পিতামাতার বকাঝকা বাচ্চাদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ
2023-11-06 16:00:28

আজকের অনুষ্ঠানে চীনা পিতামাতাদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের, বিশেষ করে শিশু-সন্তানদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু আলোচনা করবো। অনেক মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের বাবা-মারা প্রায়শই একটি অভিযোগ করেন যে, বাচ্চা দিন দিন বড় হয়, আর তাদের পিতামাতার সাথে কথা বলার সময় দিন দিন কমে। তা ছাড়া, বেশি কথা বললে সহজে ঝগড়া করে এবং কখনও কখনও পিতামাতার সঙ্গে বাচ্চার কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে যায়, সাময়িকভাবে হলেও। বলা যায় বাবা-মা ও বাচ্চা একে অপরের অনেক কাছের হলেও, ধীরে ধীরে যেন পরস্পরের কাছে অপরিচিত হয়ে যায়।

 

বস্তুত, বাচ্চারা ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে বেশ পছন্দ করে। এটি মানবস্বভাবের অংশ। তবে বাচ্চা বড় হওয়ার পর যদি বাবা-মা সবসময় তাদের লেখাপড়া বা জীবনপদ্ধতি নিয়ে বকাঝকা করেন, তাহলে বাচ্চারা পিতামাতার সাথে কথাবার্তায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বা নিদেনপক্ষে কমিয়ে দেয়।  প্রশ্ন হচ্ছে: কী বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আলাপ করলে পিতামাতার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হতে পারে? কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আন্তরিক ও মজার আড্ডা পিতামাতা ও বাচ্চার সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক। সেক্ষেত্রে বাচ্চা পিতামাতার সঙ্গে বেশি কথা বলবে।

 

কেন বাচ্চাদের সাথে এমনি এমনি আড্ডা করতে হবে? এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘকাল ধরে বাচ্চাদের সাথে তাদের প্রিয় বিষয় নিয়ে আড্ডা দিলে, কথা বললে, পিতামাতা ও বাচ্চার সম্পর্ক উন্নত হয়। বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ছিয়ান চি লিয়াং মনে করেন, পিতামাতা ও বাচ্চার আড্ডার সময় বাচ্চারা আনন্দ পায়। তখন পিতামাতার প্রতি তাদের আস্থা বাড়ে, আগ্রহ বাড়ে। এ অবস্থায় বাচ্চারা আরো সহজে পিতামাতার সাথে মনের কথা বিনিময় করে বা করতে আগ্রহী হয়। বাচ্চারা তাদের চিন্তাভাবনা ও স্কুলে সম্মুখীন বিভিন্ন সমস্যা বা অন্যদের সাথে সম্পর্ক মোকাবিলার প্রশ্নসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করতে চায়। এভাবে আড্ডার মাধ্যমে বাচ্চাদের সমস্যা বা মনের কথা বুঝতে পারেন বাবা-মা। যদি বাচ্চার কোনো মানসিক সমস্যা থাকে, তাহলে সহজে তা ঠিক করারও সুযোগ তাতে সৃষ্টি হয়।

 

পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সুসম্পর্কের আরেকটি পূর্বশর্ত আছে, আর সেটি হল: মনোযোগ দিয়ে বাচ্চার কথা শুনতে হবে। যদি বাচ্চারা ছোট বা বড় যে-কোনো বিষয়ে বাবা-মার সাথে তথ্য বিনিময় করে, তাহলে তাদের বড় হওয়ার পথে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

 

বস্তুত, পিতামাতার বকাঝকা আসলে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।  চীনের সুবিখ্যাত লেখক চু জি ছিং ‘বকাঝকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, জীবনে সবসময় তত্ত্ব বা নীতিকথা বিরক্তিকর। কেবল বকাঝকা ও আড্ডা জীবনে আনন্দ বয়ে আনতে পারে। মনোবিজ্ঞান গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি একজনের কথায় ৯০ শতাংশ আড্ডার আমেজ থাকে, তাহলে তিনি সহজে জীবনের সুখ অনুভব করতে পারেন। যদি আড্ডার আমেজ  ৫০ শতাংশের চেয়ে কম হয়, তবে সুখের অনুভূতি সহজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই বাচ্চাদের সাথে সবসময় আড্ডা করা পিতামাতা ও বাচ্চার সাথে সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক এবং পরস্পরের সুখ বাড়িয়ে দিতে পারে।

