স্বর্গের মতো শহর হাংচৌ-৩
2023-10-18 10:27:05

গত সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম, ২৩ সেপ্টেম্বর হাংচৌ এশিয়ান গেমস উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আমি ও রুবি হাংচৌয়ের পশ্চিম হ্রদে শুটিং ও লাইভ ভিডিও করেছি। ভিডিও তিনটি অংশে বিভক্ত। সেগুলো হলো হাংচৌয়ের তিনটি অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐহিত্য - পশ্চিম হ্রদ, বেইজিং-হাংচৌ মহাখাল এবং লিয়াং চু ধ্বংসাবশেষ।

চব্বিশ সেপ্টেম্বর আমরা বেইজিং-হাংচৌ মহাখালের হাংচৌ অংশে দেখতে যাই। এর আগে আমরা এবার এশিয়ান গেমসের সাংবাদিকের জন্য বিশেষ পরিবহন কার্ড পেয়েছি। এ কার্ড দিয়ে হাংচৌ এশিয়ান গেমস ও প্যারা গেমস চলাকালে

বিনামূল্যে বাস ও সাবওয়েতে চড়া যায়। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে আমি ও রুবি সাবওয়ে দিয়ে মহাখালে যাই।

হাংচৌর সাবওয়ে ব্যবস্থা গোটা চীনের মধ্যে বেশ উন্নত। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাংচৌতে মোট ১২টি সাবওয়ে লাইন চালু হয়, যেগুলোতে মোট ২৬০টি স্টেশন রয়েছে। হাংচৌর সাবওয়ে লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৬১০ কিলোমিটার। হাংচৌর ১০টি এলাকাকেই সাবওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে।

সাবওয়ে চড়ে হাংচৌর যে কোনও জায়গা যাওয়া যায়। আমরা দুজন দু’বার সাবওয়ে লাইন বদলে মহাখালের কুংচেন নামক একটি সেতুর কাছে পৌঁছাই। এবারের মাস্কটের অন্যতম চেন চেনের নাম এ সেতুর নাম থেকে এসেছে।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগ থেকে বেইজিং-হাংচৌ মহাখালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এটি বিশ্বে দীর্ঘতম ও প্রাচীনতম মহাখালের অন্যতম। এটা মহাপ্রচীর ও খান এ্য চিং (ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ প্রকল্প)সহ প্রাচীন চীনের তিনটি মহান প্রকল্পের অন্যতম এবং এসব এখন পর্যন্ত কাজে লাগছে। সেটি চীনা সংস্কৃতির একটি প্রতীকও। মহাখাল দক্ষিণের হাংচৌ থেকে শুরু হয়ে চেচিয়াং, শানতুং, হ্য পেই প্রদেশ ও থিয়ান চিন শহর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তরের বেইজিং পর্যন্ত এসেছে। হুয়াং হ্য নদী ও ইয়াংজি নদীসহ ৫টি নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ মহাখাল। তার মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৯৪ কিলোমিটার এবং এ খাল উত্তর ও দক্ষিণ চীনের মধ্যে অর্থনীতি, সংস্কৃতি উন্নয়ন ও বিনিময় এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ব্যবসা ও কৃষির উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করে।

মজার ব্যাপার হলো আমার জন্মস্থান শানতুং প্রদেশ, যেখানে মহাখালের একটি অংশ আছে। বর্তমানে আমি বেইজিংয়ে বাস করি। মহাখালের বেইজিং অংশ আমি অনেকবার দেখেছি। এবার আমি হাংচৌয়ে এসেছি আর মহাখালের হাংচৌ অংশে বেড়িয়েছি। আমার জন্য এটি অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।

সেদিন কোনও ছুটি না হলেও কুং চেন সেতুতে অনেক ভিড় দেখা যায়। কুং চেন হাংচৌতে সবচেয়ে উচ্চ ও দীর্ঘ একটি পাথর-সেতু। এর ইতিহাস ৪শ’ বছরের বেশি সময়ের। এটি বেইজিং-হাংচৌ মহাখালের এক প্রান্তের সমাপ্তিবিন্দুও। মানুষ এ সেতু দেখে বুঝতে পারে তারা মহাখালের শেষ অংশ হাংচৌতে পৌঁছেছে।

হাজার বছরের পরিবর্তনে মহাখালের কিছু অংশে পানি কমে যাওযার কারণে আর জাহাজ চলতে পারে না। তবে হাংচৌ অংশে এখনও পর্যন্ত নানা জাহাজ চলাচল করে। আমরা এখানে বড় কাগো জাহাজ দেখেছি, যাতে কন্টেনার বহন করা হয়। এখানে আরও আছে ছোট পর্যটন জাহাজ, যাতে চড়ে পর্যটকরা মাহখালের দু পাশের দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। এর মধ্যে একটি নিজিস আমাকে আকর্ষণ করে সেটি হল পানি-বাস। হ্যাঁ নাম থেকে আপনারা বুঝতে পারছেন। এটি পানিতে চলা বাসের মতো একটি জাহাজ। এর টিকিটও বাসের মতো সস্তা, মাত্র তিন ইউয়ান। এ পানি-বাস কয়েকটি বন্দরে থামে। আমাদের বিশেষ পরিবহন কার্ড দিয়ে এটাও চড়তে পারি বিনামূল্যে। তবে অনেক মানুষ এখানে অপেক্ষারত, যার অর্থ হলো ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা এ বাসে উঠতে পারব না। তাই এ বাসে না চড়ার সিদ্ধান্ত নিই আমরা।

