মোবাইলে আসক্ত ছেলের নতুন জীবন
2023-10-09 16:36:39

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার সাধারণ মানুষের জীবনে অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের হাতে নিজেদের মোবাইল ফোন তুলে দেন, কারণ এটা পেলে বাচ্চারা শান্ত থাকে। তবে অনেক বাচ্চা এ কারণে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার গেমসে আসক্ত হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত বাবা-মায়ের দুঃখের কারণ হয়।

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি গল্প অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইন্টারনেটে আসক্ত একটি ছেলে শুরুর দিকে স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও, পরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় এবং নতুন ছাত্রজীবন শুরু করে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ছেলে লিয়াও সিয়াও তুং এবং তাঁর বড় ভাইয়ের গল্প তুলে ধরবো।

ছেলে লিয়াও সিয়াও তুং এবং লিয়াও সিয়াও লং চীনের চিয়াংসি প্রদেশের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সিয়াও লং এ পরিবারের বড় ভাই। সিয়াও তুংয়ের বয়স বড় ভাইয়ের চেয়ে ১০ বছর কম। তাদের বাবা-মা কুয়াংতুং প্রদেশের একটি আসবাবপত্র কারখানায় চাকরি করেন। যখন ছোট ভাই সিয়াও তুং জন্মগ্রহণ করে, তখন বড় ভাই সিয়াও লংয়ের বয়স ১০ বছর। বাবা-মা কাজের জন্য ব্যস্ত থাকতেন। তাই সিয়াও লংয়ের জীবন ছিল একাকী। ছোট ভাইয়ের জন্ম ছিল তাঁর জন্য আনন্দের ব্যাপার।

সিয়াও লং সবসময় তাঁর ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা ও যত্ন করতো; তাকে নিয়ে একসাথে খেলা করতো। সিয়াও তুংয়ের মনে আছে, ছোটবেলায় বড় ভাই তাকে নিয়ে সাইকেলে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। দু’ভাইয়ের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। ধীরে ধীরে সিয়াও লং বড় হয়। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় বাবা-মা এবং ছোট ভাই একসাথে চিয়াংসি প্রদেশের ফুচৌ শহরের কুয়াংছাং জেলায় ফিরে যায়। কারণ, কয়েক বছর পর সিয়াও লং ‘কাওখাও’ পরীক্ষায় অংশ নেবে।

২০১৩ সালে ১৯ বছর বয়সের বড় ভাই সিয়াওলং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন তাকে পরিবার ছেড়ে হোস্টেলে যেতে হয়। তখন থেকে ছোট ভাই সিয়াওতুংয়ের একাকী জীবন শুরু হয়। কারণ, বাবা-মা কাজে সবসময় ব্যস্ত। তাঁরা সিয়াওতুংকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন। সিয়াওতুংয়ের যে-কোনো চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। তবে, মাঝেমাঝে সিয়াওতুংকে মারধোরও করতেন বাবা-মা।

২০১৬ সালের শীতকালে বড় ভাই সিয়াও লং বাবার ফোন পান। তখন বাবা বলেন, ছোট ভাই সিয়াওতুং মোবাইল ফোন গেমসে আসক্ত হয়েছে ও স্কুলের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। তখন সিয়াওতুংয়ের বয়স মাত্র ১৩ বছর। মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম বর্ষে মাত্র ভর্তি হয়েছে। মোবাইল ফোন খেলার জন্য প্রথম সেমিস্টারে তার পরীক্ষার ফলাফল অনেক খারাপ হয়। তখন সিয়াওতুংয়ের শিক্ষক তার বাবার সাথে আলোচনা করেন। তবে সিয়াওতুংয়ের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অবশেষে সিয়াওতুংকে স্কুল ছাড়তে হয়। সেই থেকে সে প্রতিদিন শুধু গেমস খেলে জীবন কাটানো শুরু করে।

বাবা-মায়ের ফোন পেয়ে বড় ছেলে সিয়াওলং অনেক কষ্ট পায়। তবে, সে নানছাং থেকে ফিরে আসে এবং ইন্টারনেট থেকে ছোট ভাইকে সাহায্য করার কৌশল খুঁজে বের করে। বাড়ি ফিরে পরিবারের খারাপ অবস্থা সহজেই বুঝতে পারে সিয়াওলং। রুমে চেয়ার ও বিছানাসহ বিভিন্ন স্থান অগোছালো। ছোট ভাই সিয়াওতুংকে দেখা গেলো শীতের মধ্যেও হালকা কাপড় পরে শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখছে।

সিয়াওলং তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তবে লেখাপড়া সম্পর্কে ছোট ভাই কিছুই বলে না। বাবা-মা আবার সিয়াওতুংকে মারতে যায়। তবে এবার সিয়াওলং ছোট ভাইকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। সিয়াওতুংয়ের মোবাইল ফোন এ ঝগড়ার সময় ভেঙ্গে যায়। তখন সে এ ভেবে অবাক হয়, ছোটবেলায় বাবা-মা তাকে ফোন দিতে আপত্তি করেনি, এখন কেন করছেন?!

