দেহঘড়ি পর্ব-০৪৩
2023-11-05 14:45:27

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

ডায়াবেটিক ফুট আলসার চিকিৎসায় খুব কার্যকর টিসিএম

ডায়াবেটিক ফুট আলসার হলো পায়ের এক ধরনের ক্ষত, যাতে ডায়াবেটিস রোগীরা আক্রান্ত হয়। উপাত্ত বলছে, ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায় ১৫ শতাংশ ডায়াবেটিস-ঘটিত পায়ের ক্ষততে ভোগে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক ফুট আলসার জটিল আকার ধারণ করতে এবং গ্যাংগ্রিনে পরিণত হতে পারে। ডায়াবেটিক ফুট আলসার চিকিৎসায় চীন ও অন্যান্য এশীয় দেশগুলোতে প্রাচীনকাল থেকে ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

টিসিএমে নিজস্ব ফিজিওলজি ও প্যাথলজি রয়েছে। প্রাচীন টিসিএম তত্ত্ব অনুসারে, ডায়াবেটিক ফুট আলসারের কারণ ও প্রক্রিয়া জটিল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও ঠান্ডা শক্তি ‘ইয়িন’র ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সমস্যার প্রধান প্যাথোজেনিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সুয়ে ইয়ু’ বা রক্তের স্থবিরতা এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধা; শি চুও বা ক্লেদ ও আলসার; এবং র‌্য তু বা তাপ বিষ।

চীনা ভেষজ ফর্মুলা সব সময় প্রাথমিক থেরাপি হিসাবে বিবেচিত হয় এবং প্রায় সব ধরনের রোগের জন্য ক্লিনিকাল অনুশীলনে বেশ ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়। টিসিএমের অন্তর্নিহিত ধারণা হলো শরীরে ইয়িন-ইয়াং ভারসাম্য, যার মধ্যে সমন্বয়ের থাকতে হয় সুস্থতার জন্য। চীনা ভেষজ সূত্রে বেশ কিছু উপাদান রয়েছে, যা শরীরের ‘ছি’কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এবং প্যাথোজেনিক কারণগুলো দূর করে।

টিসিএমের মাধ্যমে ডায়াবেটিক ফুট আলসারের টপিকাল চিকিৎসা সহজ। টপিকাল চিকিৎসা প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে ক্ষত প্রতিরোধ, ক্ষত দূর করা, গ্যাংগ্রিনের ক্ষত নিরাময় এবং আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলার হার কমানো।

ডায়াবেটিক ফুট আলসারের ক্ষেত্রে চিকিৎসায় কয়েক হাজার বছর ধরে টিসিএম ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷ এ চিকিৎসার কার্যকারিতা বিভিন্ন ক্লিনিকাল অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে৷ এবং গত কয়েক দশক ধরে অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক আধুনিক চিকিৎসা-গবেষক ডায়াবেটিক ফুট আলসারের টিসিএম চিকিৎসার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আসছেন৷ কিছু ক্ষত নিরাময়ে রেডিক্স অ্যাস্ট্রাগালি, রেডিক্স রেহমাননিয়া, রাইজোমা অ্যালিসম্যাটিস এবং রাইজোমা অ্যাট্রাক্টিলোডিস ম্যাক্রোসেফালের মতো ফর্মুলা ফাইব্রোব্লাস্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

ডায়াবেটিক ফুট আলসার নিরাময়ে আকুপাংচারেও ভালো ফল পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট আকুপয়েন্টে আকুপাংচার করা হলে তাতে মেরিডিয়ানের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়, কোলাটারাল সক্রিয় হয় এবং পুরো শারীরিক ক্রিয়ায় শৃঙ্খলা আসে, যার ফলে আক্রান্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং সংবেদনশীলতা ফিরে আসে। ডায়াবেটিক ফুট আলসারের ক্ষেত্রে যেসব আকুপয়েন্টে আকুপাংচার দেওয়া হয় সেগুলো হলো এসটি৩৬, জিবি৩৪, বিএল৩৯, এসপি৬, বিএল ৬০, কেআই৩, এসপি১০। কানের পয়েন্টগুলোর মধ্যে থাকে এএইচ৬, এটি৪, সিও১০, সিও১২, সিও১৩, সিও১৪, সিও১৫।

তবে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, একটি সামগ্রিক মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি অর্থাৎ টিসিএম এবং পশ্চিমা চিকিৎসার সংমিশ্রণ, অস্ত্রোপচার ব্যবস্থাপনা, পায়ের যত্নের শিক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ ডায়াবেটিক ফুট আলসারের চিকিৎসায় সবচেয়ে ভালো ফল দিতে পারে। তেষট্টি জন রোগীর উপর পরিচালিত এ পরীক্ষায় দেখা গেছে, সমন্বিত চীনা ও পশ্চিমা চিকিৎসা শুধু পশ্চিমা চিকিৎসার চেয়ে উত্তম ফল দেয়।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ হাসপাতাল হুয়াশান

হুয়াশান হাসপাতাল চীনের বাণিজ্যিক নগরী শাংহাইয়ের অন্যতম জেনারেল হাসপাতাল। আজ থেকে ১১৬ বছর আগে চীনের রেড ক্রস সোসাইটি এটি প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে হাসপাতালটি ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের শাংহাই মেডিকেল কলেজের সঙ্গে অধিভুক্ত এবং বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষণ হাসপাতাল।

