চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৩৮
2023-10-14 20:55:14

   

চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ: 

ছেংতুতে লোকসংগীতের মওসুম 

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ছেংতু শহরটি অবসর জীবনযাপন, প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ আধুনিকতার একটি মনোমুগ্ধকর মিশ্রণ। সাধারণত অনেক চীনা এটিকে জীবনযাপনের আদর্শ স্থান বলে মনে করেন, যা কিনা চীনের সর্বাধিক কনসার্ট হাউসের মাধ্যমে অনেক পরিচিত। 

জাতীয় দিবসে আট দিনের ছুটিতে শহরের ইউলিন রোড, সবচেয়ে বিখ্যাত বিস্ট্রো বাণিজ্যিক রোডে অনেক গায়কের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা তরুণ-তরুণীদের পছন্দের গান পরিবেশন করেন।

 

বছরের পর বছর উন্নয়ন হয়েছে এই শহরের। এরই মধ্যে এই উন্নত শহরের সব বয়সী বাসিন্দারা লোকগান শোনার অভ্যাসও গড়ে তুলেছেন। লোকসংগীত চীনা সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। স্থানীয়রা জানান, এই লোক গান শুধু উপভোগ নয়, এর মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার পাশাপাশি উপলব্ধি করা যায় জীবন কতো মূল্যবান। 

 

এখানে লাইভ মিউজিকের সঙ্গে ছোট ছোট স্টল বসিয়ে ব্যবসা করছেন তরুণ-তরুণীরা। কম খরচে লাভের উপায় খুঁজে বের করছেন তারা।  ফলে স্থানীয় কিছু ব্যবসা নতুন করে সুযোগ পাচ্ছে। আয়োজকরা জানান, আগামি নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এই ফোক মিউজিক সিজন।  

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।


২. শিল্পীর তুলিতে পশ্চিম হ্রদের ১০ দৃশ্য  

সদ্যসমাপ্ত হাংচৌ এশিয়াড উপলক্ষ্যে শহরটির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে একটি সিরিজ তথ্যচিত্র প্রচার করেছে চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক-সিজিটিএন। এর একটিতে চীনের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী চেন চিয়ালিংয়ে তুলিতে হাংচৌর ল্যান্ডমার্ক পশ্চিমহ্রদের ১০টি দৃশ্যের চিত্রায়ন রয়েছে। 

  

১৯তম এশিয়ান গেমসের প্রধান আয়োজক শহর হাংচৌ। ৫ হাজার বছরের প্রাচীন এ শহরটি চীনের আকর্ষণীয় শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য শুধু চীনে নয়, বহির্বিশ্বেও খ্যাতি রয়েছে শহরটির।

৮-৯ শ’ বছর আগে দক্ষিণ সং ডাইনেস্টির রাজাধানী হাংচৌ একটি সমৃদ্ধ শহর হিসেবে বিকশিত হয়। 

সেই প্রাচীন কাল থেকেই শহরটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ল্যান্ডমার্ক পশ্চিম হ্রদের ১০টি দৃশ্য খ্যাতি লাভ করে। 

 

১৯৮৫ এবং ২০০৭ সালে পশ্চিম হ্রদের নতুন ১০টি করে দৃশ্য নির্বাচন করা হলেও প্রাচীন কাল থেকে প্রসিদ্ধ ক্ল্যাসিক ১০টি দৃশ্যই আজও বিশিষ্ট হয়ে আছে।

১৯তম এশিয়ান গেমস উপলক্ষ্যে হাংচৌর ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক-সিজিটিএন ‘হাংচৌ: অতীত থেকে ভবিষ্যতে’ শিরোনামে অসাধারণ একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে।

 

‘পশ্চিম হ্রদের ১০টি দৃশ্য’ শিরোনামে এপিসোডটিতে চীনের খ্যাতিমান ইন্ক পেইন্টার চেন চিয়ালিংয়ের তুলিতে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিমহ্রদের মনোমুগ্ধকর ১০টি দৃশ্য।  

সাংহাই স্কুল অব পেইন্টিংয়ের এই মাস্টার পেইন্টার চীনের ঐতিহ্যবাহী ইঙ্কপেই্ন্টিংয়ে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন পশ্চিম হ্রদের অপার্থিব নৈসর্গিক দৃশ্য। 

 

চেরি ফুল ফোটা, বাতাসে দোল খাওয়া পদ্ম, জোছনার প্রতিফলন, তুষার ঢাকা সেতু, ঝলমলে পোতাশ্রয়, রাজসিক পাহাড় চূড়া, সন্ধ্যার আলোতে জ্বলে ওঠা প্যাগোডা, চন্দ্রালোকে বিম্বিত জলাশয়, প্রশান্তিকর সান্ধ্য ঘন্টাধ্বনির কাব্যিক চিত্ররূপ গড়েছেন চেন তার অতুল ব্রাশওয়ার্কে! 

‘আমার হোমটাউন হাংচৌ একটি পরম মাঙ্গলিক স্থান। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি আর মানবিক উষ্ণতার এ অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। সাধারণভাবে খুব চ্যালেঞ্জিং মনে করা হলেও আমি পশ্চিম হ্রদের ১০টি দৃশ্য ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছি। পশ্চিম হ্রদের নিসর্গ-রেখা খুবই সরল এবং বিশুদ্ধ। আসলে এ কারণেই আমি দায়িত্বটি নিয়েছি’।

 

পশ্চিম হ্রদের ১০টি দৃশ্যের বিশিষ্টতার কথাও তুলে ধরেন চেন।

‘১০টি দৃশ্যের প্রত্যেকটি ভিন্নরকম। উদাহরণ হিসেবে সন্ধ্যার বর্ণিলতায় উজ্জ্ব্ল লেইফেং প্যাগোডার কথা বলা যেতে পারে। এর প্রধান টোন হচ্ছে আগুনে লাল। এটি অস্তগামী সূর্যের অশেষ সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে, জীবনের প্রতি আকুলতা এবং সময়কে স্তব্দ করে দেওয়ার অনুভূতি দেয়। এরকম সব কটি দৃশ্যেরই নিজস্ব অর্থ এবং মর্মবাণী রয়েছে’। 

সিজিটিএনের তথ্যচিত্রটিতে প্রকৃত প্রস্তাবে হাংচৌ শহরের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সুসমন্বয়ের চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। 

তথ্যচিত্রটির আরেকটি পর্বে স্থানীয় ভিডিও গেম ডিজাইনার চাং চাওয়ের তৈরি করা ভিডিও চিত্রে গোটা হাংচৌ শহরকেই তুলে ধরা হয়েছে । 

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।


৩. চিরায়ত চীনা সাহিত্য

ছেন শ্যন: যুদ্ধের কবিতায় সিদ্ধি

থাং রাজবংশের স্বর্ণযুগের একজন কবি ছেন শ্যন। তিনি মূলত যুদ্ধের কবিতা লেখার জন্য খ্যাতি পেয়েছেন। থাং যুগের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা তিনি লিখেছেন। তিন শ’ থাং কবিতার সংকলনেও তার কবিতা রয়েছে। 

ছেন শ্যনের জন্ম ৭১৫ সালে হুবেই প্রদেশের চিয়াংলিং শহরে। তার জন্মসাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। 

ছেন শ্যনের পরিবার ছিল অভিজাত আমলা পরিবার। তাদের আদি বাসস্থান ছিল হ্যনান প্রদেশের নানইয়াং সিটিতে। পরে তারা চিয়াংলিংয়ে চলে আসেন। তার প্রপিতামহ ও কয়েকজন আত্মীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।  তার বাবা ছেন চি চিংচৌ শহরের গভর্নর ছিলেন। ছেনের বয়স যখন মাত্র দশ বছর তখন বাবার মৃত্যু হয়। ফলে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে পড়ে। 

শৈশব থেকেই ছেন বই পড়তে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে ইতিহাসের বই। ২০ বছর বয়সে তিনি রাজধানী ছাংআন শহরে যান এবং ৭৪৪ সালে সরকারি চাকরির জন্য চিনশি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। 

৭৪৯ সালে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং দশ বছরের বেশি সময় কাজ করেন। সে সময় তিনি মধ্য এশিয়ায় থাং রাজবংশের শাসনাধীন দূরবর্তি অঞ্চলগুলোতে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। ৭৬৮ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় ছেন শ্যনের। 

জীবনের প্রথম দিকে তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনামূলক কবিতা লিখতেন। তবে পরের দিকে তার কবিতায় যুদ্ধ বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। তার দশ বছরের সামরিক জীবনে যুদ্ধের নির্মমতা, বেদনা, কঠোর প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম উঠে এসেছে। ছেন শ্যনের একটি কবিতা শোনাচ্ছি।

শিরোনাম,

রাজধানীমুখী দূতের সঙ্গে দেখা 

পূর্বদিকে তাকাই, পথ চলে গেছে, দূরে বহু দূরে যেখানে আমার ঘর

পুরনো বাহু কাঁপছে, জামার হাতা ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে 

হে ঘোড়সওয়ার তোমার সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু কি বার্তা দিব আমি ?

তুলিতে কি লেখা সম্ভব বলো?

শুধু তোমাকে অনুরোধ করি, তাদের বলে দিও, আমি বেঁচে আছি। 

এই কবিতায় পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার অপার বেদনা প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত সংকলন‘ তিন শ’ নির্বাচিত থাং কবিতা’য় ছেন শ্যনের সাতটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

যুদ্ধে সৈনিক জীবনের কষ্টকে তুলে ধরার জন্য, মানবিক বেদনাবোধকে শিল্পতভাবে প্রকাশের জন্য ছেন শ্যন চিরায়ত চীনা সাহিত্যে অমরত্ব পেয়েছেন।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া।

---------------------------------------------------------------------------

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দি।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