চিত্র ১: মান ইয়ুয়ান গ্রামের মাটির শিল্প গ্যালারির পাশে লেখক (এ এ এম মুস্তাহিদ)
বাংলাদেশের বাইরে বা বিদেশে যখন বাংলা ভাষায় কারো একটি কথা শুনতে পাই তখন সেই মুহূর্তের বর্ণনা যে কেমন হওয়া উচিত সেটি হয়ত আমি খুব একটি গুছিয়ে লিখতে পারব না তবুও চেষ্টা করব। “আমি বাংলায় গান গায়, আমি বাংলার গান গায়, আমি আবার আমাকে এই বাংলায় খুঁজে পায়।” এই গানটি ইয়ুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থীরা গেয়ে যখন শোনাচ্ছিল তখন আমার ভিতর আলাদা এক শিহরন জেগে উঠেছিল, যেটি হয়ত আমাদের ভাষার প্রতি বিদেশিদের এই সম্মানের দরুন। এবার একটু আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতাটি আমি আরো একটু গুছিয়ে লিখি।
বাংলাদেশের চীনা অ্যাম্বেসি কর্তৃক আয়োজিত “Youth Delegation Program 2023” এ অংশগ্রহণ করার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ আমি পাই। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে ২১ জনের একটি দলের সাথে আমিও ২১ সেপ্টেম্বর চীনের কুনমিং এ অবতরণ করি।
ইয়ুনান প্রদেশসহ চীনা হাইটেক পার্ক, কিছু ইন্ডাস্ট্রি ঘুরিয়ে দেখানো সহ বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব সম্পর্ক আরো জোরদার করাই ছিল এই প্রোগ্রামের মূখ্য উদ্দেশ্য।
চিত্র ২: কুনমিং বিমানবন্দরে অবতরণ
২২ সেপ্টেম্বর ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় দিনের ভিতর একটি। আমরা কুনমিং রেলওয়ে স্টেশন থেকে বুলেট ট্রেনে করে শিশুয়াবান্নার উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করি। বুলেট ট্রেনের অভিজ্ঞতাটি ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। আগের দিনের একটানা ভ্রমণের ক্লান্তিগুলো পাশের অতুলনীয় পাহাড়ি সৌন্দর্য যেন নিমিষেই কাটিয়ে দিলো আমার। ট্রেন ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে এবং তার সাথে দুপাশের পাহাড়গুলো যেন ট্রেনের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে আমার পাশ দিয়ে ছুটেই চলেছে। এগুলো দেখতে দেখতে কখন যে ৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে যায় তার হিসাব আমি মিলাতে পারিনি।
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমরা দুপুরের আহার গ্রহণ করি এবং সেখানে চীনা খাবারের স্বাদ নেবার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। একজন বাঙালি হয়ে কাঠি ধরে খাওয়ার অভিজ্ঞতাটি যেমন ছিল রোমাঞ্চকর তেমনি একদমই স্বভাবসুলভ জাতের বাহিরে।
আমাদের হোটেল থেকে মান্টিং রাজকীয় বাগান (The Manting Imperial Garden) ভ্রমণের জন্য আমরা বিকালে বের হয়ে পড়ি এবং চীনা নাগরিকরা যে কতটা পরোপকারী এবং অতিথিপরায়ণ সেটি আমরা উপলব্ধি করতে পারি । চীনা গাইড আমাদের মান্টিং উদ্যান (Manting park) ঘুরিয়ে দেখায় এবং প্রতিটির পিছনের যে এক গল্প আছে সেগুলো আমাদের জানায়। বাগানের ভিতর ঢুকেই অনেক প্রজাতির গাছ, দাঈ প্রার্থনালয় এবং সেই সময়ের অর্থাৎ দাঈ প্রাচীন স্থাপত্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়। দাঈ সম্প্রদায়ের মাঝে এক লোকগল্প প্রচলিত আছে যে, প্রথম দর্শনে দাঈ রাজা রানির রূপে মুগ্ধ হন এবং তাকে বিবাহ করেন, তারপর থেকে ঐ জায়গাটা দাঈ সম্প্রদায়ের লোকেরা যে বিবাহের জন্য শুভ জায়গা মনে করে এই ব্যাপারটা আমাকে দারুণ কৌতুহলপ্রবণ করেছিল।
