‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ৪০
2023-10-17 20:09:40

 

এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে   

১। থিয়েন আনমেন স্কয়ারে একদিন

২।  প্রাচীন সিল্ক রোডের স্মৃতি রোমন্থন পর্যটকদের 

৩। ঘুরে আসুন লামা টেম্পল থেকে 


বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’  

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"। 

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।   

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৪০তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।    

১। থিয়েন আনমেন স্কয়ারে একদিন

বেইজিংয়ে এটা ছিল আমার প্রথম সকাল। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরেই রওনা হলাম থিয়েনআন মেন স্কয়ারের উদ্দেশ্যে। একটি ট্যাক্সি করে রওনা হলাম আমি ও আমার সফর সঙ্গীরা। সিআরআই মিডিয়া হোটেল থেকে মাত্র ৪০ মিনিট পর আমরা পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্য। ট্যাক্সি থেকে নেমেই চোখে পড়ল গেটের সামনে বিশাল লাইন। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনের আশেপাশে যারা ছিল তারা নিজেদের আইডি কার্ড দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। আমরা যেহেতু বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি তাই আমরা পাসপোর্ট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। 

 


গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল হাজারো মানুষের ঢল। সবাই আসছে থিয়েন আনমেন স্কয়ার দেখতে। বিভিন্ন বয়সী পর্যটককের সাথে সাথে আমরাও হাঁটতে শুরু করলাম।যতই সামনের দিকে হাঁটছিলাম পরিচ্ছন্ন রাস্তা, গিংকো গাছের সারি দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম আমি। 

একটু সামনে এগিয়ে চোড়ে পড়ল বিশাল জায়গা জুড়ে খোলা চত্ত্বর। মাঝখানে শোভা পাচ্ছে কৃত্রিম ফুলের আর্টওয়ার্ক। আর বিস্তৃত এই চত্তরের একদিকে চীনের মহা গণভবন, একদিকে ফরবিডেন সিটি ও অন্যদিকে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ চায়না। আর মাঝখানে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে চীনা সৈনিকদের স্তৃতিস্তম্ভ। 


প্রাচীন শহরের গেটগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা থিয়েনআনমেন স্কয়ার বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় অক্ষের ক্রস-সেকশনে অবস্থিত।এক সময় একে চংথিয়ান গেইট বলা হতো। মিং রাজবংশের সময়ে দুবার ধ্বংস হয়েছিল এই ঐতিহাসিক জায়গা। ১৬৫১ সালে ছিং রাজবংশের সম্রাট শুনচির রাজত্বের ৮ম বছরে পুলিন নামের এক সম্রাট বৃহৎ পরিসরে পুনর্নির্মাণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন থিয়েনআনমেন স্কয়ার।

 

মিং রাজবংশ ও ছিং রাজবংশের সময়ে থিয়েনান মেন স্কয়ার ছিল সকল গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের প্রধান স্থান। বিশেষ করে যখন সম্রাটদের রাজ্যাভিষেক বা সম্রাজ্ঞী উপাধি প্রদানের জন্য রাজকীয় আদেশ জারি করা হতো। তাই বলা হয় চীনের আধুনিক ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এই থিয়েন আনমেন স্কয়ার। 


একসময় ফরবিডেন সিটি বা নিষিদ্ধ শহরের প্রধান ফটকের সামনে একটি উঠোন ছিল থিয়েন আনমেন স্কয়ার। সেই সময়ে এই জায়গার পরিধি ছিল ১ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার। রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহুবার সংস্কার করা হয়েছে এই চত্ত্বরটি। বর্তমানে ৮৮০ মিটার দীর্ঘ এবং ৫০০ মিটার চওড়ার এই চত্ত্বর ৪ লাখ৪০ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। 

  

প্রতিদিন এই চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান। চীনকে ভালোবাসে এমন প্রত্যেকের বুকে প্রবল দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এই অনুষ্ঠান। প্রাচীন ইতিহাস, রাজনৈতিক তাতপর্য উপলব্ধি করতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই ভিড় করেন হাজারো পর্যটক। কেউবা পরিবার, কেউবা বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরে বেড়ান এর চত্ত্বরে। ছবি তুলছেন ফুলের সাথে, স্মৃতিস্তম্ভের সাথে। 

 

আমি নিজেও বেশ কিছু ছবি তুললাম। চত্ত্বরের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের কিছু ছবি তুলে সাক্ষী করে নিলাম নিজেকে। 

এরপর আমরা গেলাম এই থিয়েনআন মেন স্কয়ারের ঢুকার গেটের বাম পাশের বেশ কয়েকটি দোকানে। সেখানে চীনের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ব্যাগ, কাপড়, স্যুভেনির, এবং গহনা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। অল্প দামে এসব দোকান থেকে জিনিস কিনতে পারছেন পর্যটকরা। তাদের সাথে আমিও ঘুরে দেখলাম চীনের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পণ্য। কিনলাম নিজের পছন্দমতো বেশকিছু পণ্য। 

