পারিবারিক শিক্ষা: কেন একশ্রেণীর বাবা-মা বাচ্চার সঙ্গে হতাশাজনক আচরণ করেন?
2023-10-30 15:30:45

পিতামাতার সাথে বাচ্চাদের সম্পর্ক পারিবারিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একেক পরিবারে এ সম্পর্কের ধরন একেকরকম হতে পারে। অধিকাংশ বাবা-মা চান বাচ্চাদের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে। তবে, কেউ কেউ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাচ্চাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না বা নিদেনপক্ষে সেটা খুবই মুশকিলের কাজ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে: কেন বাবা-মা কখনও কখনও বাচ্চার সঙ্গে হতাশাজনক আচরণ করেন? এর পিছনে বাবা-মায়ের যুক্তি কী? এমন অবস্থার পরিবর্তন কি সম্ভব? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।

 

চলতি বছর মেয়ে চু চু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। তিনি বাবা-মার জন্য তাঁর স্নাতক অনুষ্ঠানের টিকিট কিনেছেন এবং তাদেরকে একসাথে এ আনন্দময় সময় কাটানোর জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে বাবা-মা বলেন, বেইজিংয়ে আসলে অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে এবং হোটেলে থাকলে অনেক টাকা লাগবে, তাই তাঁদের যাওয়ার আগ্রহ খুবই কম। মেয়ে চু চু এতে হতাশ। তার দৃষ্টিতে নিজের ছাত্রীজীবনের শেষ মুহূর্তটি বাবা-মার সাথে কাটাতে না পারা বেশ পরিতাপের বিষয়।

 

সম্প্রতি চীনের ইন্টারনেটে ‘বাবা মা কেন আমাকে হতাশা করেন?’ শীর্ষক আলোচনা ব্যাপকভাবে চলছে। কেউ হয়তো নিজের মাসিক পকেটমানি সঞ্চয় করে মায়ের জন্য ফুল কিনেছেন, কিন্তু মা তা দেখে বললেন, এটা অর্থের অপচয় মাত্র!  কেউ অনেক পরিশ্রম করে পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে, কিন্তু বাবা-মা তাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তুমি প্রথম স্থান পাওনি?!

 

সম্প্রতি ছেলে লুও লিন নিজের বার্ষিক ছুটিতে বাবা-মা ও নানীকে নিয়ে সানইয়া ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। বয়স্ক বাবা-মা ও নানীর শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে তিনি দামী বিমান টিকিট আর ভালো হোটেল বুকিং করেন। যখন সব বুকিংয়ের কাজ শেষ, তখন মা খরচের কথা বিবেচনা করে ভ্রমণ বাতিল করেন। লুও লিন এবং তার বাবা বহু অনুনয়-বিনয় করার পর মা শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে ভ্রমণে যেতে রাজি হন। তবে লুও’র দৃষ্টিতে প্রস্তুতির পর্যায়ে ভ্রমণের জন্য যে আনন্দ, তা মায়ের জন্য হারিয়ে গেছে। তিনি মায়ের সিদ্ধান্ত ও চিন্তাভাবনা বুঝতে পারেন না।

 

১৭ বছর ধরে চীনের পারিবারিক শিক্ষার গবেষক কুয়াংতুং বাইইয়ুন একাডেমির মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর বেইজিং নর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট শিক্ষার্থী ছেন সিয়াও। তাঁরও একই অভিজ্ঞতা রয়েছে। একবার তাঁর পরিবারের ওয়াশিং ম্যাশিন ও ওয়াটার হিটার নষ্ট হয়েছে। বেশি টাকা দিয়ে শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ডের যন্ত্র কিনতে চেয়েছিলেন চেন। তবে তাঁর বাবা-মা টাকা নষ্ট হবে বলে তা কিনতে চান না। তবে, পরে দামী যন্ত্র ব্যবহার করার পর ছেনের সিদ্ধান্তের প্রশংসাও করেন তাঁরা।

 

কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, বাচ্চার সাথে ভ্রমণ করা, উত্সবে উপহার পাওয়া এবং জীবনযাপনের সুখী মুহূর্ত বিনিময় করা সবই আনন্দদায়ক ব্যাপার, কিন্তু কেন বাবা-মা সবসময় হতাশার কথা বলেন? সহকারী অধ্যাপক ছেনের দৃষ্টিতে সেই অবস্থার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, তাঁর পিতামাতার যুবকালে জীবনযাপনের মান খারাপ ছিল; অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারতেন না তাঁরা। তাই বর্তমানে জীবনমান উন্নত হওয়ার পর তাদের বাচ্চার কেনাকাটার অভ্যাস এবং তাদের চিন্তাভাবনা ও অভ্যাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তা ছাড়া, বয়স্ক বাবা-মার ছোটবেলায় তাদের বাবা-মা তথা ছেনের দাদা-দাদী ‘হতাশার মধ্যেই’ বাচ্চাকে লালনপালন করেছেন। ফলে তারা বাচ্চার সাথে সবসময় সহমর্মিতার আচরণ করতে পারেননি। তারা বাচ্চাদের প্রিয় বিষয় ও মনের অবস্থা সবসময় বুঝতে পারতেন না। কখনও কখনও তাঁরা বাচ্চার চিন্তাভাবনাকে  গুরুত্বও দিতেন না।

