চীনের মানববাহী মহাকাশ কর্মসূচির উপ-প্রধান নকশাকার ও চীনের প্রথম মহাকাশচারী ইয়াং লি উই
2023-10-26 10:00:47

বিশ বছর আগের ১৫ অক্টোবর চীনের প্রথম মানববাহী মহাকাশযান শেনচৌ-৫ আকাশে উড়ে যায়। মহাকাশচারী ইয়াং লিওয়েই চীনা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে প্রথমবারের মতো মহাকাশে যান। একুশ ঘন্টা ২৩ মিনিট পর তিনি মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এ অভিযানের মধ্য দিয়ে চীনা জাতির হাজার বছরের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়।

বিশ বছর পর সিনহুয়া বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে চীনের মানববাহী মহাকাশ কর্মসূচির উপ-প্রধান নকশাকার ইয়াং লিওয়েই মহাকাশ-যাত্রা স্মরণ করে আবেগের সঙ্গে বলেন: “প্রথম আকাশে উড়ে যাওয়া থেকে সার্বিকভাবে মহাকাশ স্টেশনের সম্পূর্ণ সমাপ্তি পর্যন্ত ২০ বছরে চীনের মনুষ্যচালিত মহাকাশ শিল্প ব্যাপকভাবে বিকাশিত হয়েছে। একজন অংশগ্রহণকারী ও সাক্ষী হিসেবে আমি উত্তেজিত ও গর্বিত।”

১৯৯৮ সালের ৫ জানুয়ারি, ইয়াং লিওয়েই ও তার ১৩ জন সহকর্মী পাঁচ তারকাঘচিত লাল পতাকার সামনে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে শপথ নেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চীনা মহাকাশচারী ব্রিগেডের সদস্য হন। তারপর থেকে আকাশে উড়ে যাওয়া তার আসল উদ্দেশ্য ও মিশন হয়ে ওঠে, যা তিনি সর্বদা মেনে চলেন।

চীনা জনগণের আকাশে উড়ে যাওয়ার যাত্রায় অনুসরণ করার মতো কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না এবং কোনও সংক্ষিপ্ত পথও ছিল না। সবকিছুই শুরু থেকে করতে হয়। পাঁচ বছর যাবত দিনরাত কঠোর প্রশিক্ষণের পর তিনি প্রথম সাফল্য নিয়ে চীন ও চীনা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে মহাকাশ অভিযান চালান।

২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর ইয়াং লিওয়েই শেনচৌ মহাকাশযানে মহাকাশ-যাত্রা শুরু করেন। তিনি বলেন, “এটি এমন একটি দিন, যা আমি কখনই ভুলবো না। এখন যখন আমি ২১ ঘন্টা ২৩ মিনিট উড়ার কথা ভাবি, তখন মনে হয়, প্রতি মিনিট ও প্রতি সেকেন্ড ছিল অতি মূল্যবান ও অবিস্মরণীয়।”

লং মার্চ রকেটটি শেনচৌ মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহুর্তে নিজের চোখের সামনের দৃশ্যটিকে স্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন তিনি। সেই সময় তার শরীর সিটে বাঁধা থাকলেও, মনে হয় সেটি সিট থেকে উড়ে যায়। তিনি বলেন, “যে মুহূর্তে আমি ওজনহীনতা অনুভব করি, আমি বুঝতে পারি যে, আমি তখন মহাকাশে।”

তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বিশাল মহাকাশ ও সুন্দর পৃথিবী যেখানে আমরা বাস করি, সেই মুহূর্তে আমি চীনা জনগণের জন্য গভীরভাবে গর্বিত বোধ করি।”

এক জনের একদিন থেকে একাধিক জনের একাধিক দিন পর্যন্ত, মহাকাশ গবেষণাগার থেকে স্পেস স্টেশনের সমাপ্তি পর্যন্ত, গত ২০ বছরে চীনের মানববাহী মহাকাশ শিল্প স্থল ও আকাশের মধ্যে যাতায়াত এবং মিলনস্থল ও ডকিংসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে সাফল্য অর্জন করেছে, ‘তিন-পদক্ষেপ’ কৌশলগত মিশন সম্পন্ন করেছে এবং বিশাল মহাকাশে চীনা জনগণের নিজস্ব ‘স্পেস হোম’ তৈরি করেছে।

ইয়াং লিওয়েই বলেন, “আরও বেশি কমরেডদের আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখে এবং থিয়েনকোংয়ে কমরেডদের মিলিত দেখে আমি খুব আনন্দিত এবং সবসময় তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত।”

