কেকেয়ার সবুজ কিংবদন্তি
2023-11-01 15:58:50

ইমামু মাইমাইতি

শরত্কালে ঘন পপলার বনে উত্তপ্ত সূর্য যেন নিঃশব্দে জ্বলছে। ৭৮ বছর বয়সী ইমামু মাইমাইতি তাঁর ছেলে এসকার ইমামু বনের ভিতর হেঁটে হেঁটে গাছের অবস্থা পরীক্ষা করছেন। গাছগুলোকে নিজের বাচ্চার মতো স্নেহশীল স্পর্শ দেন তিনি। এই জায়গাটির নাম কেকেয়া। চীনের ম্যাপ খুললে দেখা যাবে কেকেয়া সিনচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আখসু এলাকার ওয়েন সু জেলায় অবস্থিত। তার পাশে ‘মৃত সাগর’ তাকলিমাকান মরুভূমি। গত শতাব্দীর ৮০ দশকে হলুদ বালির বিরুদ্ধে এখানে এক লড়াই শুরু হয় এবং সবাই বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে একটি বড় প্রকল্পে অংশ নেন।

আজকাল শুধু কেকেয়া নয়, সারা আখসু অঞ্চলে সবুজ বন আর নতুন কোনও ব্যাপার নয়। কেকেয়ার বন চীনের ‘সান পেই’ প্রতিরক্ষামূলক বন প্রকল্পের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রসের পর থেকে আখসু অঞ্চলে মোট ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৫০ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছে এবং সেখানে বনের আয়তন ২০১২ সালে ছিল যেখানে প্রায় ৯ লাখ হেক্টর, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১১ লাখ হেক্টরে।

সিনচিয়াংয়ের রাজধানী উরুমুছি থেকে দক্ষিণ দিয়ে গিয়ে থিয়ান শান পাহাড় অতিক্রম করার পর আখসুতে পৌঁছানো যায়। আখসু বিমানবন্দরের অদূরে বড় বড় ফল বাগান দেখা যায়। চীনে বিখ্যাত আখসু আইসড সুগার হার্ট আপেল এখানকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফল। তবে ৪০ বছর আগে, এখানে কোনও ফলের বাগান ছিল না। বসন্ত কাল শুরু হতো একটি বালিঝড় থেকে। তারপর বার বার বালিঝড়ে বছর কাটতো। ওই সময়ের অবস্থা স্মরণে এলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আখসু অঞ্চল কমিটির সাবেক সম্পাদক ৮৯ বছর বয়সী চিয়ে ফু পিংয়ের চোখ জলে ভরে যায়। তিনি বলেন, ওই সময় মানুষেরা কঠিন জীবনযাপন করতো, এক বাটি ভাতে অর্ধেক থাকতো বালি।

আগের সে পরিস্থিতি পরিবর্তনে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল স্থানীয়রা। ছিং রাজবংশের শেষ দিক থেকে অধিবাসীরা কৃত্রিম বন গড়তে শুরু করে। তবে সেখানে সব গাছ বাঁচে না। বসন্তে যে গাছে রোপণ করা হয়, তা শরত্কালে আগুনের কাঠে পরিণত হয়।

সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন, সমাধান করতে হয়। চিয়ে ফু পিং ও তার সহকর্মীরা আলোচনা করে একটি উপসংহারে আসেন যে, কেকেয়া হচ্ছে আখসু অঞ্চলের বালিঝড়ের উত্স এবং কেকেয়ার সমস্যা সমাধান হলে বালি প্রতিরোধ সম্ভব হবে।

তখন বনায়নে তিনটি সমস্যা ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না, কোনও সরঞ্জাম ছিল না এবং এ কাজ যারা করবে, তাদের বেতন দেওয়া হবে না। এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে স্থানীয়রা নিজেদের সরঞ্জাম ও খাবার নিয়ে কেকেয়ায় যায় এবং সেখানে বৃক্ষ রোপণ শুরু করে।

বৃক্ষ রোপণের জন্য পানি প্রয়োজন। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ২৫০জন নিয়ে গঠিত একটি দল কেকেয়া অঞ্চলে খাল খনন শুরু করে। মাত্র ৪ মাস সময়ে ১৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়। আজ পর্যন্ত থিয়ান শান পাহাড়ের তুষারের পানি এ খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর দু পাশে পপলার গাছ পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

পানির পর জমির সমস্যা সমাধান হতে হবে। কেকেয়ার জমি লবণ ও ক্ষারযুক্ত, যেটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে এবং কেবল বিস্ফোরণের মাধ্যমে সে পাথর ভাঙ্গা যায়। জমি নরম করতে প্রথমে পানি দেওয়া হয়। তারপর মানুষেরা বেলচা ও হাতুড়ি দিয়ে একটু একটু প্রথম ১৩৩ হেক্টর জমিকে সমতল করে।

তৃতীয় সমস্যা হলো লবণ-ক্ষার নিয়ন্ত্রণ। যে কারণে বৃক্ষ রোপণ সফল হয় না, তা হলো জমিতে লবণ-ক্ষার বেশি। আখসুর মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপার নিয়ে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা করে এবং অনেক ব্যর্থতার পর তারা জমির লবণ-ক্ষার অনুপাত চাষ-উপযোগী একটি পর্যায়ে আনতে সক্ষম হয়।