তবে, একইসঙ্গে, সহকারী অধ্যাপক ছেন পরামর্শ দিয়ে বলেন যে, বাচ্চাকেও পিতামাতার চিন্তাভাবনা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। বাবা-মায়ের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে।

 

যুবক-যুবতীদের জীবনযাপনের পদ্ধতি বাবা-মায়ের মতো নয়, অনেক পার্থক্য রয়েছে। যুবক-যুবতীরা প্রায়শই নিজেদের মনের কথা ও চাওয়ার কথা বাবা-মাকে বলে দেন। এতে সমস্যা নেই। তবে, নতুন কিছু গ্রহণে পিতামাতার যে সময় বেশি লাগবে, সেটাও সন্তানকে বুঝতে হবে।

 

মাঝেমাঝে বাবা-মায়ের হতাশাজনক কথা সম্পর্কে সহকারী অধ্যাপক ছেন একজন ছেলের অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, একজন ছাত্র কারিগরি স্কুল থেকে কলেজে ভর্তির চেষ্টা করে। তবে তার বাবা-মা তার ভর্তি ও নিবন্ধন সম্পর্কে আস্থাবান নন। যখন সে অবশেষে কলেজে ভর্তি হতে পারে, তখন বাবা-মা আবার বলেন, লেখাপড়া হলেও কোনো লাভ নেই। যখন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে সে নতুন চাকরি পায়, তখন বাবা-মা আবার বলেন, তোমার এ চাকরিতে বেতন এতো কম! উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কী লাভ হলো? তাই এ ছেলে বাবা-মার সাথে জীবনযাপনের সময় বেশ হতাশায় ভোগে এবং তার অনুভূতি সবসময় নেতিবাচক। কারণ, বাবা-মায়ের কাছ থেকে কোনো প্রশংসা বা ইতিবাচক সে কখনও শোনেনি।

এ সম্পর্কে ছেন বলেন, কোনো কোনো বাবা-মা মনে করেন, কেবল বাচ্চাদের দমন করা বা সমালোচনা করার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও চরিত্র উন্নত করা সম্ভব। যদি বাচ্চাকে বেশি প্রশংসা করেন, তাহলে বাচ্চা অহংকারী হবে। এ অবস্থায় পিতামাতা ও বাচ্চার সম্পর্ক সহজে নষ্ট হবে। কোনো কোনো বাচ্চা বাবা-মায়ের সমালোচনার কারণে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যা তাদের চরিত্র গঠনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 

যদি বাবা-মা দীর্ঘকাল ধরে নিজের বাচ্চার সমালোচনা করেন, তাহলে বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা অন্যদের চেয়ে খারাপ হবে। তারা অন্যদের প্রশংসা শুনলেও অবিশ্বাস করবে এবং আসল সুখ অনুভব করা তাদের জন্য খুবই কঠিন হবে। এ সম্পর্কে ছেন বলেন, বাবা-মা সবসময় বাচ্চার প্রশংসা করবেন, এটা কেউ বলছে না। বাচ্চার অগ্রহণযোগ্য অনুরোধ অবশ্যই রাখা যাবে না। তবে, যদি প্রত্যেক কাজে বাচ্চা সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়, সমালোচনা করা হয়, তাহলে সেটি বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে।

 

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির মনোবিজ্ঞান গবেষণাগারের মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শদাতা লিউ ইয়ু সেন একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি বলেন, পিতামাতাদের উচিত মনের অনুভূতি গোপন রেখে বাচ্চাদের সাথে আলাপ করা। যেমন, মার কাছ থেকে বাচ্চা উপহার পেতে ভালোবাসে। তবে বর্তমানে পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতো ভালো নয়। বাচ্চার জীবনমান নিশ্চিত করতে মা বেশি টাকা দিয়ে উপহার কিনতে পারেন না। এটা সুন্দর করে বাচ্চাকে বুঝিয়ে বললে, সে বুঝবে। বাচ্চারা যদি পিতামাতাদের কাছ থেকে মর্যাদা পায় এবং বাবা-মাও বাচ্চার ভালোবাসা ও সম্মান পায়, তবে সম্পর্ক ঠিক থাকবে।

 