বড় ভাই সিয়াওলং তাঁর ছোট ভাইকে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে চেষ্টা করতে থাকে ।একদিন রাতে সিয়াওতুং বলল, মাধ্যমিক স্কুলে গণিত ক্লাস বেশ কঠিন, সে কিছু বুঝতে পারে না। ক্লাসে শিক্ষক সবসময় তার সমালোচনা করেন, তখন সে স্কুলের লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

পরে সিয়াওলং তার ছোট ভাইকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন দেখে ছোট ভাই নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পরিবারে ফিরে যাওয়ার পর আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। তাদের বাবা-মাও অনেক হতাশ। তখন থেকে ছোট ভাই সিয়াওতুংয়ের জীবনে শুধু মোবাইল ফোন গেমস রয়ে যায়।

কয়েক মাস পর বসন্ত উত্সবের ছুটি আসে। বড় ভাই সিয়াওলং আবার বাড়ি ফেরে। একটি শান্তির ছুটি কাটাতে সিয়াওতুংয়ের মোবাইল ফোন সংগ্রহ করেন বড় ভাই। তার সাহায্যে সিয়াওতুং অন্যদের মতো খাওয়া, থাকা ও ঘুমানো শুরু করে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার স্কুলে ফিরে যায় সিয়াওতুং। তার পড়াশোনা আবার শুরু করার জন্য স্কুলে একটি প্রতিশ্রুতিপত্র সই করে বড় ভাই সিয়াওলং। তবে স্কুলে ফিরে গেলেও সিয়াওতুং ক্লাসে তেমন একটা মনোযোগ দিত না। ১০ দিন পর ১৩ বছর বয়সের ছেলে সিয়াওতুং চাকরি নেওয়ার জন্য একাই ট্রেনে বসে চিয়াংসু প্রদেশে যায়। তবে তাঁর বয়সের কারণে সহজে চাকরি খুঁজতে পায় না। বাবা-মায়ের সাহায্যে সে কুয়াংতুং প্রদেশের একটি পোশাক কারখানায় অস্থায়ী চাকরি খুঁজে পায়। মাসিক বেতন মাত্র ৮০০ ইউয়ান। একদিনে ১০ ঘন্টার মতো কাজ করতে হয়। এমন জীবনে সে ভয় পায়।

একই বছরের জুন মাসে বড় ভাই সিয়াংলং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয় এবং শেনচেন শহরে চাকরি পায়। যখন আবার বাড়ি ফিরে আসে, ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে সিয়াওলংয়ের অনেক রাগ হয়। সেই প্রথমবারের মতো ছোট ভাইকে সে মারধোর করে। দু’জনের ঝগড়া শেষে সিয়াওতুং বুঝতে পারে, বড় ভাই তাকে ধরে রাখতে চায়, তাকে সাহায্য করতে চায়। তখন থেকে সে মোবাইল ফোন গেমস আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিয়াওতুং আবার মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়। তার মোবাইল ফোন আসক্তি মোকাবিলায় একটি বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষক পরিবারে বসবাস করতে শুরু করে সিয়াওতুং। নতুন পরিবেশে সিয়াওতুংয়ের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। গণিতে সে মজা পেতে শুরু করে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। লেখাপড়ায় সে নতুন অনুভূতি ও অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়।

অন্যদিকে, শেনচেন শহরে কর্মরত বড় ছেলে সিয়াওলং সবসময় ছোট ভাইয়ের খোঁজখবর নিত। বাবা-মা নিয়মিত ছোট ভাইয়ের অবস্থা তাকে জানাতেন। উইচ্যাটে বাবা-মাকে ছোট ভাইয়ের সাথে কথাবার্তার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয় বড় ভাই।

স্কুলে পড়াশোনা শুরুর এক মাস পর সিয়াওতুং মাসিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষায় সে ভালো করে। সেটি ছিল তার জন্য বেশ উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার। এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে সিয়াওতুং বলে, “আমার সহপাঠীরা এ পরীক্ষার ফলাফলকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, আমি এতো কম সময়ের মধ্যে ক্লাসের শীর্ষস্থান অধিকার করবো, এটা ছিল তাদের জন্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার।” শিক্ষকরা তাকে অনেক উত্সাহ দেন। তার আরো ভালো পরীক্ষার ফলাফল কামনা করেন। মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে সিয়াওতুং মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে এবং বাবা-মা ও বড় ভাইয়ের দুঃখ দূর করে।

উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির পর সিয়াওতুংয়ের পরীক্ষার ফলাফল আবার একটু খারাপ হয়। তবে এবার আর সে হতাশায় পড়াশোনা বন্ধ করেনি। কোভিড মহামারী চলাকালে শুধু অনলাইনে ক্লাস করতে হতো। সিয়াওতুং আবার নতুন স্মার্টফোন পায়। তবে, সে এবার শুধু মাঝেমাঝে গেমস খেলে। এবার আর তার কোনো আসক্তি নেই। তাঁর দৃষ্টিতে এখন মোবাইল ফোনে গেমস খেলা এতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

সঠিক পথে ফিরে আসার স্মৃতি স্মরণ করে সিয়াওতুং বলে, মাধ্যমিক স্কুলে একজন ইংরেজি শিক্ষক তাকে বেশি যত্ন নেন। তিনি সবসময় সিয়াওতুংয়ের প্রশংসা করেন। এভাবে তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়।

বাবা-মাও তাদের কঠোর পারিবারিক শিক্ষা-পদ্ধতির ত্রুটি বুঝতে পারেন। পরিবারে ভালো পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং ছোট ছেলেকে আরো বেশি সময় দিতে শুরু করেন; মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে চেষ্টা করেন। সিয়াওতুংয়ের কাওখাও পরীক্ষা অংশ নেওয়ার আগে বড় ভাই বার্ষিক ছুটি কাটিয়ে ছোট ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাকে সাহায্য করে।

অবশেষে সিয়াওতুং সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র পায়। এ বিশেষ স্মৃতির স্মরণে তারা একটি ভিডিও বানায়। তাতে ছোট ভাইয়ের মোবাইল ফোনে আসক্তি এবং আবার নতুন জীবনে ফিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা হয়। সেটি ইন্টারনেটে ব্যাপক সাড়া ফেলে। অনেক নেটিজেনও সিয়াওতুংয়ের মতো স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের অনেকে ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

বড় ভাই সিয়াওলং একটি উইচ্যাট গ্রুপ গড়ে তুলেছে। তাতে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে পরামর্শ ও সাহায্য দেওয়া হয়। তার ইচ্ছা যত বেশি সম্ভব ইন্টারনেটে আসক্ত বাচ্চাকে সাহায্য করা। এ গ্রুপের অনেক পিতামাতা ও শিক্ষক মনে করেন, তাদের বাচ্চাদের সমস্যা তাদের নিজেদের দোষ। তবে, আসলে বাবা-মা বাচ্চার মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ না করা হল মূল কারণ। তাই ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনে আসক্তির সমস্যা মোকাবিলা করতে চাইলে শুরুর দিকে এমন আচরণ এড়ানো উচিত।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোরকিশোরীরা মোবাইল ফোন খেলার মাধ্যমে বাস্তব জীবনের চাপ ও দুঃখ থেকে পালাতে চেষ্টা করে। তাই পরিবার ও স্কুল উভয়েরই বাচ্চাদের ওপর যথাযথ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাদের চিন্তাভাবনা ও মেজাজের সঠিক যত্ন নিতে হবে।

নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে সিয়াওতুং বলে, “যখন কুয়াংতুং পোশাক কারখানায় চাকরি করতাম, প্রতিদিন এতো পরিশ্রম ও কষ্ট করে মাসিক বেতন পেতাম খুবই সামান্য। তখন থেকে আমি বুঝতে পেরেছি, কেবল লেখাপড়া জীবনের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। তাই ভালো করে লেখাপড়া করা সঠিক পথ। যদি আমি শুধু মাধ্যমিক স্কুলের স্নাতকপত্র নিয়ে চাকরি খুঁজি, তাহলে শুধু পরিশ্রমের কাজ করতে হয়। আর কোনো বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।”

বর্তমানে ছোট ভাই সিয়াওতুংয়ের বয়স ১৯ বছর। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সে শেনচেন শহরে অস্থায়ী চাকরি নিয়েছে এবং বড় ভাইয়ের সাথে থাকে। তার দৃষ্টিতে, যদিও জীবনে অনেক কষ্ট রয়েছে, তবে তারা নিজের সুখী জীবন বাস্তবায়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালাবে। ২৯ বছর বয়সের সিয়াওলং জীবনের নতুন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন বাবা-মা আশা করেন, সে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করবে। এটি তার জন্য অনিশ্চিত ব্যাপার। তবে ছোট ভাইয়ের নতুন জীবন তার জন্য সবচেয়ে উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার। তারা অবশেষে সাধারণ পরিবারের মতো সাধারণ ও সুখী জীবন কাটাতে সক্ষম। দু’জন ভাই পরস্পরকে আস্থা ও সমর্থন দেয়।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)