা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহের জন্য বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় মডেল ‘গো মার্স’ ডিজাইন ও তৈরি করেছেন। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলের তিনটি কঠিন পরিস্থিতি অর্থাৎ ধূলিকণা, পানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের আদলে মডেলটি তৈরি করেছেন তারা। এ মডেলটির মাধ্যমে মহাকাশযানের অবতরণের জন্য মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়া সংক্রান্ত অবস্থার তথ্য পওয়া যাবে। চীনের মঙ্গলগ্রহের রোভার চুরং, নাসার ভাইকিং-১ এবং ২ ল্যান্ডারের পাশাপাশি ‘ওপেন মার্স’ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে একে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ‘গো মার্স’ মডেলটি মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠের চাপের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো সফলভাবে তৈরি করেছে। মডেলটি মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা, আঞ্চলিক বায়ু, মেরুবরফ এবং ধুলোর পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে ভাল কর্মক্ষমতা দেখিয়েছে। মঙ্গলগ্রহে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গ্রহটির আবহাওয়ার পূর্বাভাসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। গবেষকরা বলছেন, তাদের মডেলটি গ্রহের ধুলোঝড়ের মতো আবহাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ে আরও গবেষণা এবং ভবিষ্যতে মানববাহী মঙ্গল মিশনের জন্য সাহায্য করবে।

২০২০ সালে ২৩ জুলাই চুরং রোভার রোবটটিকে মঙ্গলগ্রহে নিয়ে যায় থিয়ানওয়েন-১। একটি বাতাসে ভরা ক্যাপসুল ব্যবহার করে চুরং রোভার ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। রোভারটি তার ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম থেকে ২০২১ সালের মে মাসে মঙ্গল গ্রহের ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করে অনুসন্ধান চালায়।

প্রধান গবেষক ওয়াং বিন জানান, মহাকাশ প্রশাসনের তৈরি করা থিয়ানওয়েন-১ মিশনের সঙ্গে তুলনা করলে থিয়ানওয়েন-৩ মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ অবতরণ, নমুনা ও ফিরে আসার কাজ করবে।

মডেলটি আবহাওয়া বিশ্লেষণের চেয়ে ‘ভার্চুয়াল মঙ্গলগ্রহ’ হিসেবে অনেক বেশি কাজ করতে পারে। কেননা মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণের ডেটা পৃথিবীর তুলনায় অনেক বিরল। অনেক সময় বিজ্ঞানীদের দূরবর্তী গ্রহ সম্পর্কে জানতে সিমুলেশন ডেটার প্রয়োজন হয় এবং তারপর তাদের উপযুক্ত অবতরণ এলাকা নির্বাচন এবং রোভার ডিজাইন করতে হয়।

মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনই দ্বিতীয় দেশ যারা মঙ্গলগ্রহে সফলভাবে রোভার নামাতে এবং মঙ্গলের পৃষ্ঠে রোভারটিকে উল্লেখযোগ্য সময় ধরে কাজ করাতে সক্ষম হয়েছে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

জরুরি উদ্ধারে উভচর বিমানের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করছে চীন

সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এজি৬০০এম অগ্নিনির্বাপক উভচর বিমানের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করেছে চীন। দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিমাননির্মাতা প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন অব চায়না (এভিআইসি) এ তথ্য জানিয়েছে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা বিমানটিকে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করেছে। এর ফলে অগ্নিনির্বাপণ ও অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে আরও ভালভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।

চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এজি৬০০এম অগ্নিনির্বাপক উভচর বিমানটি বর্তমানে আরও মান উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। এর উপরের অংশ বিমানের আকৃতির এবং নিচের অংশ জাহাজের আকৃতির।

সমুদ্রের ঢেউ মোকাবেলায় কিংবা পানিতে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার সময় বিমানটির জাহাজ আকৃতির পেট এর কর্মক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। অগ্নিনির্বাপক-বিশেষায়িত এজি৬০০এম বিমানের সর্বোচ্চ টেক-অফ ওজন ৬০ টন এবং সর্বোচ্চ ১২ টন পানি উপর থেকে ফেলতে সক্ষম। এই বিমানটির ককপিট, কেবিন ও ডানা থেকে শুরু করে জাহাজ আকৃতির পেট পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ও সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে।

২০২৪ সালের শেষ নাগাদ আকাশে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাইপ সার্টিফিকেট পাওয়ার আশা প্রকাশ করেছে কোম্পানিটি। এছাড়া ২০২৫ সালে অগ্নিনির্বাপণ ও অন্যান্য উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

এভিআইসি জেনারেল হুয়ানান এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী ও বিমানটির প্রধান ডিজাইনার হুয়াং লিংছাই বলেন, “এজি৬০০এম অগ্নিনির্বাপক বিমানটি ১২ টন পানি বহন করতে এবং অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ফেলতে সক্ষম। অক্টোবরের শেষের দিকে মধ্য চীনের চিংমেন শহরে অনুষ্ঠিত জরুরি বিমান উদ্ধার মহড়ায় অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা দেখিয়েছে এটি।”

