বিশ্বের প্রথম চা বিষয়ক সাংস্কৃতিক অবৈষয়িক ঐতিহ্য: চিং মাই শান
2023-11-08 11:44:31


সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৪৫তম বিশ্ব অবৈষয়িক ঐতিহ্য সম্মেলনে চীনের পু এ্য (Puer) চিং মাই শান পাহাড়ের চায়ের বনকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক অবৈষয়িক ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এটি বিশ্বের প্রথম চা বিষয়ক সাংস্কৃতিক অবৈষয়িক ঐতিহ্য। চিং মাই শান পরিবেশগত জ্ঞানের বিষয়ে পূর্ণ একটি পাহাড়, যেখানে চা গাছ ও মানুষ জমিতে সহাবস্থান করে। চা, পাহাড় ও মানুষ এক একটি কিংবদন্তি রচনা করছে সেখানে।

চিং মাই শান পাহাড় অবস্থিত ইয়ুন নান প্রদেশের পু এ্য শহরের লান ছাং লাহু জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলার হুই মিন উপজেলায়। দশম শতাব্দী থেকে, পু লাং জাতির পূর্বপুরুষেরা বুনো চা আবিষ্কার করার পর স্থানীয় বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে অনন্য বোঝাপড়ায় পৌঁছায়। তারপর তাই জাতির মানুষের সঙ্গে বনের চা চাষের কৌশল নিয়ে গবেষণা করে। হাজার বছরের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পর এ পাহাড়ে চা নিয়ে বিশেষ এক ধরনের দৃশ্য গড়ে উঠেছে।

পাঁচটি বড় ও সুরক্ষিত প্রাচীন চায়ের বনে রয়েছে ৯টি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম এবং চায়ের বনের তিনটি প্রতিরক্ষামূলক বন। এই সব নিয়ে গঠিত সাংস্কৃতিক অবৈষয়িক ঐতিহ্যর মূল অংশ। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ঐতিহ্য গবেষণালয়ের পরিচালক চেন ইয়াও হুয়া মনে করেন, চিন মাই শান প্রাচীন চায়ের বন স্থানীয় মানুষদের হাতে সুরক্ষা এবং পাহাড় ও বনজ সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহারের প্রতিফলন। এতে প্রতিফলিত হয়, পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতিকে জানা ও সম্মান করার ভিত্তিতে প্রকৃতিকে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করেছিল।

চিং মাই শান প্রাচীন চায়ের বন সংরক্ষণ ব্যুরোর উপপ্রধান চৌ থিয়ান হং বলেন, এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত, বৃহত্তম ও প্রাচীনতম একটি কৃত্রিম প্রাচীন চায়ের বন। এর আয়তন ১ হাজার ২শ হেক্টর। এর মধ্যে ৩০ লাখের বেশি চা গাছ ৫০ বছর বা তার চেয়ে বেশি প্রাচীন এবং ১০০ বছরের চা গাছের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। প্রাচীন চায়ের বন-গ্রাম নিয়ে একটি কমিউনিটি গঠন করা হয়েছে। চায়ের বনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা প্রাকৃতিক বনের মতো এবং স্থানীয়রা চায়ের দেবতায় বিশ্বাস করে এবং তার পূজা করে। এখানকার সংস্কৃতিও অনন্য।

দূর থেকে দেখলে এটিকে বনের মতো লাগে তবে কাছে দেখলে বোঝা যায় এটি চা বাগান। বড় বড় গাছের নীচে চাষ করা হয় ২ মিটার উচু চা গাছ। চা গাছের বনে রয়েছে এক চা-দেবতা গাছ। প্রতি বছরের বসন্তে গ্রামের বাসিন্দারা চায়ের দেবতার পূজা করে। প্রাচীন চায়ের বনের কাছে পুরনো রাস্তার কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এ রাস্তা দিয়ে প্রাচীনকালে স্থানীয় মানুষেরা চা ব্যবসা ও বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করতো।

টেরাস বা সোপান আকৃতির কৃষিজমিতে চা চাষের তুলনায় চিং মাই শান পাহাড়ে চা চাষের পদ্ধতিই আরও ঐতিহ্যিক। এখানে বন-ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা সম্পুর্ণভাবে কাজে লাগে। বনে রয়েছে চায়ের গাছ, চায়ের গাছ ঘিরে গড়ে উঠেছে গ্রাম। কৃষিজমি ও অন্য উত্পাদন সব রয়েছে চা বনের বাইরে। এটি চিং মাই শানের মানুষের মূল্যবান প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা।

