বিজ্ঞানবিশ্ব ৪৩তম পর্ব
2023-11-06 15:07:28

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৪৩তম পর্ব যা থাকছে:

 

* বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম সূর্য

* প্রাচীন চীনা গ্রন্থ অনুবাদে সক্ষম মেশিন তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসায় চীনা বিজ্ঞানীদের নতুন কৌশল উদ্ভাবন

 

বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম সূর্য

বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বা আইটিইআর। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের মতো পরিষ্কার আলো ও তাপ নির্গমন এবং কার্বন-মুক্ত শক্তি উৎপন্ন করতে পারে বলে একে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘কৃত্রিম সূর্য’ বলা হচ্ছে। সম্প্রতি আইটিইআর প্রকল্পের মূল উপাদান চুম্বকের সর্বশেষ সরবরাহ দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের কুয়াংচৌ শহর থেকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়।

আইটিইআর একটি আন্তর্জাতিক মেগা প্রকল্প। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। দেশগুলোর আশা, সূর্যের শক্তি উৎপন্নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বিপুল শক্তি উৎপাদন সম্ভব। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব চুম্বক চীন সরবরাহ করছে। ফ্রান্স-ভিত্তিক এ প্রকল্পের জন্য চুম্বকের এ সরবরাহটি একটি মৌলিক পদক্ষেপ।

বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মূলত নিউক্লিয়ার ফিউশন ব্যবহার করে এ কাজ করছেন। এ প্রক্রিয়ায় নিউক্লীয় বিক্রিয়া ঘটিয়ে একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস সংযোজন করে তুলনামূলক ভারী নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় বিপুল শক্তি। মূলত সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশনের প্রক্রিয়া অনুকরণ করছেন ওই বিজ্ঞানীরা।

বর্তমানে প্রকল্পের নির্মাণের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। পুরো এই সিস্টেমটির ওজন ১ হাজার ৬০০ টনেরও বেশি। ২০১৮ সাল থেকে আইটিইআরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশনের (সিএনএনসি) অধীনে সাউথ ওয়েস্টার্ন ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্স আইটিইআর প্রকল্পের জন্য মোট ৩৩ ব্যাচ প্রোডাক্ট সরবরাহ করেছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্লাজমা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ফিউশনের সময় তৈরি হওয়া উচ্চ-শক্তি নিউট্রন ব্যবস্থাপনা।

 

চুম্বক সরবরাহ প্রকল্পের কর্মকর্তা লি পেংইউয়ান বলেন, “চুম্বক সাপোর্টিং সিস্টেমটি মূলত পারমাণবিক ফিউশনে সুপারকন্ডাক্টিং চুম্বককে সাপোর্ট দেয়, যা একটি বাড়ির মেরুদণ্ডের মতো। এই চুম্বকগুলো আইটিইআর চুল্লির নিরাপত্তা, লোড বহন এবং সব ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বল প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করবে। চীন প্রকল্পটির গবেষণা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ১৮টি কাজ হাতে নিয়েছে, যা পুরো প্রকল্পের ৯ শতাংশ।”

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে চীন এই মেগাপ্রজেক্টে যোগ দেয় এবং এর বাস্তবায়নের জন্য বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করছে দেশটি। এর মধ্যে রয়েছে সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট সিস্টেম, বড় আকারের কয়েল পাওয়ার সাপ্লাই সিস্টেম এবং ডায়াগনস্টিক সিস্টেম। এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার জন্য দেশটি ইতোমধ্যেই ১০০ জনেরও বেশি চীনা বিজ্ঞানীকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছে।

 

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

প্রাচীন চীনা গ্রন্থ অনুবাদে সক্ষম মেশিন তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

চীনা ভাষা শেখা বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা মনে করেন আধুনিক চীনা ভাষা বোঝা অনেক কঠিন। তবে এর থেকে অনেক বেশি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং প্রাচীন পাঠ্যগুলোর চীনা ভাষা, এমনকি স্থানীয় চীনা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর পক্ষেও সেগুলোর পাঠোদ্ধার করা বেশ কষ্টসাধ্য।

সম্প্রতি সাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একদল গবেষক এই কাজটিকে সহজ করেছেন। দলটি একটি ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত ভাষা মেশিন’ তৈরি করেছেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাচীন চীনা পাঠ্যকে আধুনিক ভাষায় অনুবাদ করে দিতে পারে।

চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ম্যাকাওয়ে সেপ্টেম্বরে ‘মেশিন ট্রান্সলেশন সামিট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘ইন্টারন্যাশনাল এনসিয়েন্ট চাইনিজ মেশিন ট্রান্সলেশন’ প্রতিযোগিতায় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত ভাষা মেশিন’ তৈরির জন্য প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন একদল গবেষক। তাদের তৈরি করা এ মেশিনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাচীন চীনা পাঠ্যকে আধুনিক ভাষায় অনুবাদ করে দিতে পারে। পাশাপাশি মানুষকে চীনা ইতিহাস বুঝতে এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির প্রচারেও সাহায্য করবে।

বিশাল এ সিস্টেমের জন্য শক্তিশালী কম্পিউটিং ক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। গবেষণার সময় দলটিকে এ কঠিন বাধা অতিক্রম করতে হয়। মেশিন ট্রান্সলেশনের অর্থ হলো ক্লাসিক চীনা পাঠ্যে আগ্রহীদের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর অর্থ বোঝার জন্য একটি সুবিধাজনক উপায় বলে দেওয়া।

গবেষণা কাজে নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক চিন লিয়ানওয়েন বলেন, “সিস্টেমটি মানুষকে চীনা ইতিহাস বুঝতে এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির প্রচারে সাহায্য করবে। এটি ডেটা মাইনিং, বিশ্লেষণ এবং প্রাচীন পাঠ্য ও ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে সক্ষম। একটি সহযোগী কোম্পানির কাছ থেকে গবেষকদল একাধিক গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট সার্ভার পেয়েছে।”

