দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে সহায়তা দিচ্ছে চীনা সরকার
2023-10-23 14:00:05

চীনের কানসু প্রদেশের পিংলিয়াং শহরের সিয়ামেন হুই জাতি অধ্যুষিত জেলার শানখৌ গ্রামে ১১ বছর বয়সের মেয়ে সু ছিং এবং তার দুই ছোট বোন স্থানীয় সিয়ামেন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী। তাদের মায়ের শরীর ভালো না। তাদের বাবা একটি অস্থায়ী চাকরি করেন এবং টেনেটুনে সংসার চালান। একসময় এই পরিবারটি সরকারের সাহায্য দারিদ্র্যমুক্ত হয়। তবে, আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বলই রয়ে গেছে। এবার নতুন সেমিস্টারে তাঁরা গ্রামের কর্মদলের কাছ থেকে নতুন উপহার পেয়েছে, যা তাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।

২০২১ সালে লানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন কুও সিং শানখৌ গ্রামে এসে এখানকার দারিদ্র্যমুক্ত কর্মদলের কর্মী হন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের শিক্ষার ওপর বেশ মনোযোগ দেন। সু ছিং এবং তার দুই ছোট বোনের অবস্থা জেনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন এবং নিয়মিতভাবে তাদের জন্য ব্যাগ, স্টেশনারি ও বইসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে থাকেন। পাশাপাশি, তাদের জন্য প্রায় ৫০০০ ইউয়ানের বৃত্তিও সংগ্রহ করেন।

শিক্ষক আনের দৃষ্টিতে শিক্ষাদান হবে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্তির কার্যকর পদ্ধতি। তাই দারিদ্র্যমুক্ত পরিবারের বাচ্চাদের বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। কেবল এমন পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করাই যথেষ্ট নয়, বরং গ্রামের সংশ্লিষ্ট পরিবারের বাচ্চাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনাও পেশ করেন তিনি।

শিক্ষা একটি দেশের উন্নয়নের ভিত্তিস্তম্ভ। এর সাথে দেশের ভবিষ্যতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। চলতি বছরের জুন মাসে চীন সরকার ‘শ্রেষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ মৌলিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব’ পেশ করে। তখন থেকে চীনের জনসাধারণ মৌলিক পরিষেবাসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে।

এসব ব্যবস্থায় দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা, পিতামাতার কাছ থেকে দূরে থাকা বাচ্চারা, এবং প্রতিবন্ধী বাচ্চাসহ বিশেষ গ্রুপের জন্য বিশেষ যত্ন ও দেখাশোনার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।

চীনের বিভিন্ন মহল দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়। ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীনে বিভিন্ন দরিদ্র শিক্ষার্থীর জন্য আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ছিল ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ানেরও বেশি। এর মধ্যে যেমন সরকারি অর্থ আছে, তেমনি আছে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবদান।

চলতি বছর শানখৌ গ্রামের ৬৮ জন দরিদ্র ছাত্রছাত্রী লানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের কাছ থেকে বৃত্তি পেয়েছে। তা ছাড়া, কুইচৌ প্রদেশের পিচিয়ে শহরে ১৮ বছর বয়সের ছেলে মেং ছাও ছাত্র ঋণ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। ছেলে মেং ছাও স্থানীয় নাইয়ং জেলার পাঁচ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের একজন ছাত্র। তার বাবা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। তার পরিবারে আরও ৪ ভাই ও এক বোন রয়েছে। মাকে একাই টাকা উপার্জন করে পরিবারের আর্থিক বোঝা বহন করতে হয়, যা খুবই কষ্টের।

মেং ছাও বলেন, “গত কয়েক বছরে আমার ভাই-বোনদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রতিবছরের লেখাপড়ার খরচ ১০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি। তা ছাড়া, আমার বাবার পেছনে চিকিত্সাবাবদ অনেক খরচ হয়। যদি সরকারের ভর্তুকি না থাকতো, তাহলে আমার ভাই-বোনদের লেখাপড়া হতো না।”

নাইয়ং জেলা কুইচৌ উমেং পাহাড়াঞ্চলে অবস্থিত। এটি স্থানীয় চরম দরিদ্র এলাকার অন্যতম। ২০২১ সালে চীন চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে। তবে, স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের বাচ্চারা আগের মতো শিক্ষার অর্থায়ন সুবিধা পেয়ে বঞ্চিতই থেকে যায়। নাইয়ং জেলার শিক্ষা ব্যুরোর শিক্ষার্থী অর্থায়ন পরিষেবাকেন্দ্রের কর্মকর্তা ইয়ু ইয়ুন বলেন, উচ্চবিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি কুইচৌ প্রদেশের বিশেষ অর্থায়ন পেতে পারে। মেং ছাওয়ের মতো আরও অনেক দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী এমন সুবিধা পেয়েছে। তারা প্রতি সেমিস্টারে ১০০০ ইউয়ানেরও বেশি ভর্তুকি পায়।

জুলাই মাসে মেং ছাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র পেয়েছে। তার নতুন জীবন শুরু হয় এর মাধ্যমে। মেং ছাওয়ের জন্য সেটি বেশ আনন্দদায়ক ব্যাপার। যদি ভালো করে লেখাপড়া করে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রঋণ ও বৃত্তিও পেতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর চাকরি খুঁজে পেয়ে সে তার মাকে সাহায্য করতে চায়।

বস্তুত চীনের ছাত্র ঋণব্যবস্থা ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়। এ পর্যন্ত মোট ৪০০০০ কোটি ইউয়ান ঋণ দেওয়া হয়েছে এবং ২ কোটিরও বেশি দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী এতে উপকৃত হয়েছে। এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের গবেষক ছু চাও হুই বলেন, চীন সরকার দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এখন আর আর্থিক সংকটের কারণে কেউ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে না। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা আরও উন্নত ও সম্পূর্ণ হবে।

মেয়ে সু ছিং প্রাথমিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। প্রাথমিক স্কুলের শেষ পর্যায় এটি। শিক্ষক আন নিয়মিত তার পরিবারে গিয়ে খোঁজ-খবর নেন। সু ছিং ও তার দুই ছোট বোনকে যথাযথ সহায়তা দেন। মেয়ে সু ছিং শিক্ষক আনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, নতুন সেমিস্টারে সে আরো ভালো করে লেখাপড়া করবে। সে দুই ছোট বোনের জন্য উত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়।

 

পরীক্ষার উদ্বেগ দূর করার উপায়

আধুনিক সমাজের উন্নয়নের সাথে সাথে, লোকজন মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হয়েছেন ও হচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে লেখাপড়ার চাপের কারণে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে চীনের কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১২৩৫৫ হটলাইন চালু করেছে, যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা মানসিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য পেতে পারে।

 

এ হটলাইন চালুর পর অনেক ছাত্রছাত্রীর ফোন পেয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে পরীক্ষার জন্য বেশ উদ্বিগ্ন, আর এ কারণে তাদের মানসিক অবস্থাও ভালো না। হ্যছি জেলার একজন মাধ্যমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই চিন নির সাথে তার মনের কষ্ট শেয়ার করেছে। ছাত্র হুয়াং মাধ্যমিক স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন। পরীক্ষার আগে সে ভালো করে লেখাপড়া করতে পারেনি এবং এ কারণে মানসিক চাপে আছে। স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই’র কাছ থেকে মনের চাপ কমানো এবং লেখাপড়ায় আরও ভালো করার টিপস জানতে আগ্রহী ছাত্র হুয়াং।

 

