চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘চলতি বাণিজ্য’
2023-11-03 17:05:22

চলতি বাণিজ্যের ৪২তম পর্বে থাকছে:

১. উৎসবে চাঙ্গা চীনের পারফরম্যান্স শিল্পের বাণিজ্য

২. কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে সহযোগিতা: সি চিনপিংকে শেখ হাসিনার ধন্যবাদ

৩. চীনের বাজারে বিশ্বখ্যাত সব জুয়েলারি কোম্পানি

 

উৎসবে চাঙ্গা চীনের পারফরম্যান্স শিল্পের বাণিজ্য

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনের যে কোন উৎসবের অন্যতম অনুসঙ্গ সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন। যে কোন উৎসবকে কেন্দ্র করে চীনের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় সঙ্গীত উৎসবের। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের মধ্য শরৎ উৎসবে কেবল চীনের সাংহাইতেই বসে অন্তত ৫০টি মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। তবে কেবল বিনোদন নয়, এসব গানের আসরে ভিড় জমায় পর্যটক ও বিনোদন পিপাসুরা। এ সময় জমজমাট হয়ে ওঠে রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন ব্যবসা।


 


সুরের মুর্ছনায় মেতে উঠেছে পরিবেশ। বাতাসে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে। লেকের পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছ জলের সান্নিধ্যে এসে সেই সুর যেন হয়ে উঠছে আরও মনোরম, আরও মোহনীয়।

সুর ও সঙ্গীতের তালে এভাবেই ধরা দেয় সাংহাইয়ে অবস্থিত ছিংপু ওয়াটার টাউনে। আগতরা কেউ পর্যটক, কেউ বা সৌখিন স্থানীয় বাসিন্দা। তারা বলছেন, এ বছর মধ্য শরৎ উৎসবের ছুটির সঙ্গে জাতীয় দিবসের ছুটি যুক্ত হওয়ায় আরও বেশি ঘরে বেড়ানোর ও সময় কাটানোর ফুরসত পাওয়া গেছে।

পর্যটক

“আমি গেল ২ বছরে স্ট্রবেরি মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ও মিতি মিউজিক ফেস্টিভ্যালে গিয়েছি। তবে এই উৎসবটি উন্মুক্ত আকাশের নিচে হয়েছে। এ বছর মধ্য শরৎ উৎসবের সাথে আবার জাতীয় দিবসের ছুটিও ছিলো। সব মিলিয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে।“

কেবল বিনোদন বা আনন্দ আয়োজন নয়। এই উৎসব চীনা অর্থনীতিতে যোগ করেছে নতুন ছন্দ। বিশেষ করে এবারের মধ্য শরৎ উৎসব ও জাতীয় দিবসের ছুটিতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশটির পারফরম্যান্স শিল্প।

চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত টানা ছুটিতে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বাড়ে পর্যটকদের আনাগোনা। পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ের মধ্যে কেবল সাংহাইতেই আয়োজন করা হয় অন্তত ৫০টি সঙ্গীত উৎসবের।

পর্যটক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন জায়গায় কনসার্ট, নাচ-গানের আসর, উৎসব উদযাপনে ডাক পড়ে শিল্পীদের। সাংস্কৃতিক নানা উপাদানের চাহিদা বাড়ে বাজারে। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ছুটিতে অর্থ খরচ করে নানা রকম উৎসব আয়োজনের।

পর্যটক

“আমি আর আগে গেল এপ্রিল মাসে একটি সঙ্গীত উৎসবে গিয়েছি আর গ্রীষ্মকালীন উৎসবের সময়ও একটি গানের আয়োজনে অংশ নেই। তবে এটা ছিলো আমার কাছে আরও বেশি আনন্দের, কারণ এই ভেন্যুটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও মানুষে ভরপুর। এখানকার গায়ক-গায়িকারা অসাধারন গেয়েছে, বাদ্যযন্ত্রগুলোও দারুণ ছিলো।“