চিত্র ৩: মান্টিং উদ্যানে দাঈ সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান
মান্টিং উদ্যান (Manting Park) থেকে আমরা বের হয়ে রাতের খাবার খেয়ে স্থানীয় রাতের বাজার দেখতে বের হই। বিভিন্ন মানুষ তাদের শৈল্পিক সত্ত্বার বাস্তবিক রূপ দিয়ে তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন সেখানে। অনেকটা আমাদের দেশের মেলার মত। সব ধরনের পণ্য সেখানে পাওয়া যায়। বিক্রেতারা ক্রেতাদের তাদের পণ্য দিয়ে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন, একপাশে একদল নৃত্য পরিবেশন করছে কেউ বা স্থানীয় খেলা দেখিয়ে বিনোদন দেবার চেষ্টা করছেন। এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমরা হয়েছিলাম।
রাত একটু হলেই আমরা ফিরে আসলাম আমাদের হোটেলে। হোটেলে ফেরা মাত্রই আমাদের জানানো হয় পরের দিন (তৃতীয় দিন) আমরা যাব ইয়ুনান প্রদেশের মানইউয়ান গ্রামে এবং খুব ভোরে।
চীনের এই ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে যে এখানকার মানুষগুলো সকালের প্রথম আলোয় জেগে উঠতে পছন্দ করে এবং তাদের দিনের শুরু হয় খুব ভোর থেকে। তারই সামঞ্জস্য রেখে সকালের খাবার খেয়ে আমরা বাস যোগে যাত্রা করি এই গ্রামটি দেখার জন্য।
আমরা যখন পৌঁছায় তখন যে দ্বিপ্রহর হয়েছে তার জানান দিলো মাথার উপর অবস্থান করা সূর্যটি। সূর্যের সেই তীব্র আলো মাথায় রেখে আমরা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলাম। একজন গাইড শুরুতেই আমাদের গ্রামটির সম্পর্কে ধারণা দিলেন। গ্রামটিতে দাঈ সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করেন এবং গ্রামটি খুব একটি বড় নয়, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কারণ গ্রামটিকে চারিপাশে ঘিরে আছে সুবিশাল সবুজে ঘেরা পাহাড়। গ্রামটির অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে যেগুলো আমরা আস্তে আস্তে জানতে পারি।
মূলত গ্রামটি অতি পরিচিত হওয়ার পিছনে রয়েছে তাদের বাঁশের শিল্প, চা এবং মাটির সুনিপুণ কারুকার্য খচিত শিল্পকর্ম। আমি শুনে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম যে, এত বিশাল বাগান সাথে এত প্রজাতির গাছ, কিন্তু কেউই একটি গাছের পাতা ছিঁড়ছে না। এই রীতিটি তারা গত ৫০০ বছর ধরেই অনুসরণ করে এসেছেন। কল্পনা করা যায়? এত বিশাল বাগান, যেখানে একটা গাছের পাতা কেউ ছিঁড়ছে না..!! আপনি খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে তারা (দাঈ সম্প্রদায়) কতটা তাদের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এবং তাদের ঐতিহ্যকে তারা কতটা সম্মান এবং নিজেদের ভিতর লালন করেন যত্ন সহকারে।
চিত্র ৪: লেখক ও স্থানীয় মাটির কারিগর
স্থানীয় মাটির কারিগরদের সাথে আমরা সবাই নিজ হাতে তাদের সহযোগিতায় মাটির বিভিন্ন জিনিস বানানোর চেষ্টা করি। বলা বাহুল্য যে, আমরা শত চেষ্টা করেও তাদের ধারে কাছেও যেতে পারিনি। তাদের উৎপাদিত ফল খেয়ে আমরা আমাদের নতুন হোটেলে ফিরি এবং বিকালে শিশুয়াবান্না বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখার জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমরা ভাবতেও পারিনি আমরা কতটা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সাক্ষী হতে যাচ্ছি।
