আকাশ ছুঁতে চাই ৪১
2023-10-26 18:50:14

১. ঐতিহ্যের আলোয় আলোকিত নারী

২. চীনের জন্য ভালোবাসা

৩. সুই সুতায় সাফল্যের গল্প

 

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

 

ঐতিহ্যের আলোয় আলোকিত নারী

একজন নারী শিল্পী লুও মিনসিন। তিনি প্রাসাদ লণ্ঠন তৈরির একজন দক্ষ শিল্পী। চীনের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ লণ্ঠন। অতীতে শুধুমাত্র রাজদরবারেই ব্যবহারের অনুমতি ছিল। এখন অবশ্য শিল্পরসিক যে কোন ব্যক্তিই এটা ব্যবহার করতে পারেন। কুয়াংতোং প্রদেশের এক শিল্পী এই প্রাসাদ লণ্ঠনের উপরে পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করছেন অনন্য শিল্প। ক্যান্টনিজ স্টাইলের প্রাসাদ লণ্ঠন তৈরি করেন তিনি। লণ্ঠনের উপর তার তুলির জাদুতে ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ শিল্পকর্ম। শোনা যাক তার গল্প।

                                               

তুলির টানে অপূর্ব সুন্দর ছবি ফুটে উঠছে কাচের উপর। এই ছবি শোভা পাচ্ছে প্রাসাদ লণ্ঠনে।

চীনের এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রাসাদ লণ্ঠন। লণ্ঠনের উপর ছবি আঁকছেন লুও মিনসিন। তিনি একজন নারী শিল্পী। ক্যান্টনিজ স্টাইলের প্রাসাদ লণ্ঠন তৈরির শিল্পী তিনি। তিনি লণ্ঠনের উপর ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ সুন্দর শিল্পকর্ম। একসময় ক্যান্টোনিজ স্টাইলের এই লণ্ঠন জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। কিন্তু লুও মিনসিনের বাবা নিজের কারখানা স্থাপন করে এর ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তার সুযোগ্য কন্যা হিসেবে লুও এই লণ্ঠনের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলেন।

লুও মিনসিন বলেন ‘ ঊনিশশ আশির দশকে চীনের অনেক লণ্ঠন কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। কারণ তখন পশ্চিমা ধরনের লাইটগুলোর জনপ্রিয়তাই বেশি ছিল। নব্বই দশকে কুয়াংচৌর একটি বিখ্যাত লণ্ঠন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ে আমার বাবা তার নিজের লণ্ঠন কোম্পানি শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন যে ছোটবেলা থেকেই আমি পেইন্টিংয়ে খুব ভালো। তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমি তার পথ অনুসরণ করে এই পর্যন্ত এসেছি।’

অতীতে প্রাসাদ লণ্ঠন শুধুমাত্র রাজদরবারে ও রাজপরিবারে ব্যবহারের অনুমতি ছিল। পরবর্তিকালে সাধারণ মানুষ এটা ব্যবহার করতে থাকেন। একসময়ে পাশ্চাত্যের প্রভাবে জনপ্রিয়তা কমে গেলেও পরবর্তিকালে আবার এটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়।

লুও কাচের উপর অসামান্য দক্ষতায় বিভিন্ন লোকজ নকশা, লিচু গাছ, ফুল, রূপকথার দৃশ্য ইত্যাদি আাঁকেন।

লুও মিনসিনের স্বামী লু চিচিয়া। তিনিও লণ্ঠনশিল্পী। তিনি তৈরি করেন লণ্ঠনের কাঠামো বা ফ্রেম।

লু চিচিয়া বলেন, ‘আমি বিশ বছর ধরে এই কাজ করছি। এটা খুব জটিল কাজ নয়। কিন্তু ধৈর্য লাগে। কারখানার ভিতরে ধুলো, এলোমেলো, শব্দ, ভারি কাজ রয়েছে। অনেক তরুণ এটাকে ক্লান্তিকর কাজ বলে মনে করেন। তারা এটা পছন্দ করেন না।’

লুও মিনসিনের কাজে অবশ্য দরকার একাগ্রতা। তিনি নিরিবিলিতে ছবি এঁকে চলেন। তিনি গ্লাস পেইন্টিংয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তার আঁকায় ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন হয়েছে। অনেক অ্যানিমেশন চরিত্রও ফুটে উঠেছে তার ছবিতে।

অন্যদিকে লু চিচিয়া কাঠের কাজে দক্ষ। তিনি রেডউড, গোলাপকাঠ ও আরও নানা রকম কাঠ ব্যবহার করে লণ্ঠন তৈরি করেন।

তরুণ প্রজন্মকে এই শিল্পে আকৃষ্ট করার জন্য এই শিল্পী দম্পতি স্কুল ও জাদুঘরে আয়োজিত কারুশিল্পের বিভিন্ন ওয়ার্কশপেও প্রশিক্ষণ দেন।

আজকাল ঐতিহ্যবাহী চায়নিজ স্টাইলে ঘর সাজানোর ফ্যাশন হওয়ায় ক্যান্টোনিজ প্রাসাদ লণ্ঠনের চাহিদা অনেক বেড়েছে।