নারী লিউ থিং একজন মা, যার বাচ্চার মাত্র ৩ বছর বয়স। তিনি বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক হতাশার কথা শুনেছেন। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকে উপহার দেওয়া বা বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করার সময় তারা নিয়মিতভাবে নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। ফলে তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে একসময় আর কোনো কথা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করা বন্ধ করে দেন।

 

মা হওয়ার পর ধীরে ধীরে তিনি বাবা-মায়ের আচরণের কারণ বুঝতে পারেন। তিনি মনে করেন, বাবা-মার যুবকালে সামাজিক অবস্থা ভিন্ন ছিল। তখন বাবা একাই চাকরি করতেন। তাই মা সঞ্চয় করতেন। পরে লিউ থিং বেশি টাকা খরচ করতে অভ্যস্ত হননি। মা হওয়ার পর তিনি বাবা-মাকে আয়না হিসেবে দেখেন, তিনি আশা করেন, তার বাচ্চা বড় হওয়ার পথে তিনি বাবা-মায়ের চেয়ে আরো ভালো করতে পারেন। বাচ্চার সাথে আরো বেশি সহমর্মিতার আচরণ করতে চেষ্টা করবেন তিনি।

 

তবে, ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কাছে নেতিবাচক মন্তব্য শোনার কারণে, এখন বাবা-মার সাথে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ নয়, সেটি আর পুরোপুরি পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। বাবা-মা তার জীবনপদ্ধতি গ্রহণ করেন কি করেন না, সেটা তার কাছে এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

শিক্ষক লিউ ইয়ু সেন বলেন, লিউ থিং’র মতো আরো অনেকে ছোটবেলায় বাবা-মার সমালোচনা শুনে অভ্যস্ত। এমন পরিবারে বড় হওয়া বাচ্চারা তাদের চরিত্র, চলাফেলা, দাম্পত্য সম্পর্ক এবং বাবা-মা হওয়ার পর বাচ্চাদের সাথে সম্পর্কসহ বিভিন্ন খাতে কোনো না কোনো মাত্রার সমস্যার সম্মুখীন হয়।

 

তাহলে কিভাবে ছোটবেলার এমন দুঃখ ও নেতিবাচক অনুভূতি কাটিয়ে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যকর মানসিক অবস্থা গড়ে তোলা যায়?

এ সম্পর্কে সহকারী অধ্যাপক ছেন বলেন, আমাদের ছোটবেলায় কেবল পিতামাতাকে নির্ভর করে বড় হতে পারি। তখন বাবা-মা হতাশাজনক কথা বা আচরণ করলেও আমাদের কোনো উপায় থাকে না। তবে যখন আমরা বড় হই, তখন বাবা-মা আর আমাদের ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে পারেন না। তখন আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারি। অতীতের কথা তখন ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করাই উত্তম।

 

নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ছেন বলেন, যখন নতুন বাড়ি কেনেন, তখন তিনি তা নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। বাবা-মা মনে করেন, তার এ সাজানোর কাজ সুন্দর নয় এবং অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই নতুন সাজানোর কর্মী খুঁজতে চেষ্টা করেন। তখন ছেন স্পষ্টভাবে বাবা-মাকে বলেন, এটি আমার নিজের বাড়ি, আমি এখানে থাকবো, তাই আমার মনের মতো করেই এটি সাজানো থাকবে। আপনাদের পছন্দে সাজানো হলে আমার খারাপ লাগবে। বাবা-মা তার কথা শুনে আর কিছু বলেননি।

 

বাচ্চারা বড় হওয়ার পর তাদের জীবন নিজের পছন্দমতো কাটাতে পারে। চাকরি ও বেতন থাকলে বাচ্চারা নিজের প্রিয় কাজ করতে পারে। তারা শুধু বাবা-মায়ের মতো জীবন কাটাতে বাধ্য নয়। কারণ, প্রত্যেকের জীবন আলাদা। নিজেকে আনন্দে রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা বাবা-মাকেও বুঝতে হবে।

 

তিনি আরও বলেন, বাচ্চা বড় হওয়ার পর বাবা-মার সাথে সহাবস্থান যেন দ্বৈত নৃত্যের মতো। নৃত্যের শুরুতে প্রথম ছন্দে একজন ভুল করলে ছন্দ হারিয়ে যাবে। এতে দু’জনই মাটিতে পড়ে যাবে। তাই সহাবস্থান থাকবে, তবে কেউ কারোর জীবনপদ্ধতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এটাই সঠিক পদ্ধতি। যদি একসাথে থাকতেই হয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা কাম্যও বটে, তবে বাচ্চা ও পিতামাতাকে একই ছন্দে থাকতে হবে; এক অপরকে বুঝতে হবে। এভাবে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে একসঙ্গে সুখে জীবন কাটানো সম্ভব।

 (সুবর্ণা/আলিম)