 

মাস্যাচুসেট্স ইন্সটিটিউ অফ টেকনোলজি (এমআইটি)-র একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, বাচ্চা যত বেশি বাবা-মায়ের সাথে কথাবার্তা বলে, তাদের মস্তিষ্কের ভাষাসংশ্লিষ্ট অংশের কর্মতত্পরতা তত শক্তিশালী হয়। বাচ্চাদের সাথে বেশি আড্ডা দিলে, কথাবার্তা বললে, তার নতুন শব্দ জানার গতিও বাড়ে। এতে তাদের মৌখিক ভাষা ও শ্রবণক্ষমতার উন্নয়নে সহায়ক। এতে তাদের আইকিউও বৃদ্ধি পায়। বাচ্চাদের গণিত শেখার দক্ষতা, ইচ্ছাশক্তি, আত্মশৃঙ্খলা ও সহমর্মিতা তাদের ছোটবেলায় শোনা শব্দমালার সাথেও জড়িত। যদি আড্ডায় মজার গল্প ও দৃশ্য বর্ণনা করা হয়, তাহলে তাদের কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়বে।

 

আড্ডাও এক ধরনের শিক্ষা। এ শিক্ষা বাচ্চারা সহজে গ্রহণ করতে পারে। বাচ্চাদের অনুভূতি ও আবেগ যথন পিতামাতার কাছ থেকে যথাযথ প্রতিক্রিয়া পায়, তাদের প্রশ্নের উত্তর যখন তারা পিতামাতার কাছ থেকে পায়, তখন তাদের মানসিক চাপ কমে। বাচ্চা সবসময় হাসিখুশি থাকলে তার বহিঃপ্রকাশও দেখা যায়, যা পিতামাতার জন্য আনন্দদায়ক। এতে বাচ্চাদের মেজাজ সুন্দর ও স্থিতিশীল হয়, চরিত্র হয় উন্মুক্ত।

 

তাহলে কিভাবে বাচ্চাদের সাথে আড্ডা দেওয়া উচিত? সেটি অনেক বাবা-মায়ের জন্য কঠিন ব্যাপার। বয়সের ব্যবধানের কারণে বাবা-মা ও বাচ্চার প্রিয় বিষয় ও চিন্তাভাবনায় ব্যাপক পার্থক্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় কিভাবে বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে হবে, সেটি বাবা-মার জন্য একটি পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ বটে। যেমন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসার পথে বাচ্চার কাছ থেকে স্কুলের গল্প শোনা, স্কুলের কাছাকাছি ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় দোকানে তার জন্য কিছু মিষ্টি বা হালকা খাবার কেনা, কে কে ক্লাসে শিক্ষকের প্রশংসা পেয়েছে তা জানা, স্কুলে আসা নতুন শিক্ষকের চরিত্র কেমন সে সম্পর্কে বাচ্চার কাছ থেকে শোনা, ইত্যাদি। অধ্যাপক ছিয়ানের দৃষ্টিতে, পিতামাতা বাচ্চাদের কথা শুনতে আগ্রহী হলে, বাচ্চাদের বর্ণনা থেকে তার স্কুলের জীবনযাপন, মানসিক অবস্থা ও স্কুলের বন্ধুদের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারেন। এসব আড্ডা বস্তুত বাচ্চার মনের দুয়ার খুলে দেয়। বাবা-মা নিজেদের শিক্ষাতত্ত্ব ও মতামত এসব আড্ডার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন এবং এভাবে বাচ্চারা আরও সহজে তা গ্রহণ করতে পারে। পিতামাতা ও বাচ্চার সাথে ঘনিষ্ঠ  সম্পর্কের ভিত্তি বাচ্চার জন্য পিতামাতার সহনশীলতা ও ভালোবাসা।

 

আরেকটি টিপস তিনি দিয়েছেন। বাচ্চারা যখন স্কুলের জীবনযাপন বা সহপাঠীদের গল্প শেয়ার করে, তখন বাবা-মাকে মনোযোগ ও ধৈর্যের সাথে তা শুনতে হবে। যদি মনোযোগ না দেন, শুধু মুখে হু হা করেন, তবে বাচ্চা মজা পাবে না, কথা বলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। মনোযোগ দিয়ে বাচ্চার কথা শুনলে তার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাবে।

 

আড্ডার সময় বাবা-মার শরীরী ভাষাও গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার চোখে চোখ রাখা, বাচ্চাকে স্পর্শ বা আলিঙ্গন করা, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার অনুভূতি অনুভব করা বা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সমালোচনা ও পর্যালোচনার কথা যত কম তত ভালো। যখন বাচ্চা তার কথার প্রতি বাবা-মার আগ্রহ অনুভব করে, তখন তার আত্মপ্রকাশের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তখন বাচ্চারা পিতামাতার পরামর্শ বা প্রস্তাবও শুনতে চায়, পিতামাতার পারিবারিক শিক্ষার নির্দেশনা মেনে চলতে আগ্রহী হয়।

 

বাচ্চার সাথে কথা বলার সময় সহজ-সরল ভাষা ব্যবহার করতে হবে। বিমূর্ত বর্ণনা এড়িয়ে চলতে হবে। বাচ্চারা যদি পিতামাতার কথা বুঝতে না পারে, তবে তারা কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। পিতামাতা যখন বাচ্চার সাথে আড্ডা দেন, তখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা ভালো। যেমন, স্কুলের গ্রন্থাগারে কোনো মজার বা আকর্ষণীয় বই রয়েছে কি না, ইত্যাদি। এমন  প্রশ্নের জবাবে বাচ্চা অনেক কথা বলতে পারে। যদি শুধু তাকে জিজ্ঞেস করেন স্কুলে কেমন সময় কেটেছে? সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক কেমন? তাহলে সে খুব সহজ উত্তর দেবে।

 

তা ছাড়া, বাবা-মা কিছু উন্মুক্ত প্রশ্ন করে বাচ্চাদের সাথে আড্ডা করতে পারেন। যেমন সাপ্তাহিক ছুটিতে বাচ্চারা বাইরে ঘুরে বেড়াতে চায়। এর আগে হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করতে হবে। তার সাথে শনিবারের আগে লেখাপড়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং ঘুরে বেড়ানোর জায়গা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। পাশাপাশি বাইরে ঘুরে বেড়াতে কী কী প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে নিতে হবে, এ নিয়েও আলাপ হতে পারে। এতে বাচ্চার চিন্তার ক্ষমতা ও ভাষা প্রকাশের দক্ষতা বাড়বে।

 

বাচ্চারা পিতামাতার জীবনযাপনের প্রতি কৌতুহলী হবে এটা স্বাভাবিক। বাবা-মার কর্মস্থলের পরিবেশ ও কাজের বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের আগ্রহ থাকে। পিতামাতা সেসব তথ্য শেয়ার করতে পারেন।এমন আড্ডার মাধ্যমে  পিতামাতার সাথে বাচ্চার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে।

 

যে-কোনো বয়সের বাচ্চা কোনো-না-কোনোভাবে সমস্যা বা বিরক্তিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে। বাবা-মার উচিত নিয়মিত বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা, তাদের মানসিক অবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। এভাবে যদি বাচ্চাদের কোনো মানসিক সমস্যা থাকে তাহলে সে সম্পর্কে পিতামাতা সহজে জানতে পারেন।

 

বাবা-মা নিজেদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা বা অচলাবস্থা নিয়ে বাচ্চার সাথে কথা বলতে পারে। কারণ, এভাবে তারাও বাচ্চার কাছ থেকে সমস্যা বা ত্রুটিসংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে পারবে। বাবা-মা আন্তরিকভাবে নিজের দোষ বা দুর্বলতা তুলে ধরলে, বাচ্চাও নিজের দোষ বলতে ভয় পাবে না। যদি তারা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন বাবা-মার কাছ থেকে সমর্থন পেতে আগ্রহী হকে।

 

মাধ্যমিক স্কুলের আগে বাচ্চারা পিতামাতার ওপর বেশ নির্ভরশীল থাকে। এসময় বাবা-মা বাচ্চাদের যত বেশি সময় দেন, তত ভালো। এভাবে বাচ্চারা সুখী পারিবারিক আমেজ অনুভব করতে পারে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)