সকালের কাজ শেষ করে আমরা সাংবাদিক গ্রামে ফিরে যাই এবং রাতে আরেকটি অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিই। আমি ও রুবি নিয়মিত ‘শাড়িতে ভ্রমণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। সে অনুষ্ঠানে আমরা দুজন শাড়ি পরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দর্শকদের সামনে চীনের সুন্দর দৃশ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরি। হাংচৌতে আসলেও আমরা একটি শাড়ি পরা অনুষ্ঠান করি। আমাদের সাংবাদিক গ্রামের অদূরে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র আছে। এশিয়ান গেমস উপলক্ষ্যে সেখানে এশীয় ফুল নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে। ফুল প্রদর্শনীর সঙ্গে শাড়ি বেশ মানানসই, তাইনা? তাই আমরা দুজন শাড়ি নিয়ে সেখানে যাই। শাড়ি পরা কঠিন ও জটিল একটি কাজ। অনেক বার পরলেও আমি এখনও নিজে সেটা পরতে পারি না। প্রতিবার রুবি আমাকে সাহায্য করেন। আমরা সাধারণত কাছাকাছি কোনও বাথরুমে নিজে নিজে শাড়ি পরি। শাড়ি পরার পর বাইরে আসি, অনেকে আমাদেরকে দেখে অবাক হয়। তবে আমাদের জন্য এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাদের পোশাক চিনতে পারেন। তারা এমনকি শাড়ির নামও জানেন। অবশ্য কেউ কেউ আামাদেরকে নৃত্য-অভিনেত্রী মনে করেন। আমরাও রাগ করি না, মজার অভিজ্ঞতা হিসেবে নিই সেটা। শাড়ি পরলে ধীরে হাঁটতে হয়। ওই দিন খুব গরম ছিল। বেইজিংয়ের আবহাওয়া ইতোমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবে হাংচৌতে গ্রীষ্মকালের মতো গরম ও আর্দ্র। শাড়ি পরার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘামতে শুরু করি। তাছাড়া, রাতে ফুল প্রদর্শনীতে অনেক বাতি জ্বালানো হয়। ভীড়ের মধ্যে আরও বেশি গরম লাগে। লাইভ অনুষ্ঠান শেষ করে আমি ভীষণ ক্লান্ত বোধ করি। রাস্তার পাশে বসে মাথা খালি করতে চেষ্টা করি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা ১২ ঘন্টার মতো কাজ করেছি। সত্যি বলতে কি - অফিসের কাজের চেয়ে ব্যস্ত ও কঠিন সময় কাটছে আমাদের। আমরা দুজন একটি দোকান থেকে দুই কাপ দুধ চা কিনি। দীর্ঘ কাজের পর এ দুধ চা দারুণ সুস্বাদু লাগে। দুধ চা খাবার ফাঁকে আমি অনলাইনে একটু চেক করি। ওইদিন বাংলাদেশ ও ভারতের নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। ভারতের কাছে হেরে যাওয়া বাংলাদেশকে পরের দিন পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হবে ব্রোঞ্জ পদকের জন্য। এটি এবার এশিয়া গেমসে বাংলাদেশের প্রথম পদক হতে পারে। আমি মনে করি বাংলাদেশ ফাইনালে যেতে পারত। তবে লটারির কারণে সেমি-ফাইনালে ভারতের সঙ্গে দেখা হয়। শক্তিশালী দুটি দলের ভাগ্যও ভিন্ন হয়। যাই হোক আমি ও রুবি সিদ্ধান্ত নিই পরের দিন ব্রোঞ্জ পদকেরে ম্যাচ দেখতে যাব। সেখানে হয়ত মেয়েদের সঙ্গে আবার কথা হবে।