হুয়াশান হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন চীনের রেড ক্রস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা শ্যান তুনহ্য। ১৯০৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯০৯ সালে। ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এ হাসপাতাল ব্রিটেনের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষণ হাসপাতাল হিসেবে কাজ করে এবং হার্ভার্ডে নিয়মিতভাবে এর ডাক্তার ও গবেষকদেরকে জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ২০০৪ সালে হুয়াশান হার্ভার্ডের প্রধান শিক্ষণ হাসপাতাল ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের সাথে ‘সিস্টার হসপিটাল’ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। পাশাপাশি ১৯২৮ সাল থেকে এটি ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজের একটি শিক্ষণ হাসপাতাল হিসাবে কাজ করে। কার্যক্রম পরিচালনার একশ বছরেরও বেশি সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয় হুয়াশান হাসপাতাল। ১৯৩১ সালে এটির নামকরণ করা হয় চীনের রেড ক্রস সোসাইটির প্রথম হাসপাতাল এবং ১৯৫৬ সালে হুয়াশান হাসপাতাল।

চারটি শাখা অর্থাৎ মূল শাখা, পশ্চিমাঞ্চলীয় শাখা, উত্তরাঞ্চলীয় শাখা এবং পূর্বাঞ্চলীয় শাখা নিয়ে গঠিত হুয়াশান হাসপাতাল। সুহুই জেলায় অবস্থিত এর প্রধান শাখায় শয্যাসংখ্যা ১ হাজার ২১৬টি, পশ্চিমাঞ্চলীয় শাখায় ৮শটি, উত্তরাঞ্চলীয় শাখায় ৬শটি এবং পূর্বাঞ্চলীয় শাখায় ২শটি। বছরে এ হাসপাতাল ৬০ হাজারের বেশি ভর্তি রোগীকে চিকিৎসা দেয় এবং বহির্বিভাগের মাধ্যমে সেবা দেয় প্রায় ৪০ লাখ রোগীকে, যাদের অনেকে শাংহাইয়ের বাইরের মানুষ। প্রতি বছর অন্তত ৪০ হাজার রোগীকে শল্যচিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে।

হুয়াশান হাসপাতালে ২ হাজার ৬শ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ চিকিৎসক ও প্রযুক্তি পেশাজীবী। তাদের মধ্যে অন্তত ৪শ জন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং চীনের প্রকৌশল একাডেমির ও বিজ্ঞান একাডেমির তিনজন শিক্ষাবিদ।

হুয়াশান হাসপাতালে রয়েছে ৩৯টি ক্লিনিকাল ও সহায়ক বিভাগ, যেগুলোর মধ্যে দশটি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ‘জাতীয় মূল ক্লিনিকাল চিকিৎসা বিশেষত্ব’ হিসাবে স্বীকৃত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউরোসার্জারি, হাতের সার্জারি, প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি, নিউরোলজি, সমন্বিত ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা, ইউরোলজি, নেফ্রোলজি, সংক্রামক রোগ এবং অ্যান্টিবায়োটিকস, রেডিওলজি, কার্ডিওলজি ও সার্জারি।

হুয়াশান হাসপাতালের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। পুতং নতুন এলাকায় স্থাপিত এই শাখাকে শাংহাই ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালও বলা হয়। মূলত পুতংয়ে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক বিদেশি নাগরিককে সেবা দেওয়ার জন্য এ শাখাটি গড়ে তোলা হয়। হাসপালের উত্তরাঞ্চলীয় শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পাওশান জেলায় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় শাখা হোংছিয়াও পরিবহন হাবের কাছে। 

 

#ভেষজের গুণ

গুণের শেষ নেই তারা মৌরির

স্টার অ্যানিস সিড বা তারা মৌরি অতি বিখ্যাত এর অনন্য গুণ ও সুগন্ধের জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের রান্নায় এ মসলা ব্যবহৃত হয়। তবে তারা মৌরি কেবল একটি মসলা নয়। এর চেয়ে বেশি কিছু এর স্বাস্থ্যগত গুণের কারণে৷ চলুন জেনে নিই তারা মৌরির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে:

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ: তারা মৌরি কোয়ারসেটিন ও লিনালুলের মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর৷ এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ফ্রি-র‌্যাডিক্যাল বা শরীরের বিষের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং কোষকে রক্ষা করে৷

হজমে সাহায্য করে: পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতার জন্য ভেষজ ওষুধে তারা মৌরি ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এতে পাওয়া যৌগগুলো হজমের এনজাইমের উৎপাদন বাড়া, খাদ্যের ভাঙ্গনে সহায়তা করে, ফোলাভাব কমায় এবং বদহজম প্রশমিত করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: তারা মৌরিতে এমন কতগুলো এসেন্সিয়াল অয়েল রয়েছে, যেগুলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। এ কারণে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে সহায়তা করে এ ভেষজ। খাদ্যে, বিশেষ করে ঠান্ডা ঋতুর খাবারে, তারা মৌরি অন্তর্ভুক্ত করলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়।

শ্বাসযন্ত্রের জন্য সহায়ক: তারা মৌরির সুগন্ধি যৌগগুলো শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি কাশি ও কফ জমা উপশম করতে এবং হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো শ্বাসযন্ত্রের রোগ সারতে সাহায্য করতে পারে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।