চিনের দল এমন একটি সিস্টেমও তৈরি করেছে, যা ছবিগুলোতে থাকা প্রাচীন চীনা পাঠ্যকে চিনতে এবং বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রমানুসারে একই পাঠ্যগুলো সনাক্ত করতে এবং সাজাতে পারে। পরবর্তীতে উল্লিখিত ভাষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে পাঠ্যগুলোতে বিরামচিহ্ন যুক্ত করতে এবং আধুনিক চীনা ভাষায় অনুবাদ করতে পারে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

 

পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসায় চীনা বিজ্ঞানীদের নতুন কৌশল উদ্ভাবন

ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছেন, কথা বলছেন বা চিৎকার করছেন - এ ধরনের আজগুবি কোনো কাজ করলে, তখন বুঝতে হবে আপনার শরীর পারকিনসন্স রোগের পূর্বাভাস দিচ্ছে। কোনও পূর্বাভাস পেলে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসায় একটি নতুন নিউরোমোডুলেশন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় এটি একটি নতুন পদ্ধতি।

পারকিনসন্স রোগটি মূলত মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতির কারণে দেখা দেয়। ব্রেনের মধ্যে ছোট একটা অংশ রয়েছে, যেটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় 'সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা' বলা হয়। এই অংশের স্নায়ুকোষ বা নিউরন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার (এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ) নষ্ট হয়ে যায় অথবা এর ঘাটতি দেখা দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায় মস্তিষ্কে ব্যাজাল গ্যাংলিয়া নামের একটি অংশ মানুষের চলাফেরা এবং গতির সমন্বয় করে থাকে। ডোপামিনের অভাবে সেই সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তখন একজন মানুষ আক্রান্ত হয় পারকিনসন্স রোগে।

এ রোগের চিকিৎসায় একটি নতুন নিউরোমোডুলেশন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একাডেমিক জার্নাল ‘সেলে’ এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। নিউরোমোডুলেশন হলো এমন একটি প্রযুক্তি যা সরাসরি স্নায়ুর উপর কাজ করে। এটি একটি টার্গেট এলাকায় (স্নায়ুতন্ত্রে) সরাসরি বৈদ্যুতিক প্রবাহ বা ওষুধ সরবরাহ পৌঁছে দেয়।

একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে একপাশে হাল্কা অবশ অনুভূতি ছাড়া সেভাবে লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে ধীরে ধীরে রোগ বাড়তে শুরু করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপ হয়। রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের হাঁটা এবং কথা বলায় অসুবিধা হয় এবং রোগী নিজে কিছুই করতে পারেন না। তখন রোগীকে হুইলচেয়ারে রাখতে হয় অথবা তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

এছাড়া চিকিৎসকরা বলছেন, পারকিনসন্স রোগে ভুগলে একপর্যায়ে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হতে পারে। তবে স্মৃতিভ্রম অর্থাৎ ভুলে যাওয়া বা ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। এই রোগ পুরুষদের বেশি হয়। ৫০ এর বেশি বয়সীদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে জেনেটিক কারণে হলে অনেক কম বয়সে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সেও এই রোগ হতে পারে।

এ রোগের প্যাথোজেনেসিস (রোগের উৎস) এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এটি ডোপামিন ডি১ এবং ডি২ রিসেপ্টরে হতে পারে। যদিও পরে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ডোপামিন ডি১ এবং ডি২ রিসেপ্টরগুলো যথাক্রমে একটি গাড়ির অ্যাক্সিলারেটর ও ব্রেক এর মতো কাজ করে।

মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে এবং অন্যান্য নিউরনের কার্যকারিতা প্রভাবিত না করে ডোপামিন ডি১ রিসেপ্টরগুলোকে বিশেষভাবে মডিউল করা সহজ নয়।

চীনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির অধীন শেনচেন ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজির ব্রেন কগনিশন অ্যান্ড ব্রেন ডিজিজ ইন্সটিটিউট একটি নতুন নিউরোমোডুলেশন কৌশল উদ্ভাবন করেছে। নতুন এ কৌশলটির মাধ্যমে যেখানে ডোপামিন ডি১ রিসেপ্টর রয়েছে সরাসরি সেই পথকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এবং পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্ক কিংবা শরীরের অন্য ডোপামিন পথকে প্রভাবিত না করে শুধুমাত্র রোগাক্রান্ত অংশের চিকিৎসা করা হয়।

দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের শেনচেন শহরের ব্রেন কগনিশন অ্যান্ড ব্রেন ডিজিজ ইন্সটিটিউটের গবেষণা ফেলো লু চোহুয়া বলেন, “এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় আমাদের এ কৌশলটি স্পেশাল টার্গেটেড চিকিৎসা পদ্ধতি।”

চীনা বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত নতুন এ নিউরোমোডুলেশন চিকিৎসা পদ্ধতিটি বিভিন্ন প্রাণীর শরৗরের প্রয়োগ করে সফলতা পাওয়া গেছে। এটি পারকিনসন্স রোগ এবং অন্যান্য স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধিগুলোর চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের সূচনা করবে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

 

||প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

||সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রিয় শ্রোতা, এই ছিলো আমাদের এবারের বিজ্ঞানবিশ্ব। অনুষ্ঠান কেমন লাগছে আপনাদের, তা আমাদের জানাতে পারেন। এতোক্ষণ বিজ্ঞানবিশ্বের পুরো আয়োজন জুড়ে ছিলাম আমি শুভ আনোয়ার। নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী