থাং রাজবংশের ওয়াং শুয়ান ছে-এর তিনবার ভারত সফর
2023-10-22 20:35:45

থাং রাজবংশের প্রথম দিকে, কূটনীতিবিদ ওয়াং শুয়ান ছে ভারতে তিনবার সফর করেছিলেন; যেখান থেকে আমরা থাং রাজবংশের উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কূটনৈতিক দর্শন উপলব্ধি করতে পারি।

ওয়াং শুয়ান ছে থাং রাজবংশের একজন কূটনীতিক ছিলেন এবং তিনি দশ খণ্ডে "মধ্য ভারত ভ্রমণ কাহিনী" লিখেছিলেন। হিউয়ান সাং-এর পরে তিনি ছিলেন চীন-ভারতবর্ষ কূটনীতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া একজন কূটনীতিবিদ। তিনি "অতুলনীয় সাফল্য" অর্জন করেছিলেন এবং প্রাচীন চীনা কূটনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছেন।

সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে, ভারতবর্ষ ছিল থাং রাজবংশের কূটনৈতিক সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সে সময় ভারতে ৭০টিরও বেশি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। ৬৪০ সালের দিকে, থাং রাজবংশের একজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী হিউয়ান সাং ধর্মের সন্ধান করতে ভারতে যান এবং মধ্য ভারতবর্ষের মগধের রাজা হর্ষ বর্ধনের সাথে সাক্ষাত করেন। রাজা হর্ষ থাং রাজবংশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পর, ৬৪১ সালে একদল দূত ছাংআনে পাঠান। এটি ছিল থাং রাজবংশের সময় ভারতের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ। সেই সময় থাং রাজবংশের সমৃদ্ধ রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কারণে আশেপাশের অনেক জাতিগোষ্ঠী এবং রাজ্যগুলি থাং রাজবংশের কাছে দূত পাঠাতো। পরে, থাং রাজবংশ ওয়াং শুয়ান ছে’কে ভারতে দূত হিসাবে পাঠিয়েছিল।

৬৪৩ সালে, ওয়াং শুয়ান ছে ২২জন সদস্যের একটি দূতদলের সাথে প্রথমবার ভারতবর্ষে যান। তারা তিব্বত ও নেপাল দিয়ে মধ্য-ভারতে পৌঁছান। ভারতবর্ষের রাজা তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ৬৪৬ সালের দিকে, তারা ছাংআনে ফিরে আসেন। পরে, থাং রাজবংশের সম্রাট থাইজং লাওজির "তাও তে চিং" সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করার জন্য হিউয়ান সাং’কে দায়িত্ব দেন। হিউয়ান সাংয়ের নেতৃত্বে ৩০জনের একটি অনুবাদক দল "তাও তে চিং"-এর সংস্কৃত সংস্করণ ভারতে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন।

ওয়াং শুয়ান ছে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় মিশন ছিল ৬৪৭ সালে। এই সময়, ওয়াং শুয়ান ছে ৩০জনেরও বেশি লোকের একটি দলের নেতৃত্ব দেন। তারা তিব্বতের মধ্য দিয়ে যান এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সফর করেন। মগধের রাজা হর্ষ মারা যাওয়ার পর মন্ত্রীরা বিদ্রোহ করে এবং থাং দূতদলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। ওয়াং শুয়ান ছে রাজবংশের বন্ধুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির সাহায্যে বিপদ থেকে রক্ষা পান এবং ছাংআনে ফিরে আসেন। ৬৫৭ সালে, ওয়াং শুয়ান ছে তৃতীয়বারের মতো ভারতবর্ষে দূত হিসেবে সফর করেন। এবার তার প্রধান কাজ ছিল ভারতে বুদ্ধ কাসক পাঠানো। ভারতে তৃতীয় সফরে সময় লেগেছিল প্রায় ৪ বছর।

ওয়াং শুয়ান ছে ভাল করেই জানতেন যে, দেশগুলির মধ্যে বিনিময় সবসময় মসৃণ হয় না। তবে তাকে অবশ্যই সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি ভারতবর্ষে তিনবার সফর করেছিলেন, থাং রাজবংশের অনেক বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত জিনিসপত্র নিয়ে আসলেন, চীন ও ভারতের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান প্রচার করলেন এবং মধ্য-এশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখলেন। তাতে থাং রাজবংশের সময় সক্রিয় বিদেশনীতি ও পদ্ধতি প্রতিফলিত হয়।

থাং রাজবংশের শাসকদের সক্রিয় কার্যক্রম চীনের প্রাচীন কূটনীতিকে একটি নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। প্রথমত, থাং রাজবংশ একটি সর্বাঙ্গীণ এবং বহু-ক্ষেত্রে উন্মুক্ততার নীতি বাস্তবায়ন করেছিল। থাং রাজবংশ একটি উন্মুক্ত, নমনীয় এবং অবাধ মুদ্রানীতি প্রয়োগ করেছিল। যা বিদেশি মুদ্রাকে অভ্যন্তরীণভাবে সঞ্চালনের অনুমতি দেয় এবং চীনে বিদেশিদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহজতর করে। থাং সরকার কর কমাতে এবং বাণিজ্যের জীবনীশক্তিকে উদ্দীপিত করতে আগ্রহী ছিল। থাং রাজবংশের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় প্রশাসনিক সংস্থাগুলিতে কাজ করার জন্য সক্রিয়ভাবে বিদেশি প্রতিভা নিয়োগ করেছিল। যাতে অনেক বিদেশি ব্যক্তি চীনের ইতিহাসে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, তুর্কি আশিনাদুর থাং রাজবংশে একজন সামরিক জেনারেল হয়েছিলেন এবং রাজকন্যার স্বামী হয়েছিলেন। জাপানি ফুজিওয়ারা কিয়াকা একজন সচিব হয়েছিলেন। পারস্য রাজবংশ পতনের পর পারস্যের রাজকুমার বালুস থাং রাজবংশে আসেন এবং থাং কাও জোং তাকে আশ্রয় দিয়েছেন এবং তাকে একটি এলাকা শাসন করার জন্য সরকারি কর্মকর্তা বানিয়েছেন।

বিদেশি সংস্কৃতির বিষয়ে, থাং রাজবংশ সহনশীল ছিল, বিদেশিদের রীতিনীতি ও বিশ্বাসকে সম্মান করত এবং চীনে তাদের নিজস্ব ধর্মের সংস্থা নির্মাণের অনুমতি দিতো। যার ফলে থাং রাজবংশের সময় সামগ্রিকভাবে বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিকীকরণের মুখ দেখা গিয়েছিল। থাং রাজবংশ সব দেশের সমতার পক্ষে ছিল। সব জাতি, বর্ণ, সংস্কৃতি এবং ভাষার মানুষ যখন থাং রাজবংশের কাছে আসতো, তখন তাদের সমানভাবে নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হত এবং কূটনৈতিক কার্যকলাপে সমানভাবে সম্মান করা হত। থাং রাজবংশে বসবাসরত বিদেশিদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছিল এবং আন্তর্জাতিক বিবাহে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ছিল না। থাং রাজবংশে বিদেশি ভ্রমণকারীদের দেশি মানুষের মত সুযোগ দেওয়া হত। তাদের শুধুমাত্র একটি সরকারি নথি আনতে হতো, তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, বহন করা জিনিসপত্র এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য লিখতে হতো এবং থাং সরকারের অনুমোদন নিতে হতো।

দ্বিতীয়ত, থাং রাজবংশের উন্মুক্ত অবস্থা ছিল সার্বিক, আদর্শিক, সুশৃঙ্খল ও সুরক্ষামূলক। বৈচিত্র্যময় এবং টেকসই কূটনৈতিক কার্যকলাপ জাতীয় মৌলিক শক্তির উপরে ভিত্তি করে স্থাপিত হয়েছিল, যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, উন্মুক্ত প্রশাসন এবং সুবিধাজনক পরিবহন ইত্যাদি।

সর্বশেষ, থাং রাজবংশের উন্মুক্তকরণ শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল। থাং রাজবংশ খোলা মন নিয়ে বিভিন্ন সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিল। থাং রাজবংশের সম্রাট থাইজং একবার বলেছিলেন: "প্রাচীনকাল থেকে, চীনা জাতি সর্বদা নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ মনে করত এবং বর্বর ও বিদেশকে তুচ্ছ মনে করতো। কিন্তু আমি উভয় পক্ষকে সমানভাবে ভালবাসি।" থাং রাজবংশ সাম্য ও সহনশীলতার উপর জোর দিয়েছিল এবং চীন ও অন্য দেশের পার্থক্যের ঐতিহাসিক ধারণা এ সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্তর্ভুক্তি আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন। থাং রাজবংশের আত্মবিশ্বাস ছিল দেশের বিশাল ব্যাপক জাতীয় শক্তির ভিত্তিতে। যার মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও প্রতিরক্ষা শক্তি রয়েছে।

(ইয়াং/তৌহিদ/ছাই)