এসব পর্যটনকেন্দ্রে প্রতি ৪ ঘণ্টা পরপর চলতে থাকে গানের আসর। সঙ্গে যোগ হয় জলমগ্ন পরিবেশে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তাল। আবার কখনো বা চলে ঐতিহ্যবাহী কুংফু অপেরা। সব মিলিয়ে মুগ্ধ হওয়ার মতো নানা অনুসঙ্গ থাকে হাতের কাছেই।

এসব আয়োজন মূল আকর্ষণ থাকে ঐতিহ্যবাহী চীনা সঙ্গীত। তবে চীনা শিল্পীদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের শিল্পীরাও এতে অংশগ্রহণ করে, নিজেদের সেরা গান পরিবেশন করে ও স্থানীয়দের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। এদের অনেকে আবার সারা বছরই কোন কোন আয়োজনে অংশ নেয়। নিজেদের গানের স্র্রোতা-ভক্ত বাড়ছে দেখে তারাও বেশ আনন্দিত।

ব্যান্ডদলের সদস্য পল মেরেডিথ বলেন, “এখানে আসলে দেখা যায় মানুষ কতোটা খুশি। তারা গাইছে, নাচছে যেন আবারো সেই কৈশরকালে ফিরে গেছে। আমার খুব ভালো লাগে।“

ব্যান্ড দলের আরেক সদস্য কির্ক কেনি বলেন, “এই উৎসবটার কথা আমার খুব মনে পড়বে। আমার মনে এখানকার প্রত্যেকেই এমন সঙ্গীত উৎসবে বারবার আসতে চায়। খুব বড় কিছু না বরং এটার মতো ছোটখাট আয়োজন যেন অনেক বেশি মজা করা যায়।“

আনন্দ আয়োজনের পাশাপাশি জেগে ওঠে এখানকার রাত্রীকালীন অর্থনীতি। অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেন, গ্রহণ করেন বিভিন্ন রকমের খাবারের স্বাদ। কেউবা বন্ধুদের নিয়ে মেতে ওঠেন ভোজন-বিলাসে। বিশেষ করে এসব পর্যটন স্থানের রেস্তোরা, হোটেল ও বিপনিবিতানগুলো ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে। ফলে চাঙ্গা হয় বাণিজ্য।

ছুই লিউছেং, রেস্টুরেন্ট মালিক

“এ বছর সঙ্গীত উৎসবের সময় আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট খোলা রেখেছি। মানুষ একটি পানীয় কিনেও এখানে টানা ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় উপভোগ করতে পেরেছে। উৎসবের পুরোটা সময়ে ক্রেতাদের লেনদেন ও বুকিংয়ের পরিমাণ আগের যে কোন উৎসবের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। যেহেতু এখানে সঙ্গীত উৎসব ছিলো তাই আমাদের রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলাও পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবার।“

অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে চীনের পারফরমেন্স মার্কেটে যে ধস নেমেছিলো, সেই মন্দাভাব কাটিয়ে আবারো ছন্দে ফিরেছে এই খাত। এই শিল্পের তথ্য বলছে চলতি বছরের এপ্রিল ও জুন মাসেই চীনে ৪৩০টি কনসার্ট ও সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজন থেকে আয়ের পরিমাণ আগের ৩ মাসের চেয়ে ৭৪০ শতাংশ বেশি।

 

ভিনদেশে চীন:

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে সহযোগিতা: সি চিনপিংকে শেখ হাসিনার ধন্যবাদ

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: কর্ণফুলী টানেল উদবোধন করে একে চট্টগ্রামবাসীর জন্য বিশেষ উপহার বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠে এক জনসভায় এ কথা বলেন শেখ হাসিনা। এ সময় টানেল নির্মাণে সহযোগিতা করায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগ চট্টগ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সড়ক টানেল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এই টানেলটি সংযোগ স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম শহরের দুই পাড় পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে।