পচিশ সেপ্টেম্বর আমরা আবার ক্রিকেট ভেন্যুতে চলে আসি। আমরা যতক্ষণে পৌঁছাই প্রতিযোগিতা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ দল তখন এগিয়ে রয়েছে এবং আর কিছু পয়েন্ট লাভ করলে ব্রোঞ্জ পদক ঘরে তুলতে পারবে। আসলে আগে আমি কেবল ক্রিকেটের কথা শুনেছি এবং তার নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। ইন্টারনেট কিছু ভিডিও খুঁজে দেখেছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি। ওই দিন আমি প্রথম বারের মতো সরাসরি ম্যাচ দেখি। প্রথম বার বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের ম্যাচ বাতিল হয় তাই আমি বাংলাদেশ দলের খেলা আগে দেখতে পারিনি। এবার আমি খেলা দেখার পাশাপাশি কাছে একজন স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাকে নিয়ম বুঝিয়ে দেন এবং কথা বলতে বলতে আমিও ম্যাচ বুঝতে শুরু করি। নতুন কিছুও শিখি। খুব আনন্দ লাগে। ম্যাচটা সময়মতো শেষ হয় এবং বাংলাদেশের মেয়েরা এবারের এশিয়ান গেমসের দেশের জন্য প্রথম পদক লাভ করেন। তাদেরকে অভিনন্দন জানাতে আমরা প্রথম তলায় সাক্ষাত্কার এলাকায় তাদের জন্য অপেক্ষা করি। অধিনায়ক নিগার সুলতানা এবং অন্য দুজন খেলোয়াড় মারুফা আক্তার ও সানজিদা আক্তার মেঘলা আমাদের সাক্ষাত্কার দেন। এদিনের পারফরম্যান্সে সবাই বেশ সন্তুষ্ট। যদিও ভারতের কাছে হেরে তারা হতাশ হয়েছিলেন, তবে আজকের খেলার সাথে মানিয়ে নিতে নিজের অবস্থা সমন্বয় করেন। সাক্ষাত্কারের পর আমরা বাইরে আসি এবং মেয়েদের সঙ্গে আবার কথা বলতে চাই। আমরা তাদের বাসের পাশে একটু অপেক্ষা করি। তারা বের হন এবং আমাদেরকে দেখেন। দু’বার দেখার পর আমরা পরস্পরের মধ্যে একটু পরিচিত হই। তাদের সঙ্গে একটি ছবি তোলার কথা বলি, তারাও সানন্দে রাজি হন। তাই বাসের চালকের সাহায্যে আমরা বাংলদেশি নারী দলের সঙ্গে একটি গ্রুপ ফটো তুলি। এ ছবিটা আমার বেশ ভাল লাগে। তাদের সঙ্গে কথার মাধ্যমে জানতে পরি, তারা পরের দিন ছুটি পাবেন আর ২৭ তারিখে বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। যাবার আগে তারা হাংচৌতে কিছু কেনাকাটা করতে চান; পরিবারের জন্য কিছু উপহার কিনতে চান। আমি ও রুবি তাদেরকে বাজারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পরের দিন তাদের হোটেলে গিয়ে তাদেরকে নিয়ে যাব। পরে মেয়েরা বাসে করে হোটেলে ফিরে যান। আমি ও রুবিও ফিরতে যাচ্ছি এমন সময় একজন বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর নাম মোরসালিন আহমেদ। আমরা দুজন বাংলা ভাষা বলতে পারি দেখে তিনি অবাক হন। তার সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ আলাপ করি। উনি আমাকে জানান, তিনি ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক গেমস এবং ২০১০ সালের কুয়াং চৌ এশিয়ান গেমস উপলক্ষ্যে বেশ কয়েক বার চীন সফর করেছেন। চীনা মানুষের আন্তরিকতা তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। আমরা তাকে একটি সাক্ষাত্কার দেওয়ার অনুরোধ জানাই। উনি রাজি হন।

সাক্ষাত্কার দেওয়ার পর মিডিয়া কেন্দ্রে ফেরার বাসে উঠি। জনাব মোরসালিন ও অন্য দুজন বাংলাদেশি সাংবাদিক আমাদের সঙ্গে সাংবাদিক মিডিয়া কেন্দ্রে ফিরে আসেন। বাসে তারা আমাদেরকে জানান, তারা পরের দিন সকালে দেশে ফিরে যাবেন, পাশে কোনও বাজার যদি থাকে তারা একটু বেড়াতে চান। রুবি তাদেরকে নিয়ে যেতে চান, তবে আমার হাতে ভিডিও বানানোর কাজ রয়েছে। তাই মিডিয়া কেন্দ্রে লাঞ্চ করার পর আমরা আলাদা হয়ে যাই। রুবি তাদেরকে নিয়ে ট্যাক্সিতে করে বাজারে যান আর আমি সাংবাদিক গ্রামে ফিরে যাই ভিডিও করার জন্য। সেদিনের কাজ এ পর্যন্ত। রাতে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের একজন কোচের সঙ্গে কথা হয় এবং তাদের হোটেলের ঠিকানা পাই। ভাবছিলাম পরের দিন আমরা ট্যাক্সিতে করে হোটেলে যাব তার পর তাদেরকে নিয়ে বাজারে যাব।

তবে পরের দিন আমরা দুজন হারিয়ে যাই আর তাদের স্থানীয় ফোন নম্বর না থাকার কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে অসুবিধায় পড়ি। এমন পরিস্থিতে আমরা কী করি? জানাব আগামী সপ্তাহের অনুষ্ঠানে। (শিশির/রহমান/রুবি)