চীনের গভীর পাহাড়ে কয়েকটি গ্রামের বদলে যাওয়া
2023-10-13 20:33:27

চীনে তা পিয়ে শান পর্বত নামে একটি পাহাড় আছে, যা দেশের দক্ষিণ ও উত্তরের ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত। চীনের অষ্টাদশ কংগ্রেসের পর থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট  সি চিন পিং দুই বার তা পিয়ে শান পর্বত এলাকা পরিদর্শন করেন। স্থানটি চীনের বিপ্লবের সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রও ছিল। পরিদর্শনকালে সি চিন পিং আবেগপূর্ণভাবে বলেছিলেন যে, বিপ্লবের পুরানো এলাকাকে ভালোভাবে গড়ে তুলতে হবে, স্থানীয় লোকজনের জীবনকে আরও সুন্দর করতে হবে।

সম্প্রতি সাংবাদিকরা তা পিয়ে শান পর্বতের বিপ্লব পুরানো এলাকায় গিয়ে দেখেছেন যে, সবখানে নতুন পরিবর্তন ঘটছে, সবখানে দেখা যাচ্ছে নতুন চেহারা।

তা পিয়ে শান পর্বত এলাকা হ্যনান প্রদেশের থিয়ানভুতাওয়ান পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত। এখানে আছে চার শতাধিক বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। পাহাড়ি অঞ্চল হওযায় এখানে উন্নয়নের গতি ছিল অনেক ধীর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিপ্লবের ইতিহাস ও সবুজ প্রকৃতির কল্যাণে, থিয়ানভুতাওয়ান বড় আকারের নির্মাণকাজের মধ্যে না গিয়ে, বরং পুরানো স্থাপত্যকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করেছে, হোমস্টে ও পর্যটন শিল্প উন্নয়ন করেছে।

সাংবাদিক গ্রামে ঢুকে দেখেছেন যে, গ্রামবাসীরা নতুন পাথরপথ নির্মাণ করছে। কয়েকটি হোমস্টের মালিকও নির্মাণ ও সাজানোর কাজে ব্যস্ত আছেন, যাতে পর্যটকদের আরো ভালোভাবে অভ্যর্থনা করা যায়।

গ্রামে একটি হোমস্টের দরজার উপরে লাল লণ্ঠন ঝুলানো আছে। ২০১৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বিশেষ করে এই হোমস্টেতে ঢুকে মালিক হান কুয়াং ইং পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। মালিক হান সি চিন পিংকে জানান, তিনি লাল ফৌজের বংশধর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে যৌথভাবে হোমস্টে স্থাপন করেন। প্রেসিডেন্ট সি তাঁর কথা শুনে খুব খুশি হন এবং বলেন, বিপ্লবের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও সবুজ প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে গ্রামের পর্যটন উন্নয়ন করা খুব ভালো এক পদ্ধতি। তা গ্রামকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।

হান কুয়াং ইং পরিবার প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর কথা মনে রেখে আরও পরিশ্রম করেছেন। হোমস্টেতে তাঁরা স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য ও হাতে তৈরি শিল্পকর্ম বিক্রি করেন। হোমস্টেতে একটি চা কর্ণার নির্মাণ করেছেন তারা, যাতে পর্যটকরা হোমস্টেতে আরামে সময় কাটাতে পারেন।

রাতে পর্যটন শিল্পকে আরও চাঙ্গা করতে গ্রামের কর্মকর্তারা এবং কৃষক প্রতিনিধিরা একসাথে আলোচনা করেন। কেউ বলেন, পর্যটকদের আরও ভালো সেবা দিতে হবে; কেউ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে অধিক নজর দিতে হবে।  একটি চিকিত্সা পয়েন্ট স্থাপন করা জরুরি বলেও কেউ কেউ মত দেন। গ্রামের কর্মকর্তারা সবার মতামত অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এখন গ্রামের বাড়িঘর আর জরাজীর্ণ নেই। চারিদিকে শুধু দেখা যায় সুন্দর ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর ৫ লাখেরও বেশি পর্যটন থিয়ানভুতাওয়ানে আসেন।

থিয়ানভুতাওয়ান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে আছে আরেকটি গ্রাম, যার নাম তা ওয়ান। গ্রামটি চীনের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। বিপ্লবের ইতিহাসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পর্যটন শিল্পও উন্নত হচ্ছে গ্রামে।

গ্রামে ঢুকলে দেখা যায়, সবুজ পাহাড় ও পরিচ্ছন্ন নদীর মাঝে সাদা দেয়ালের বাড়িঘর মেঘের মতো গ্রামকে সাজিয়ে রেখেচে। স্থানীয় ৬৩ বছর বয়সী কৃষক ছেন চ্য পিং-এর জীবন আগে খুব কষ্টের ছিল। তাঁর স্ত্রীর ডান হাত অকেজো। কাজ করতে পারেন না। ছেলে অনেক বছর আগে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়।  ছেন চ্য পিং-এর কাছে ২০১৬ সাল একটি অসাধারণ ও স্মরণীয় বছর। দেশের স্থানান্তর নীতির কল্যাণে তিনি গভীর পাহাড় থেকে বের হয়ে সরকারের নির্মিত নতুন বাড়িঘরে উঠতে পেরেছেন। ঠিক এই বছরের ২৪ এপ্রিল, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তা ওয়ান গ্রাম পরিদর্শন করেন।