সম্প্রতি এই টানেল উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ঢল নামে চট্টগ্রামের কেইপিজেড মাঠে।


শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে আসার পর 'সংযোগে নতুন সম্ভাবনা' শিরোনামের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এর পর টানেলের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে টানেলের একটি প্রতিকৃতি উপহার দেন।

এসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং এর একটি শুভেচ্ছা বার্তা পড়ে শোনান বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তা হস্তান্তর করেন।

স্থানীয় জনসাধারণের উপস্থিতিতে এ মাঠে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন কেবল ঢাকা চট্টগ্রাম নয় বরং সমস্ত বাংলাদেশের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে ভূমিকা পালন করবে এই টানেল। এ সময় টানেল নির্মাণে সহযোগিতা করায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এর নাম ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আনন্দঘন এই মুহুর্তের স্মারক হিসেবে এ সময় বর্ণিল আতশবাজি প্রদর্শন করা হয়। পরে মোনাজাতের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করেন প্রধানমন্ত্রীসহ উপস্থিত সবাই। এরপর টোল পরিশোধ করে কর্ণফুলী টানেলে অতিক্রম করেন প্রধানমন্ত্রী।

কোম্পানি প্রোফাইল:

চীনের বাজারে বিশ্বখ্যাত সব জুয়েলারি কোম্পানি

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনের বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে হাজির হয়েছে সারা দুনিয়ার সেরা সব জুয়েলারি কোম্পানি। বেইজিংয়ের আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেলায় অংশ নেওয়া বিদেশি কোম্পানিগুলো বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া চীনা চান্দ্রবর্ষের আগেই চাঙ্গা হতে শুরু করেছে স্বর্ণের বাজার। আমার তৈরি করা প্রতিবেদন জানাচ্ছেন হোসনে মোবারক সৌরভ।

সারা বিশ্বের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলোর মিলন মেলা হয়ে উঠেছে বেইজিংয়ের আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেলায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৪০টি দেশের কমপক্ষে ১০০টি কোম্পানি অংশ নেয় ওই মেলায়। বিশেষ করে বড় রকমের উপস্থিতি ছিলো থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের নামি-দামি কোম্পানিগুলোর। ৫ দিনব্যাপী এ মেলায় অংশ নেওয়া বিদেশি কোম্পানিগুলোর দিকে ছিলো ক্রেতাদের বিশেষ আকর্ষণ। 

চীনে নতুন বছরের আগমন ঘটবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু কয়েক মাস আগেই বিদেশি জুয়েলারি কোম্পানিগুলো হাজির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে। কেননা, এই উৎসবে চীনে স্বর্ণের গহনাসহ নানা সামগ্রীতে স্বর্ণের ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বিশেষ করে স্বর্ণের বার ও স্বর্ণখচিত ড্রাগন বেশ জনপ্রিয় হয় এ সময়। স্বর্ণখচিত ড্রাগনকে মনে করা হয় ক্ষমতা ও শক্তিমত্তার প্রতীক। চীনা সংস্কৃতিতেও স্বর্ণের ব্যবহার খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয়। 

মেলায় অংশ নেওয়া একটি কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, চীনা নতুন বছরকে সামনে রেখে তারা ৬ ধরনের সোনার বার নিয়ে এসেছেন। এছাড়া শতাধিক ডিজাইন ও মডেলের বিভিন্ন রকম আকারের স্বর্ণের গহনার সংগ্রহ আছে তাদের।

তিনি জানান, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যে চীনা চান্দ্রবর্ষ আসছে তাকে ঘিরে স্বর্ণের বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর নানা কারণে স্বর্ণের বাজার চড়া আবার বেচাকেনাও বেড়েছে। চীনের বাজারে প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ৪৬৮ দশমিক ৪৮ ইউয়ান বা ৬৪ মার্কিন ডলার।