নুও কাং নামে একটি পুরাতন গ্রামে এখনও রয়েছে আগের শৈলী। এটি একটি তাই জাতির গ্রাম। গ্রামের সব রাস্তা গ্রামের কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত এবং গ্রামের বাইরের পাহাড়ে চা চাষ করা হয়। নুও কাং চা বনের ৯টি প্রাচীন গ্রামের অন্যতম। এখানে বাস করে ৫০০ জন অধিবাসী এবং সেখানকার ৩১৭টি বাড়ি জাতীয় পর্যায়ের পুরাকীর্তি।

স্থানীয়রা নিয়ম করেছে যে, চায়ের বনকে নিজেদের জীবনের একটি অংশ হিসেবে ভালবাসতে হবে এবং এ ঐতিহ্য এগিয়ে নিতে হবে এবং উন্নয়ন করতে হবে। গ্রামে প্রতিটি পরিবারের নিজেদের চা প্যাভিলিয়ন আছে। সেখানে বিনামূল্যে চা পান করানো হয় - একথা লেখা আছে। মালিক পু এ্য চা নিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করেন। চিং মাই শান পাহাড়ে চা স্থানীয়দের জীবনযাপনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, শেষকৃত্যানুষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, মতভেদ দূর করাসহ সব ব্যাপারেই চায়ের উপস্থিতি থাকে। স্থানীয় বিশেষ একধরনের আমন্ত্রণপত্র আছে, যার নাম ‘চা পত্র’। বিয়ে, নতুন বাড়ি নির্মাণ - যে কোনও সময়ে যদি সাহায্য লাগে তাহলে চা পাতা ও দুটি মোমবাতি দিয়ে একটি আমন্ত্রণপত্র তৈরি করা হয়। যারা এ আমন্ত্রণ পত্র পায় তারা সবসময় সাহায্যে এগিয়ে আসে।

স্থানীয়রা চা পান করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, সমাধান করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। হাজার বছর ধরে তারা এভাবে জীবনযাপন করে আসছে।

বর্তমানে আরও বেশি পর্যটক ও চা ব্যবসায়ী চিং মাই শানের নাম জানে। স্থানীয়রা চা বিক্রি, হোটেল ও পর্যটন ব্যবসা করে এবং এতে তাদের ভাল আয়ও হয়।

মাং চিং গ্রামের সাংস্কৃতিক হলে সবাই মিলে ৮০ বছর বয়সি পু লাং জাতির প্রবীণ ব্যক্তি সু কুও ওয়েনের বক্তৃতা শোনে। পাশাপাশি তার বক্তৃতা স্পিকারের মাধ্যমে সারা গ্রামে প্রচারিত হয়। সু কুও ওয়েন ছিলেন একজন শিক্ষক এবং অবসর নেওয়ার পর তিনি চিং মাই শানে ফিরে জাতীয় সংস্কৃতির উত্তাধিকার ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করেন।

বৈশিষ্ট্যময় চা সংস্কৃতি এবারের বিশ্ব অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হবার গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ মানুষ। ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে আবেদন কাজ শুরু হয়। ১৩ বছর ধরে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মান দিন দিন উন্নত হয়েছে এবং আরও বেশি যুবক গ্রামে ফিরে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ কাজে অংশ নিচ্ছেন।

একুশ বছর বয়সি পু লাং জাতির মেয়ে ইয়ে সিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর চিং মাই শানে ফিরে এসেছেন। তার পরিবারের একটি চা কারখানায় কাজ করেন তিনি। এখন তিনি ২০জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ভাজা চা, মধু চাসহ নানা চায়ের কৌশল শিখছেন।

চায়ের বাইরে পারিবারিক হোটেল, কফি দোকানসহ নানা ব্যবসাও গড়ে উঠছে। গত অক্টোবর মাসে, তাই জাতির মেয়ে সিয়ান চিন লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চা বিক্রি শুরু করেন। চায়ের বন বা চা রুমে তিনি লাইভ অনুষ্ঠান করেন। এ পর্যন্ত তিনি ৮ লাখ ইউয়ান মূল্যের চা বিক্রি করেছেন।

সু কুও ওয়েনের এখন তিনটি স্বপ্ন - প্রাচীন চায়ের বনকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্ষা করা, বিশ্বব্যাপী চীনের চা সংস্কৃতির ছড়িয়ে পড়া এবং গ্রামীণ পুরুজ্জীবনে আরও দক্ষ মানুষ লালন করা। তিনি বিশ্বাস করেন, চিং মাই শানের জন্য ভাল সময়ের মাত্র শুরু।(শিশির/রহমান/রুবি)