ইমামু মাইমাইতি ছিলেন কেকেয়া বন ব্যবস্থাপনা স্টেশনের প্রথম প্রধান। তিনি বাগান করা নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং তিনি বোঝেন যে, বৃক্ষ রোপন সহজ নয়। তবে সেগুলোর সংরক্ষণ আরও কঠিন। ইমামু বলেন, তিনি তখন শুধু একটি ব্যাপার নিয়েই চিন্তা করেন। সেটি হলো গাছ মরতে দেওয়া যাবে না। ইমামু ও তার সহকর্মীরা কৃত্রিম বন এলাকায় বাস করেন। ব্যাগে ম্যাপ, নানরুটি ও টর্চলাইট নিয়ে প্রতিদিন ২০-৩০ কিলোমিটারের মতো হেঁটে গাছে জল ও সার দেন এবং যত্ন নেন। খিদে পেলে নান খান, ক্লান্ত হলে ক্ষেতে ঘুমান। তার ছেলে আসকার বলেন, বাবা খুব কম বাড়িতে ফেরেন। তিনি যখন বাড়িতে ফেরেন, প্রতিবারই তার মুখ ধূসর থাকে। তবে এ কষ্টের মধ্য দিয়ে তার বাবা মহান একটি কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। কেকেয়ার সবুজ রঙ দিন দিন বাড়ছে। ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ সম্পদ সংরক্ষণ কমিটি কেকেয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ৫০০টি জায়গার একটি হিসেবে নির্বাচিত করে।

চাও উ চুং ও মুহেদান তুর্দি 

কেকেয়ার ইং ইয়েন গ্রামে চাও উ চুং ও মুহেদান তুর্দি আখরোট বাগানে গাছের অবস্থা পরীক্ষা করছেন। এরা দুজন আখরোট ভাই হিসেবে পরিচিত। ২০ বছর আগে, বন্ধুত্বের সূত্রে চাও উ চুং সিছুয়ান প্রদেশ থেকে আখসু অঞ্চলে আসেন এবং বিনামূল্যে ২ দশমিক ৩ হেক্টর জমি লিজ হিসাবে নেন। শুরুতে তিনি আখরোট গাছ রোপণ করেন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন। যখন তিনি এ জমি ছেড়ে সিছুয়ান প্রদেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, তখন মুহেদান তাকে টাকা ধার দেন এবং তাকে কৌশল শিখিয়ে দেন। তখন থেকে দুজন ভাল বন্ধু হয়ে যান। আখসু অঞ্চলে এমন গল্প কম নয়।

স্থানীয় সরকার মরুভূমিতে বনায়নের প্রকল্প চালু করে। যারা বন গড়ে তোলে তারা রক্ষা করে, যারা বিনিয়োগ করে তারা উপকৃত হয়। ফল গাছ রোপনের মাধ্যমে বনায়ন বাস্তবায়িত হয়। প্রতিরোধমূলক বনে আপেল, আখরোট, কুলসহ অন্য ফল গাছ রোপনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জিত হয়।

কিছুদিন পর ফসল তোলার সময় হবে ফু ই ওয়েনের আপেল বাগানে। তিনি সাংবাদিককে জানান, ২০০৭ সালে তিনি যখন এ ফল বাগন লিজ নেন, তখন লবণ-ক্ষারযুক্ত জমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করতে ৫০-৬০জন কর্মী নিয়োগ করেন এবং এ কাজের খরচ ছিল প্রায় ১০ লাখ ইউয়ান। ফল বাগান ছাড়া ফু ই ওয়েন ও তার স্বামী ২ হেক্টর বন লিজ নিয়েছেন এবং সেখানে গ্রাম-পর্যটন ব্যবসা করেন।

বর্তমানে কেকেয়ার সব সবুজায়ন প্রকল্পের মধ্যে ৮৬ শতাংশ অর্থনৈতিক বন। এতে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক লাভ অর্জিত হচ্ছে। ২০২২ সাল নাগাদ আখসু অঞ্চলে বৈশিষ্ট্যময় ফল চাষের আওতাধীন এলাকার আকার দাঁড়ায় ৩ লাখ হেক্টরে। ফল চাষ খাতের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৬৯ ইউয়ানে, যা কৃষকদের নিট আয়ের ২৬ শতাংশ।

চীনের বনবিজ্ঞান একাডেমির প্রধান বিজ্ঞানী লু ছি বলেন, কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় চীনের মরুকরণ মোকাবিলা ও প্রতিরোধ কার্যক্রম নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করে। বিভিন্ন জায়গায় ও পরিস্থিতিতে কেকেয়ার চাষপদ্ধতি পরীক্ষা করা হয় এবং সব জায়গাতেই সাফল্য অর্জিত হয়।

কেকেয়া জাদুঘর থেকে প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কেকেয়া অঞ্চলে মোট ১০ হাজার ১২০ হেক্টর বন গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আরও ৭ হাজার ৮৬০ হেক্টর এবং ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬২ হাজার ১৯৩ হেক্টর বন সৃষ্টি করা হয়।

নতুন যুগে আখসু অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রশাসন প্রকল্প এগিয়ে যাচ্ছে। গত নভেম্বর মাসে শুরু হয় ওয়েন সু জেলার একটি প্রকৃতি পুরুদ্ধার প্রকল্প। সেটিকেও কেকেয়া অঞ্চলের সবচেয়ে কঠিন সবুজায়ন প্রকল্প হিসেবে মনে করা হয়। আকাশ থেকে দেখা যায় ১০ কিলোমিটার লম্বা বালি ক্লিফ ওয়েন সু জেলা ও কেকেয়ার মধ্যে একটি দাগের মতো শুয়ে রয়েছে।

আগে মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জীবনের সুযোগ খুঁজতো এবং এখন তারা মানুষ ও প্রকৃতির সবাহবস্থানের উপায় খুঁজছে। আখসু এ পথে আরও সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। (শিশির/রহমান/রুবি)