স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই তার কষ্ট শুনে বিস্তারিতভাবে মানসিক সমস্যার মূল কারণ ও উত্স খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি জানতে চান, হুয়াং কি কোনো নির্দিষ্ট মেজরের বিষয় মনোযোগ দিয়ে শিখতে পারেনি, নাকি প্রত্যেকটি বিষয়েই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মাধ্যমিক স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার প্রায় এক মাস সময় বাকি আছে। এ মাসের মধ্যে আর কী কী দুর্বলতা মোকাবিলা করে সে পরীক্ষায় ভালো করতে পারে? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে তিনি ছাত্র হুয়াংকে বলেন। হুয়াং নিজের সমস্যা সঠিকভাবে বুঝতে পারে। তার পরীক্ষার ফলাফল ভালো করতে স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই বিস্তারিত পড়াশোনার পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেন হুয়াংয়ের জন্য।

 

ছাত্র হুয়াংয়ের মানসিক চাপ দূর করতে তিনি সঠিক বিশ্লেষণ করেন। ধীরে ধীরে ছাত্র হুয়াংয়ের মন শান্ত হয়ে যায়, সে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়ার চেষ্টা করছে।

 

বস্তুত তার মতো আরো অনেক ছাত্রছাত্রী আছে, যারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সম্মুখীন হলেই অন্য সময়ের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয় ও তাদের মন খারাপ হয়। এ অবস্থা মোকাবিলায় মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ দেন স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই। এভাবে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থা সঠিক বিবেচনা ও পর্যালোচনা করতে সক্ষম হয়, নিজেদের মেজাজ ও মানসিক পরিবর্তনও বুঝতে পারে। স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই’র দৃষ্টিতে মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মানসিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে সক্ষম। এর ওপরে আছে ১২৩৫৫ হটলাইন। তাঁরা এ নম্বরে ফোন করে পরামর্শ চাইতে পারে।

 

স্বেচ্ছাসেবক ওয়েই মনে করেন, পিতামাতার উচিত নয় পরীক্ষার আগে বাচ্চার ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা। যদি বাচ্চারা মনের কথা শেয়ার করতে চায়, তাহলে বাবা-মার উচিত মনোযোগ দিয়ে তা শোনা। কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করা উচিত নয়। নিয়মিতভাবে বাচ্চার কাছ থেকে খোঁজ-খবর নেওয়া ভালো। জানতে চাইতে হবে যে, বাচ্চার কোনো সাহায্য লাগবে কি না বা পিতামাতা বাচ্চাকে পড়াশোনায় কোনো সহায়তা দিতে পারে কিনা। আরেকটি বিষয়, মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চবিদ্যায়ের শেষ বর্ষে বাচ্চাকে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়ার দরকার নেই। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

 

কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের পরিষেবা প্ল্যাটফর্ম ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ৮ জন পেশাদার কর্মী, ১০০০ জনেরও বেশি মনোবিজ্ঞান ও আইনের পরামর্শক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তারা হটলাইনের ফোন ধরেন। যদি ছুটির দিনে কেউ ফোন করে, তারা নিজের কথা রেকর্ড করে ম্যাসেজ আকারে দিতে পারেন। কর্মীরা অফিসে আসার পর তাদের সাথে যোগাযোগ করেন।

 

চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে এ হটলাইন বেশ ব্যস্ত ছিল। অনেক বাচ্চা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত টানা কয়েক মাস ধরে হটলাইনে বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছে। এভাবে যত বেশি সম্ভব ছাত্রছাত্রীকে সহায়তা দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য। তা ছাড়া, অফলাইন অনুষ্ঠানে মনোবিজ্ঞান শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে গিয়ে লেখাপড়ার চাপ কমিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি আর কার্যকর লেখাপড়ার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে ১২৩৫৫ হটলাইনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি লিয়ান ইয়ু থিং বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তারা মোট ১০ হাজার ৮৪০টি ফোন পেয়েছেন এবং ফোনালাপে মোট ৬৭ হাজার মিনিট ব্যয় করেছেন। তাদের সাহায্যে অনেক ছাত্রছাত্রীর মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)