লুও মিনসিন বলেন, ‘ আলো খুব সুন্দর। সারাদিনের কাজের পর ক্লান্ত হয়ে ঘরে ঢুকে আমরার প্রথমেই আলো জ্বালাই। আমার কাছে এটা পরিবারের একসঙ্গে থাকা ও উষ্ণতা বোঝায়। এটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অর্থও বহন করে।’

ক্যান্টনিজ স্টাইলের এই প্রাসাদলণ্ঠনগুলো ঘরকে উজ্জ্বল করে তোলে ঐতিহ্যের আলোয়। আর ঐতিহ্যের এই আলো জ্বালাচ্ছেন শিল্পী নারী লুও মিনসিন।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: রহমান

 

চীনের জন্য ভালোবাসা

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশিরা চীনে আসছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চীনদেশকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এমনি একজন বিদেশি নারী কিতি তিপ্পাওয়ান।

চীন দেশকে ভালোবাসেন থাইল্যান্ডের নারী কিতি তিপ্পাওয়ান। তিনি চীনে রয়েছেন বেশ অনেক বছর ধরে। কিতি তিপ্পাওয়ান একজন শিক্ষিকা। তিনি ইয়ুননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে থাই ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।

কিতির জন্ম থাইল্যান্ডের লামফুনে। ২০১৪ সালে তিনি চীনের ইয়ুননান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে আসেন। সেখানে ইয়ুননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনাভাষা শিক্ষা করেন। ২০১৫ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য চীন সরকারের বৃত্তি পান। ২০১৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার বিভাগে থাইভাষার শিক্ষক পদে যোগ দেন।

তার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা তাকে খুব ভালোবাসেন। তিনি নিজের জীবনসঙ্গীও খুঁজে পেয়েছেন চীনে। তিনি একজন চীনা যুবককে বিয়ে করেছেন।

কিতি জানান, তিনি চীনে অত্যন্ত নিরাপদ বলে অনুভব করেন। চীনকে তিনি ভালোবাসেন। এখানকার মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। তিনি চীনেই নিজের জীবন গড়ে তুলেছেন।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: রহমান

 

সুই সুতায় সাফল্যের গল্প

মিয়াও জাতির নারীদের নিজস্ব সম্পদ তাদের এমব্রয়ডারি শিল্প। এই শিল্পের একজন ধারক বা ইনহেরিটর লং লুইং। তিনি কাপড়ের উপর সুইয়ের কলম আর সুতার কালিতে লিখেছেন তার সাফল্যের গল্প। 

লং লুইং মিয়াও জাতির মেয়ে। তিনি মিয়াও এমব্রয়ডারির একজন ইনহেরিটর। এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পকে ব্যবহার করে তিনি নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন তেমনি অসংখ্য নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন।

দক্ষিণ পশ্চিম চীনের কুইচোও প্রদেশ। এখানে ছিয়ানতোংনান মিয়াও এবং তোং স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। শিবিং কাউন্টির সিয়াওহ্য গ্রাম। এই গ্রামের মেয়ে লং লুইং । তিনি খুব ছোট বয়সে মায়ের কাছ থেকে মিয়াও এমব্রয়ডারি শেখেন। তার মা শিখেছিলেন নিজের মায়ের কাছ থেকে। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে এই শিল্প।

 এই সূচিকর্ম হলো মিয়াও জাতির নারীদের এক বিশেষ ঐতিহ্য। মিয়াও এমব্রয়ডারির নকশার ভিতরে অনেক লোককাহিনী, তাদের জাতির ইতিহাস, নারীদের অনেক সুখ দুঃখের কথা, বিভিন্ন লোকজ মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়।

লু লুইং প্রাদেশিক পর্যায়ে একজন ইনহেরিটর বা মিয়াও এমব্রয়ডারির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। তিনি শেনচেন শহরে চাকরি করতেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার। ফিরে আসেন হোমটাউনে।

২০০৬ সালে তিনি নিজস্ব এমব্রয়ডারির কারখানা খোলেন। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৭ বছর ধরে তিনি নিজের কারখানায় মিয়াও এমব্রয়ডারিযুক্ত পোশাক, বেডকভার, ব্যাগ, জুতাসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করছেন। পাশাপাশি গ্রামের নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। গ্রামের একহাজারের বেশি নারীর জন্য তৈরি করেছেন চাকরির সুযোগ।

তার কাছে সুঁই হচ্ছে কলম আর সুতা হচ্ছে কালি। এর মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তোলেন ফুল, মাছ, পাখি প্রজাপতি ও আরও কত নকশা।

এই সুই সুতায় লং লুই শুধু নিজের সাফল্যের গল্পই তৈরি করেননি, পাশাপাশি তার গ্রামের নারীদের দারিদ্র্য বিমোচনেও অবদান রেখেছেন। তিনি চীনের গ্রামপুনর্জীবনের ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: রহমান

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

 

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া

কণ্ঠ: শান্তা মারিয়া, আফরিন মিম,  শুভ আনোয়ার

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল