চীনের অর্থায়নে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাংলাদেশে স্থানীয়দের উপকার করে
2023-10-20 19:01:00

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছে একটি গ্রামে অবস্থিত একটি আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্ট চীনের অর্থায়নকৃত প্রকল্প যা স্থানীয় পরিবেশ এবং মানুষের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। যা আট বছর কঠিন কাজের পর গত জুলাই মাসে শেষ হয়েছে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি যুগান্তকারী অবকাঠামো প্রকল্প দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার যা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রকল্প।

 

কারখানাটি ঢাকার দক্ষিণ শহরতলির দাশেরকান্দি গ্রামে অবস্থিত, একটি ঘন নদী নেটওয়ার্কের এলাকা।

 

স্থানীয় এলাকায় ৩০ বছরের পুরানো জরাজীর্ণ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ছিল। স্থানীয়রা ভয়ানক পানি দূষণের উদ্বেগ নিয়ে দিনযাপন করত। ঢাকার ২ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পেয়ে থাকে।

 

পাগলা স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের দায়িত্বশীল ব্যক্তি রাহাত শিকদার বলেন, "পাগলা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর ধারণক্ষমতা ১২০ হাজার ঘনমিটার। আপনি জানেন যে, এই প্ল্যান্টটি ৩০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই সরঞ্জাম এবং প্রধান পাইপ লাইনগুলি পুরানো।"

 

আট বছর আগে দাশেরকান্দি গ্রামের গাচ ও তার ভাই মাছের পুকুরের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু দূষিত পানিতে সব মাছ ও চিংড়ি মারা গেছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ২৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চিংড়ি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হতো।

 

জল দূষণ দাশেরকান্দিতে জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল, কারণ গ্রামবাসীরা জল-সম্পর্কিত পেশা থেকে বের হতে পারে নি। তারা মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩০ ডলারের কম নিয়েই টিকে ছিল।

 

২০১৫ সালের গ্রীষ্মে যখন গাচ এবং তার ভাই মাছের পুকুর ব্যবসায় ব্যর্থ হয়, তখন একদল চীনা দাশেরকান্দি গ্রামে আসে।

তারা চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভারী ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নির্মাণ কোম্পানি পাওয়ার চায়না ছেংতু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লিমিটেডের প্রকৌশলী। তারা এখানে একটি নতুন পানি শোধনাগারের জন্য প্রাথমিক জরিপ চালাতে এসেছেন।

 

পাওয়ার চায়নার দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জেনারেল প্রজেক্ট ম্যানেজার চাং ছেং বো তার প্রথম সফরের কথা স্মরণ করে বলেন, "আবর্জনাসহ প্রচুর পয়ঃনিষ্কাশন সরাসরি নদীতে ফেলা হয়েছিল। মাছের মত প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব না।

 

২০১৬ সালের অক্টোবরে, চীন ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অফ চায়না (এক্সিমব্যাঙ্ক) এতে অর্থায়ন করবে এবং পাওয়ার চায়না ছেংতু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লিমিটেড নির্মাণকাজে সহায়তা করবে।

 

"এটি একটি খুব ভাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট যা চীনা এক্সিমব্যাঙ্ক এবং চীন সরকারের সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশেও খুব ভাল প্রভাব ফেলেছে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ, আমরা জানি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের চীনা উদ্যোগ, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান বলছিলেন।

৫ লাখ-টন-প্রতি-বার্ষিক প্রক্রিয়াকরণ সুবিধার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের আগস্টে চীন থেকে ঋণ, প্ল্যান্টের নকশা এবং নির্মাণ সরঞ্জামের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে।

 

নির্মাণের বছরগুলিতে, দলটি ধারাবাহিক প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিক বাধা অতিক্রম করেছে। চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে গ্যাস লাইন এবং স্যুয়ারেজ লাইনের অবস্থান ডিজাইন করা, সেইসাথে মহামারী চলাকালীন যখন শিপিং মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল তখন সরঞ্জাম এবং নির্মাণ সামগ্রী প্রেরণ করার জটিলতা।

 

চিংড়ি বিক্রেতা গাচ এবং তার ভাই সবাই নতুন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের নির্মাণ বিভাগে চাকরি পান। গাচের বিয়ে হয়েছিল এবং তার সন্তানের বয়স এখন ৩ বছর।

 

"আপনি জানেন যে, আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০-এর বেশি। মোট এখন ১০ জন। প্রতি মাসে দশ জনের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। আমি খুব খুশি কারণ এই পাঁচ বছর, আমার পরিবারের জন্য খাবার এবং অন্যদের জন্য সমস্যা হয় নি, "গাচ একথা বলছিলেন।

 

নতুন প্ল্যান্ট নির্মাণের অগ্রগতি ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ সালে একটি মাইলফলক পর্যায়ে পৌঁছায় যখন ইঞ্জিনিয়াররা জল পাম্প করে গেটটি পরীক্ষা করেছিলেন। সাইটে সবাই উল্লাস করে এবং তা উদযাপন করে।

 

জেনারেল প্রজেক্ট ম্যানেজার চাং ছেং বো বলেন, "গেটটি টেনে তোলার পর, সবাই উত্তেজিত এবং রোমাঞ্চিত হয়।"

 

"অগণিত প্রচেষ্টা এবং এত দীর্ঘ সময়ের সমন্বয়ের পরে, এটি কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া এবং একটি এক তক্তার সেতু অতিক্রম করার মতো ছিল। এটি সত্যিই একটি যুদ্ধের মতো ছিল" বলছিলেন দাশেরকান্দি স্যুয়েজ ট্রিটমেন্টের প্রধান ডিজাইনার হ্য লি।

 

"আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আপনারা এখানে অনেক কিছু করেছেন। কোভিড-১৯ এর মধ্যেও তারা কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তারা এই কাজটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করেছে," বলেন ঢাকা সিটি পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো  মহসিন আলী মিয়া।

 

গত ১৪ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম প্ল্যান্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।

 

চীনা প্রকৌশলীরা যখন তাদের কাজ গুটিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বাংলাদেশি কর্মীরা প্ল্যান্টের কাজ নিজের হাতে বুঝে নিতে শুরু করেছে। প্রকল্পটি স্থানীয় লোকজনের জন্য বেশ কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি করেছে।

 

"আমি যখন চাইনিজ কোম্পানিতে যোগদান করি, তারা আমাকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে চপস্টিক্স ব্যবহার করতে হয়। চীনারা সবসময়ই দক্ষতার জ্ঞান অন্য ব্যক্তিকে শেখায়। আমি চাইনিজ মানুষ এবং চীনা সংস্কৃতি পছন্দ করি। আমি কিছু চীনা ভাষা জানি," বলেন বাংলাদেশি কর্মচারী। যিনি নিজেকে মা মেং বলে পরিচয় দেন।

 

নতুন প্লান্টটি এখন ঢাকার ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ করছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একসময়ের দূষিত ৪০০টিরও বেশি জলপথকে সুন্দর নদীতে পরিণত করছে।

 

এ বছর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের দশম বার্ষিকী এবং বিআরআই অবকাঠামো প্রকল্পের অন্যান্য ইতিবাচক পরিবর্তনগুলি মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করার পথে রয়েছে।