ছেন চ্য পিং প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর পরিদর্শনের কথা স্মরণ করেন। প্রেসিডেন্ট সি’র উত্সাহে তিনি জীবনকে আরও সুন্দর করার অনেক চেষ্টা করেছেন। গ্রামের কর্মকর্তার সাহায্যে তিনি একজন বন রক্ষাকারীকর্মী হয়েছেন। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন যে, সবুজ পাহাড় ও পরিচ্ছন্ন পানি মানে সোনার পাহাড় ও রূপার পাহাড়। আমরা এই গ্রামের বাসিন্দা, আমাদের নিজের বাড়িকে আরও সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের।”

প্রকৃতিকে সুরক্ষার জন্য তা ওয়ান গ্রামে তিন স্তরের বন তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এতে বনসম্পদকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে। এখন পুরো গ্রামে ছেন চ্য পিং-এর মত বনরক্ষকের সংখ্যা ২১ জন।

প্রকৃতি ভালো হয়েছে, কৃষকরা এতে লাভবান হতে পেরেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ওয়ান গ্রাম যেন সবুজ উন্নয়নের ‘হাইওয়ে’তে প্রবেশ করেছে। ভালো প্রাকৃতিক সম্পদের ভিত্তিতে গ্রামে ব্যাপকভাবে চা শিল্প উন্নয়ন হচ্ছে। এর সঙ্গে গ্রামীণ পর্যটন শিল্পও অনেক সমৃদ্ধ হতে পেরেছে।

তা ওয়ান গ্রাম তা পিয়ে শান পর্বতের গভীরে অবস্থিত। চার পাশেই পাহাড়। এমন ভালো প্রকৃতিতে কিভাবে ‘সবুজ’ থেকে ‘সোনা’ পাওয়া যায়, গ্রামের লোকজন সবসময় সে চেষ্টা করতে থাকেন।

তা ওয়ান গ্রামের বেশি বৃষ্টি ও আর্দ্রতা চা চাষের জন্য উপযোগী। গ্রামটি চীনের বিখ্যাত চার ‘লিউ আন’ চা-এর প্রধান উত্পাদনস্থল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ওয়ান গ্রামে চা পাতা তোলা, উত্পাদন ও পর্যটনকে একীভূত করে চা কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এতে স্থানীয় বিখ্যাত চা ব্র্যান্ড সুপরিচিত হয়েছে। কৃষকদের চা বিক্রির সমস্যাও সমাধান হয়েছে।

প্রতিবছরের বসন্তকাল নতুন চা বাজারে আসার সময়। এসব চা কারখানা চা তুলতে কৃষকদের নিয়োগ করে। চা কারখানার সাহায্যে, পুরো গ্রামে প্রত্যেক চা কৃষকের আয় বছরে গড়ে বেড়েছে দুই হাজার ইউয়ানেরও বেশি। কৃষকরা নিজেদের বাসার সামনেই টাকা উপার্জন করতে পারছেন।

এখন তা ওয়ান গ্রামে চা বাগানের মোট আয়তন ৩৩৩ হেক্টর। পুরো গ্রামে ৪২টি পরিবার হোমস্টে ব্যবসা করছে। কৃষকের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৭০৩৮ ইউয়ান। গ্রামের আয় এখন ২০.৭ লাখ ইউয়ান ছাড়িয়েছে।

এ ছাড়া তা পিয়ে শান পর্বত এলাকায় আরেকটি জেলা আছে, যার নাম তা উ জেলা। জেলায় ফল গাছ আছে, পিয়নি ফুল আছে। যেন একটি ‘রঙিন ক্ষেতের’ সুন্দর দৃশ্য রচনা করছে গ্রামটি। এক একটি বৈশিষ্ট্যময় গ্রামীণ শিল্প সমৃদ্ধভাবে উন্নত হচ্ছে।

তা উ জেলার হুং চাই গ্রামে পুরো পাহাড়ে দেখা যায় ক্যামেলিয়া ফলের গাছের সারি। এ ফল থেকে প্রচুর তেলও উত্পাদন করা যায়।

২০১৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হ্যনান প্রদেশের কুয়াংশান জেলা পরিদর্শনের সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন, পাহাড়ে বেশি বেশি ক্যামেলিয়া ফলের গাছ চাষ করা উচিত। এতে কৃষকরা বাসার সামনে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারে, অন্যদিকে লোকজন এ শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্রমুক্ত হতে পারে, ধনীও হতে পারে; প্রাকৃতিক পরিবেশও উন্নত হতে পারে।

তা উ জেলা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর কথা মনে রেখে কৃষকদের জন্য ‘কোম্পানি+কৃষক’ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ক্যামেলিয়া ফলের চাষ বেড়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষ লাভবান হতে পেরেছে।

তা উ জেলার বৈশিষ্ট্যময় কৃষিশিল্প সমন্বিতভাবে উন্নত হচ্ছে। এতে একদিকে গ্রাম আরও সুন্দর হয়েছে, অন্যদিকে কৃষকের আয় অনেক বেড়েছে। এটি চীনের গ্রামের সমৃদ্ধির এক খুব ভালো উদাহরণ। (শুয়েই/আলিম)