ছোট্ট একটি গাড়ি করে আমরা বের হয়ে পড়ি এবং বাগানের বিভিন্ন জায়গা আমরা দেখতে থাকি। বিভিন্ন দেশের পর্যটক এসেছেন এখানে, কেউবা তাদের মুঠোফোনে ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউবা এই নয়নাভিরাম বাগান দেখছেন, কেউবা গাছ তলায় বসে তাদের ক্লান্তি দূর করছেন হাতে এক পানীয় নিয়ে আবার কেউবা বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিভিন্ন গাছ দেখছেন।
আমরা যে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হব তা বোঝার সময় না দিয়ে এগিয়ে যায় আরেকটু সামনে এবং চীন তুমি যে কত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী তা আমরা একটু আঁচ করতে পারলাম। আমাদের সামনে ছিল বিভিন্ন ফুলের বাগান। লাল ফুল, উপরে নীল আকাশ, পাশে নাম না জানা এক বিশাল গাছ এবং সুদূরে বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়..! এত বৈচিত্র্যপূর্ণ দৃশ্য দেখে আমি কিছুক্ষণের জন্য সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম এই পাহাড়ি রূপে।
চিত্র ৫: শিশুয়াবান্না বোটানিক্যাল গার্ডেন
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও হোটেলে ফিরি আমরা। হোটেলটি বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর হওয়ার কারণে আমরা রাতে আবার সবাই মিলে বাগানের ভিতর যায় এবং রাতের চাঁদের সহিত ভাব জমিয়ে গিটারের সুরে আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশীয় কিছু গান সম্মিলিত সুরে গেয়ে রাতের অবিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করি।
চতুর্থদিন সকালে আবার আমাদের কুনমিং এ ফেরত যেতে হয় বুলেট ট্রেনে করে। গতবার একইভাবে এসেছিলাম এই বুলেট ট্রেনে, কিন্তু গতবার সবাই দুপাশের সৌন্দর্য্যতে এতটাই সম্মোহিত হয়েছিল যে ট্রেন ভ্রমণের আরেকটি বিষয় বাদ পড়ে যায়। সেই অপুর্ণটি পূর্ণতায় রুপদেন আমাদের উৎস ভাই। তিনি তার গিটারে সুর তুলেন চীন দেশের এই বুলেট ট্রেনে। তিনি চীনা যাত্রীদের ভিড়ের ভিতর গেয়ে উঠেন, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” তার সাথে আমরাও গেয়ে উঠি এবং পাশে বসা চীনা নাগরিকরা আমাদের এই জাতীয় সঙ্গীত উপভোগ করেন। এভাবেই আমরা ৪ ঘণ্টা দুপাশের পাহাড় এবং গান দিয়ে পার করে পৌঁছে যায় আমাদের গন্তব্যে।
পঞ্চমদিনটি ছিল অল্প বৃষ্টিস্নাত এবং আরেকটি সুন্দর দিনের সাক্ষী হতে যাওয়ার দিন। আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল ইয়ুনান বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইয়ুনান মিনঝু বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম যে ইয়ুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছে। তবে আমরা এটা কখনো ভাবতেও পারিনি তারা এত সুন্দর করে বাংলাতে কথা এবং গান পরিবেশন করতে পারবে। আমাদের সবাইকে অবাক করে তারা গেয়ে উঠে, “ আমি বাংলায় গান গায়, আমি বাংলার গান গায়।” আমরা সবাই তাদের বাংলা ভাষায় গান শুনে এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে আমরা সবাই ওদের দিকে সম্মানের সহিত তাকিয়েই ছিলাম। আমরা সবাই চীনা শিক্ষার্থী এবং চীনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে কুশল বিনিময় এবং পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখি। এটি ছিলো এক অন্যরকম ভালো লাগার গল্প। ওইখান থেকে ফিরে আমরা যায় ইয়ুনান মিনঝু বিশ্ববিদ্যালয়। এটি মূলত চীনের সংস্কৃতি চর্চার বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে স্বাগতম জানায় এবং চীনের সংস্কৃতি বিষয়ে এবং ইয়ুনান প্রদেশের উন্নতির জন্য তারা কি অবদান রাখছেন সেটি আমাদের সামনে তুলে ধরেন। তাদের সংস্কৃতি বিষয়ক সংরক্ষনশালা ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি আমাদের জন্য তারা এক সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীরা তাদের স্থানীয় গান, ঐতিহ্যবাহী নৃত্য এবং বাংলা ভাষায় গান পরিবেশন করে আমাদের শোনায়। আমরা সবাই তাদের আতিথেয়তায় অনেক মুগ্ধ হয়েছি।
চিত্র ৬: ইয়ুনান মিনঝু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষনশালার ইয়ুনানের নৃজাতিগোষ্ঠীর প্রতিকৃতি
তারপরে আমরা আবার যাত্রা আরম্ভ করি ইয়ুনান কৃষক প্রধান কার্যালয়(Yunnan Farmer Headquaters) দেখার জন্য। সেখানে গিয়ে তারা কীভাবে তাদের কৃষি পণ্য বিক্রি করছে,কীভাবে তারা পণ্য সংগ্রহ করে আমাদের দেখায়। দিনের সকল কার্যক্রম শেষ করে আমরা ফিরি আমাদের হোটেলে পরবর্তী দিনের প্রস্তুতি নিতে।
৬ষ্ঠ দিনে আমরা High Tech Industrial Development Zone, Yunnan Additive Manufacturing Industry Innovation Center সহ BeiDou Navigation Satellite System দেখার সৌভাগ্য হয়। চীন যে প্রযুক্তি দিয়ে কতটা অগ্রসর তার ধারনা আমরা পাই।
চিত্র ৭: Yunnan Additive Manufacturing Industry Innovation Center কর্তৃক 3D প্রিন্টেড বিলুপ্তপ্রায় প্রানীর মাথা
এবং বিকালে আমরা Yunnan Foreign Affairs Office এ মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহন করি। তাদের সাথে আমরা আমাদের চীন ভ্রমনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করি এবং স্থানীয় একটি সংগীত উপভোগ করি।
চিত্র ৮: মতবিনিময় সভার সঙ্গীতের স্থিরচিত্র
চীনের নাগরিকদের আতিথেয়তায় আমরা সবাই মুগ্ধ হয়েছি, চীনের অপরুপ সৌন্দর্য আমাকে ও আমার সঙ্গী সাথীদের এতটাই মুগ্ধ করেছে যে চীন ছাড়ার সময় প্রায় সবাই বলে উঠেছিলো চীনে কাটানো দিনগুলো আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে। আমি চীনে অবস্থানরত সময়ে আমাদের দেখাশোনা যারা করেছেন বিশেষ করে “সু ইয়ুমিন” এবং “মু হাও” কে আমরা সবাই মনে রাখব। তারা এতটাই আমাদের সকল বিষয় খেয়াল রেখেছিলেন যে আমাদের কোন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আগেই তারা সমাধান করে দিতেন। আমরা তাদের উপর অনেক কৃতজ্ঞ থাকব। আর এটা বলেই শেষ করতে চাই যে, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরো জোরদার হোক।
এ এ এম মুস্তাহিদ
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল প্রযুক্তি বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
ঢাকা, বাংলাদেশ