সর্বপ্রথমে একদিন থেকে বর্তমানে আধা বছর পর্যন্ত, সর্বপ্রথমে একজন থেকে বর্তমানে ৬ জন মহাকাশচারীর একই সঙ্গে মহাকাশে কাজ করা পর্যন্ত, সর্বপ্রথমে মাত্র ৬ বর্গমিটারের স্পেস স্টেশন থেকে বর্তমানে ১১০ বর্গমিটার পর্যন্ত, সর্বপ্রথমে খাবার, পানীয় জল ও অক্সিজেন পৃথিবী থেকে আকাশে নিয়ে যাওয়া থেকে বর্তমানে স্টেস স্টেশনের অক্সিজেন শতভাগ পুনঃউৎপাদন পর্যন্ত, বিগত ২০ বছরে ইয়াং লিওয়েইয়ের নিজের অনুভব করা বিশাল পরিবর্তন অসংখ্য বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, “যখন শেনচৌ ৫ মহাকাশযান উড়েছিল, তখন আমাদের পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ কভারেজ ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী প্রদক্ষিণে মহাকাশযানটির ৯০ মিনিট সময় লেগেছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৫ মিনিটে মাটির সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম।” তিনি একটি উদাহরণ হিসেবে বলেন, এখন রিলে স্যাটেলাইট ব্যবহার করার পর পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণের কভারেজের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মহাকাশ শিক্ষাদানে পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির উন্নয়নের সাহায্যে আমরা টানা ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে কোনও বাধা ছাড়াই ভয়েস ও চিত্র প্রেরণ করতে পারি।”

প্রকৃতপক্ষে আজকের মহাকাশচারীরা মহাকাশে থাকাকালীন যে কোনও সময় পৃথিবীর সঙ্গে ভিডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন এবং তারা তাদের পরিবারের সাথে ফোনে কথাও বলতে পারেন। ইয়াং লিওয়েই বলেন: “এখন মহাকাশচারীরা মহাকাশে টিভিও দেখতে পারেন এবং পৃথিবীও মহাকাশচারীদের চাহিদা অনুসারে প্রোগ্রাম পাঠাতে পারে। এমনকি মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে অবস্থিত কর্মীদের সঙ্গে একযোগে বসন্ত উত্সব গালা এবং হাংচৌ এশিয়ান গেমসের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতা দেখতে পারেন।”

বর্তমানে চীনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফার মহাকাশচারীরা আকাশে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। শেনচৌ মহাকাশযানের ফ্লাইট ক্রুর মধ্যে রয়েছেন তৃতীয় দফার মহাকাশচারী। এখন রিজার্ভ মহাকাশচারীদের চতুর্থ ব্যাচের নির্বাচনের প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। মোট এক শ’জনেরও বেশি প্রার্থী পুনঃনির্বাচনের পর্যায়ে প্রবেশ করেছেন, যাদের মধ্যে হংকং ও ম্যাকাও থেকে আসা ব্যক্তির সংখ্যা দশের বেশি।

ইয়াং লিওয়ই বলেন, “চাইনিজ স্পেস স্টেশনটি কেবল আমাদের দেশের মহাকাশ পরীক্ষার প্ল্যাটফর্ম নয়, পুরো মানবসমাজকেও সেবা করতে সক্ষম এটি। তিনি বলেন: “আমি মনে করি, অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মহাকাশচারীরা আমাদের মহাকাশ স্টেশনে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে।”

চীনা মহাকাশ স্টেশনের সমাপ্তির সাথে সাথে চীনা মহাকাশচারীরা ৩ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার দূরে রহস্যময় চাঁদের প্রাসাদে তাদের মনোযোগ দিয়েছেন। ইয়াং লিওয়েই বলেন: “বর্তমানে চীনের মনুষ্যচালিত চন্দ্র-অন্বেষণ প্রকল্পের চন্দ্র-অবতরণ পর্বের মিশন সম্পূর্ণরূপে শুরু হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানববাহী মহাকাশযান এবং নতুন প্রজন্মের মানববাহী রকেটসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

সাক্ষাত্কারে সংবাদদাতা জিজ্ঞাস করেন, “পরবর্তীতে আপনি কি আবার মহাকাশে উড়ে যাবেন?”

উত্তরে ইয়াং লিওয়েই বলেন, “গত ২০ বছরে, অগণিত মানুষ আমাকে এই প্রশ্নটি করেছেন এবং আমার কাছে কেবল একটি উত্তরই আছে: মাতৃভূমির ডাকে সাড়া দিতে সর্বদা প্রস্তুত। মহাকাশে উড়ে যাওয়া আমাদের সকল মহাকাশচারীর অবিচল মূল লক্ষ্য।”