দুই ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে থিয়েনআন মেন স্কয়ারের পাশের একটি সাবওয়ে স্টেশন থেকে ফিরে এলাম হোটেলে। আর নিজের সাথে নিয়ে এলাম এক সমুদ্র স্মৃতি। 


আফরিন মিম 

চীন ভ্রমণ পর্ব-১ 


২।  প্রাচীন সিল্ক রোডের স্মৃতি রোমন্থন পর্যটকদের 

উত্তর-পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশের হাইতোং শহরের পিং'আন অঞ্চল। ইয়েলো রিভার, হুয়াংশুই নদী এবং তাথং নদীর সংযোগস্থলে নির্মিত এই শহর হ্যহুয়াং উপত্যকা নামে পরিচিত, যা চারটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল।

একসময় এটি ছিল ‘প্রাচীন সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। শিচাংয়ের প্রাচীন শাসনামলে এই করিডোরটি মূলত থাং রাজবংশ এবং থুবো রাজবংশকে যুক্ত করেছিল। 

 

এই অঞ্চলটির ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, কারুশিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি স্থানীয়দের ‘পিং'আনি হ্যহুয়াং লোক সংস্কৃতি এ অঞ্চলকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র। পাশাপাশি বহু শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হান, হুই, থু এবং অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী। এই শহরের প্রাচীন ভবনগুলোতে এখনো পাওয়া যায় প্রাচীন চীনা স্থাপত্য শৈলীর উপস্থিতি।  

ইতিহাস বলছে, ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান রাজবংশের সম্রাট চুয়ানের রাজত্বকালে স্থাপিত হয়েছিল আন-ই নামের একটি কাউন্টি। পরে ছিং রাজবংশের সময় এর নামকরণ করা হয়েছ পিং’আন টাউন। 

প্রতিবেদন- শুভ আনোয়ার

সম্পাদনা- আফরিন মিম


৩। ঘুরে আসুন লামা টেম্পল থেকে

বেইজিংয়ের একটি অনন্য পর্যটন স্থান লামা টেম্পল। এর অন্য নাম ইয়ংহ্য টেম্পল। এটি বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় তিব্বতি বৌদ্ধ মঠ। এখানে তিব্বতি বৌদ্ধ ও হান স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন চোখে পড়বে। কাঠের কাজের কিছু বিরল নিদর্শন এখানে রয়েছে। 

 

এটি বেইজিং মহানগরীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এখানে স্থাপত্য শৈলী ও ভাস্কর্য দেখার জন্য দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসেন। 

ছিং রাজবংশের শাসনকালে ১৬৯৪ সালে এই টেম্পলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সম্রাট ছিয়ানলংয়ের এখানে জন্ম হয়েছিল। এখানে অবশ্য আগেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল। রাজকুমারের বাসস্থানও ছিল। 

 

লামা টেম্পল কিন্তু একটি ভবন নয়। অনেকগুলো ভবন রয়েছে এখানে। একটির পর একটি ভবন অবস্থিত। প্রতিটি ভবন অপূর্ব কারুকার্যে সমৃদ্ধ। এখানে দাঁড়ানো বুদ্ধ বিগ্রহ রয়েছে। একটি দাঁড়ানো বুদ্ধ বিগ্রহ সম্পূর্ণ শ্বেতচন্দন কাঠের তৈরি এবং ১৮ মিটার দীর্ঘ। এই বিগ্রহটি শিল্পকলা হিসেবে এত সুন্দর যে গিনিজ বুক অব রেকর্ডে এর স্থান রয়েছে। 

লামা টেম্পলের বিভিন্ন হল ও প্যাভিলিয়নে তিব্বতি ভাষা ও চীনাভাষার প্রাচীন শিলালিপি রয়েছে। এখানে বিভিন্ন প্যাভিলিয়নে যেসব প্রাচীন বুদ্ধবিগ্রহ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সোনা, রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ ও বিভিন্ন পাথরের তৈরি । 

 

ঐতিহাসিকভাবে লামা টেম্পল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতি বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন এখানে রয়েছে। লামা টেম্পলের সাথে লামা টেম্পল পার্কটিও বেশ বিখ্যাত। 

লামা টেম্পলে সবসময় তিব্বতি মহামন্ত্র ওম মণি পদ্মে হুম বাজানো হয়। এখানে সুভ্যেনিরের দোকানও রয়েছে। গাছপালা সমৃদ্ধ পুরো টেম্পল কমপ্লেক্সটি বেড়ানোর স্থান হিসেবে চমৎকার। 

বেইজিংয়ের তোংছ্যং জেলার ইয়ংহ্যকং তাচিয়ে রোডে অবস্থিত। বিখ্যাত ফরবিডেন সিটি থেকে এর দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের মতো। লামা টেম্পল নামে একটি সাবওয়ে স্টেশনও রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে সরাসরি বাস যায়। 

এর আশেপাশে তিব্বতি খাবারের রেস্টুরেন্টও রয়েছে। আরও রয়েছে তিব্বতি কারুশিল্পের দোকান। 


প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা- আফরিন মিম 


ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী