মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। এ সময়ে সান ফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠেয় ৩০তম এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা- এপেকে সম্মেলন যোগ দেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট, শীর্ষ বৈঠক করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে।
জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি জটিল পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত কারণেই গোটা বিশ্বের নজর এখন প্রেসিডেন্ট সি’র যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং সি-বাইডেন শীর্ষ বৈঠকের দিকে।
বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশে অংশীদার এ দুই দেশ।
রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ে কূটনীতি ক্রমবর্ধমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অপরিবর্তনীয় কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। গত নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে শীর্ষ বৈঠকে সি এবং বাইডেনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বোঝাপড়া হয়েছিল।
সে সময় প্রেসিডেন্ট সি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, চীন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জয়-জয় সহযোগিতার তিনটি নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক উপকারী সহযোগিতা এগিয় নিতে প্রস্তুত। বর্তমান পরিস্থিতিতে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কম নয়, বরং অধিক অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট সি বলেন, চীন সর্বদা বিশ্বাস করে যে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ স্বার্থ তাদের পার্থক্যের চেয়ে অনেক বেশি এবং দু’দেশের নিজ নিজ সাফল্য পরস্পরের প্রতি চ্যালেঞ্জের পরিবর্তে একটি সুযোগ।
চীন-মার্কিন সহযোগিতাকে কিছুটা জটিল মনে করলেও দু’দেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব উভয়ের এবং বৃহত্তর অর্থে বিশ্বের স্বার্থের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
কিন্তু চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নানা মোড় এবং বাঁকের মধ্যে দিয়ে গেছে। চীনের স্বার্থহানিকর মার্কিন প্রশাসনের কথা এবং কাজের কারণে দু’দেশের সম্পর্ক দুই প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত ট্র্যাক থেকে গুরুতরভাবে বিচ্যুত হয়।
তবে, চলতি বছরের জুন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডোসহ ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা পরপর চীন সফর করেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য চীনের বিশেষ দূত সিয়ে চেনহুয়া এবং তার মার্কিন সমকক্ষ জন কেরির মধ্যে আলোচনা ইতিবাচক ফলাফল এনেছে। দুই দেশ অর্থনৈতিক ও আর্থিক ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং অন্যান্য বিনিময় প্রক্রিয়া স্থাপন করেছে।
অক্টোবরের শেষ দিকে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং মার্কিন রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা করেন। চীন-মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ে চীনের প্রধান ব্যক্তি উপ-প্রধানমন্ত্রী হ্য লিফেং ৮ থেকে ১২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
প্রথমবারের মতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য সমাপ্ত ষষ্ঠ চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় (সিআইআইই) একটি উচ্চ-পর্যায়ের সরকারী প্রতিনিধিদল পাঠায়। এভাবে দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থিতিশীল হওয়ার ইতিবাচক লক্ষ্মণ দেখিয়েছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভিত্তি মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে নিহিত। চীন সফররত মার্কিন উদ্যোক্তাদের থেকে "বন্ড উইথ কুলিয়াং: ২০২৩ চায়না-ইউ.এস পিপল-টু-পিপল ফ্রেন্ডশিপ ফোরাম" এবং চীন সফররত ইউএস ফ্লাইং টাইগারদের প্রতিনিধিদল থেকে শুরু করে পঞ্চম চীন-ইউ.এস. সিস্টার সিটিস কনফারেন্স সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে চীনা ও আমেরিকান জনগণ সদিচ্ছা ও গভীর বন্ধুত্ব দেখিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতায় উদ্দীপনা জাগিয়েছে।
অদূর অতীতের এ সব কার্যকলাপ এটা প্রমাণ করেছে যে, পারস্পরিক উপকারী সহযোগিতা এবং জনগণের মধ্যে বিনিময় চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নের চাবিকাঠি ও একটি শক্তিশালী চালিকা শক্তি।
সি-বাইডেন আসন্ন শীর্ষ বৈঠক এবং এপেকে প্রেসিডেন্ট সি’র উপস্থিতি বিশ্ববাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে, এশিয়া প্যাসিফিক এবং বিশ্বের ভালোর জন্য তাদের সম্পর্ককে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনবে বলে ব্যাপকভাবে আশা করা হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার পদজাদজারান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহযোগী অধ্যাপক তেউকু রেজাস্যাহ-এর দৃষ্টিতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন যে পারস্পরিক উপকারী প্রকল্পগুলোকে উন্নীত করেছে তা চীনের সাধারণ সমৃদ্ধির অন্বেষণের একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য।
অক্টোবরে বেইজিংয়ে বিআরআই ফোরামে প্রেসিডেন্ট সিও স্পষ্ট বলেছেন, চীন যে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে তা কেবল চীনের জন্য নয়, যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের জন্যই এ উদ্যোগ।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের পরিচালক জেফ্রি শ্যাস বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশকে শক্তিশালী করবে এবং সঙ্গত কারণেই বিশ্বকেও উপকৃত করবে’।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।