চীনা ভাষায় এই বিমানটির কোডনাম হলো খুনলং বা ‘পানির ড্রাগন। এজি৬০০ বিমানের সিরিজটিকে জরুরি পরিস্থিতিতে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। নির্মাণকারীরা এই বিমানগুলোকে দাবানল মোকাবেলা, সামুদ্রিক অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় অধিক কার্যকরী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

বিশ্বের প্রথম কাইমেরিক বানর তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

বিশ্বের প্রথম জীবন্ত বানর গোত্রীয় কাইমেরার জন্ম দিয়েছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। জিনগতভাবে স্বতন্ত্র দাতা ভ্রূণ থেকে স্টেম সেল দিয়ে এ কাইমেরার জন্ম দেন তারা। এটি পরীক্ষামূলক গবেষণা উল্লেখ করে এ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর সংরক্ষণ এবং প্রাইমেট স্টেম সেলের ক্ষেত্রে এ ধরনের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রাচীন গ্রিক পুরাণে কাইমেরা নামের এক ধরনের প্রাণীর উল্লেখ রয়েছে, যার একটি মাথা ও ঘাড় সিংহের মতো, পিঠ ছাগলের মতো এবং লেজ সাপের মতো। অর্থাৎ এক প্রাণীর শরীরে কয়েক প্রাণীর অস্তিত্ব।

সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞানীরা স্টেম সেল দিয়ে জীবন্ত কাইমেরার জন্ম দিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক জার্নাল সেলে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন থেকে ভ্রূণের স্টেম সেল ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রাণীর কাইমেরার জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্টেম সেল হলো বিশেষ ধরনের দেহকোষ। এটি অন্য দেহকোষের আকার, আকৃতি ধারণ করতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই এ ধরনের স্টেম সেল রয়েছে এবং এই স্টেম সেলগুলো আমাদের বিভিন্ন অঙ্গের মৃত বা অকার্যকর কোষের জায়গায় এসে তাকে প্রতিস্থাপন করে এবং এভাবে আমাদের সুস্থতা ও জীবনী শক্তি সুরক্ষিত হয়।

প্রাণীর কাইমেরা সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট একটি ভ্রূণে স্টেম কোষ যুক্ত করার আগে স্টেম কোষগুলো জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট রোগযুক্ত জেনেটিক মিউটেশন বহনকারী স্টেম সেলগুলো সেই মিউটেশনগুলো ছাড়াই ভ্রূণে যুক্ত করা যেতে পারে। এ কোষগুলো কীভাবে শরীর ও স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে তা এ গবেষণা থেকে জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। ‘অসীম পুনর্জন্ম’ ও পার্থক্য নিয়ে ভ্রূণের স্টেম কোষগুলো সেল থেরাপি ও অঙ্গ পুনর্জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির জীববিজ্ঞানী লিউ চেন বলেন, “ভ্রূণ স্টেম সেল চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নির্ধারক মাপকাঠি হলো যে কোষগুলো ভিট্রোতে অর্থাৎ একটি টেস্ট টিউব বা ল্যাবে গবেষণা করে ভিভোতে অর্থাৎ জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে স্থাপন করা হলে সেটি ভ্রূণের সঙ্গে বেড়ে উঠতে এবং একটি কাইমেরার সঙ্গে মিশে যেতে পারে কিনা। অতীতে, কাইমেরিক ইঁদুরগুলো বিভিন্ন গবেষণা কাজে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রথম আমরা প্রমাণ করেছি যে, প্রাইমেট স্টেম সেলগুলোও একটি কাইমেরা গঠন করতে পারে।”

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কীভাবে সাধারণ কোষগুলো জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত বা মিউটেড কোষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে, এটি বুঝতে সাহায্য করছে কাইমেরিক ইঁদুরগুলো। আর এ গবেষণাটি জৈবিক প্রক্রিয়া এবং রোগ বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইঁদুর নিয়ে গবেষণার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে বানরের ওপর এ গবেষণা অনেকটাই কাজে দেয়। কারণ ইঁদুরের শরীর ভিন্ন গঠনের হওয়ায় মানবরোগের অনেক দিক এর গবেষণা থেকে জানা যায় না। বিপরীতে, মানুষ ও বানরের শারীরিক গঠনে সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকায় বানর থেকে ভাল ধারণা পাওয়া যায়।

 

||প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

||সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

 

প্রিয় শ্রোতা, এই ছিলো আমাদের এবারের বিজ্ঞানবিশ্ব। অনুষ্ঠান কেমন লাগছে আপনাদের, তা আমাদের জানাতে পারেন। এতোক্ষণ বিজ্ঞানবিশ্বের পুরো আয়োজন জুড়ে ছিলাম আমি শুভ আনোয়ার। নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী