চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৩৭
2023-10-07 18:23:17

চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ:

সিএমজি মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল গালা

চীনের মধ্য-শরৎ উৎসব উপলক্ষ্যে চায়না মিডিয়া গ্রুপ-সিএমজি’র মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল গালা ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে প্রচারিত হয়েছে। অনুষ্ঠানটিতে ২০টির বেশি চিত্তাকর্ষক শৈল্পিক পরিবেশনা চীন ও বিশ্বের দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ঐতিহাসিক ইবিন শহরে রেকর্ড করা হয় গালাটি। এটি এমন একটি শহর যা সাহিত্যের অসংখ্য ক্লাসিক কাজকে অনুপ্রাণিত করেছে।

গালাটি কবিতা, মদ সংস্কৃতি, চাঁদ, জল এবং বাঁশ নামে পাঁচটি সাংস্কৃতিক উপাদানকে তুলে ধরেছে। একক পারফরম্যান্স, ডুয়েট, সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা এবং নৃত্যসহ ২০টিরও বেশি আইটেমের অনুষ্ঠানটি তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিল।

‘ইয়াংজি নদীর গানে’র ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত চীনা পিয়ানোবাদক ল্যাং ল্যাংয়ের বাদন এবং সিচুয়ান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সমন্বয়ে একটি সিম্ফনি দিয়ে শুরু হয় গালাটি। সিম্ফনিটি গালার তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে সংযোগ হিসাবেও কাজ করে।

গালার প্রথম অংশে "ইয়াংজি নদীর উপর চাঁদের আলো" থিমে মধ্য-শরৎ উৎসব সম্পর্কে ঐতিহ্যবাহী চীনা কবিতা, গান এবং পারিবারিক পুনর্মিলন, দেশপ্রেম, স্নেহ এবং নস্টালজিয়ার বিষয় তুলে ধরা হয়।

দ্বিতীয় অংশে ‘দীর্ঘ ও প্রবহমান ইয়াংজি’ থিমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অত্যাশ্চর্য মঞ্চ ডিজাইনে ঐতিহ্যবাহী চীনা ক্লাসিক সংগীতকে তুলে ধরা হয়েছে।

‘এক ইয়াংজি, এক চাঁদ’ থিমে তৃতীয় দেশের প্রতি অনুরাগ এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশা দেখানো ক্ল্যাসিক গানগুলো উপস্থাপন করা হয়।

চীনা চান্দ্র ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাসের ১৫তম দিনে মধ্য-শরৎ উৎসব পালিত হয়। পারিবারিক পুনর্মিলনের প্রতীক, ঐতিহ্যবাহী অন্যতম সামাজিক এ উৎসবটি এবার উদযাপিত হয়েছে ২৯ সেপ্টেম্বর।

প্রতিবেদন; মাহমুদ হাশিম।

 

এশিয়ান গেমসের থিমসংয়ের মিউজিক ভিডিও

সম্প্রতি এশিয়ান গেমসের থিম সংয়ের একটি মিউজিক্যাল ভিডিও প্রকাশ করেছে চায়না মিডিয়া গ্রুপ-সিএমজি, যেখানে জিদার ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং ভিয়েতনামের মিউজিশিয়ানদের পরিবেশনা প্রদর্শন করা হয়েছে।

কুচং একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা বাদ্যযন্ত্র। এই বাদ্যযন্ত্রটি হান এবং থাং রাজবংশের সময় সিল্ক রোডের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে, এটি এক ধরণের জিদার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

 থিম সং "হার্ট টু হার্ট" সুর পরিবেশন করার জন্য চেচিয়াং বৈশিষ্ট্যসহ লোক সুরের উপর ভিত্তি করে পাঁচটি দেশের শিল্পীদের একত্রিত করা হয়। এতে প্রতিটি দেশের কুচংয়ের কাঠের বৈশিষ্ট্য এবং বাজানোর দক্ষতা প্রদর্শন করা হয়।

সুরকার লি লেই বলেন,  ইয়াংজি নদীর দক্ষিণের মনোমুগ্ধকর প্রদর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ফ্যাশন এবং জীবনীশক্তি, সেইসাথে সমসাময়িক চীনের উন্মুক্ততা, সহনশীলতা এবং আধুনিক সমৃদ্ধ হাংচৌ শহরকেতুলে ধরা এই সংগীতের লক্ষ্য।

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

 

২.  ১০ সিল্ক রোড আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের রাজধানী ফুচৌতে সম্প্রতি হয়ে গেলো ১০ সিল্ক রোড আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগ-বিআরআই’র ১০ম বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এ ইভেন্টটি।

 

২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উৎসবটির লক্ষ্য ছলি প্রাচীন সিল্ক রোড বরাবর অবস্থিত দেশগুলোর সংস্কৃতিতে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা।  উৎসবে ছিল বিভিন্ন দেশের ওপর প্রদর্শনী, ভিআর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও ফোরাম।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান পরিচালক লিন চেনইয়ু মনে করেন এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে চীনের সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রকে তুলে ধরার পাশাপাশি, চলচ্চিত্র যে প্রাচীন সিল্ক রোড বরবার দেশগুলোর সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে তা স্পষ্ট হয়েছে।

‘আমরা শুধু যে চীনে এখনকার তৈরি চলচ্চিত্র নিয়ে আত্মবিশ্বাসী তাই নয়, বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিনিময়ে চলচ্চিত্রকে আমরা একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছি। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে’।  

মালয়েশিয়ার জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ বিন মোহাম্মদ ওথমানও বললেন এর উপযোগিতার কথা।

‘এই উৎসবের বার্তাটি হচ্ছে বিশ্বকে সংযুক্ত করা। এবং আমি মনে করি এটাই উত্তম পথ, কারণ এটা শেখারও উত্তম পন্থা’।

‘বেল্ট এন্ড রোড চলচ্চিত্র বিনিময় এবং সহযোগিতা শিরোনামে উৎসবের প্রধান ফোরামে আলোচকরা দেশে দেশে সাংস্কৃতিক বিনয়ময়ে চলচ্চিত্রের বড় ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। যেমনটি বলেন, চীনের ফিল্ম আর্কাইভের ডেপুটি কিউরেটর লিন সিওয়েই।

চলচ্চিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী একটি যোগাযোগ মাধ্যম। এর মধ্য দিয়ে আমরা যেমন বিভিন্ন দেশে চীনের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে পারি তেমনি বেল্ট এন্ড রোড বরাবর অন্য দেশের সংস্কৃতিকেও তুলে ধরতে পারি’।

২০১৪ সাল শুরু হওয়া সিল্প রোড চলচ্চিত্র উৎসব প্রায় এক দশক ধরে বেল্ট এন্ড রোড বরাবর দেশগুলোর চলচ্চিত্র সহযোগিতায় উল্লেখযোগ অবদান রেখে চলেছে।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।

 

৩. কনফুসিয়াস: চীনের মহান দার্শনিক

চীনের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতিমান, শ্রদ্ধেয়  ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন কনফুসিয়াস। তার প্রকৃত নাম খোং ফুচি। তাকে খোংচি নামে সম্ভাষণ করা হয়। রোমান ইতিহাসবিদরা তাকে কনফুসিয়াস নামে অভিহিত করায় চীনের বাইরে তিনি এই নামে পরিচিতি পান।

কনফুসিয়াসের দর্শন হচ্ছে নীতিশিক্ষাভিত্তিক। তিনি মনে করতেন শিক্ষার ভিত্তি হলো নীতিজ্ঞান। জীবনের সবক্ষেত্রে সুনীতি ও সুআচরণ মেনে চলা, সকলের কল্যাণ সাধন করাই হলো মানবজীবনের মহান ব্রত।

কনফুসিয়াসের জন্ম ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ২৮ সেপ্টেম্বর ছুফু শহরে যা বর্তমানে শানতোং প্রদেশের অন্তর্গত। সে সময় শহরটি চৌ রাজবংশের শাসনাধীন লু সামন্ত রাজ্যের ছিল। তার বাবা খোং হ্য অভিজাত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। মায়ের নাম ছিল ইয়ান চ্যংচাই।

মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন তিনি। বাবার মৃত্যুর ফলে বেশ দারিদ্র্যের মধ্যেই শৈশব কাটে তার। ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় তরুণী ছিকুয়ানের সঙ্গে।

২৩ বছর বয়সের সময় মায়ের মৃত্যু হলে তার জীবনসংগ্রাম বেশ তীব্র হয়ে ওঠে।

কিশোর বয়স থেকে নানা রকম কাজ করেছেন খোংচি। যে পেশাতেই থাকুন না কেন, তিনি সবসময়েই লেখাপড়া করতেন  এবং তার কাছে মানুষ আসতো বিদ্যা অর্জনের জন্য। লু প্রদেশের শাসক চিচি তার পাণ্ডিত্যের কথা জানতে পেরে তাকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান। তার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রথমে তাকে হিসাবরক্ষক এবং পরে আরও বড় পদ দেন।

৫২ বছর বয়সে লু প্রদেশের প্রধান আইন রক্ষক হন খোংচি। তিনি বিশ্বাস করতেন, "মানুষের মাঝে যদি নৈতিক চরিত্রের উন্নতি না ঘটে, শুধুমাত্র আইন দিয়ে মানুষকে সংযত রাখা সম্ভব নয়।" তাই কনফুসিয়াস নিজেই আইন প্রণয়নকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে নীতিবোধ জাগাতে নানা উপদেশ দিতে থাকেন।

অল্প কিছুদিনেই এর সুফল দেখা দিল রাজ্যে। সমগ্র চীন দেশের মধ্যে লু রাজ্য ছিল একমাত্র রাজ্য যেখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন হতো না।

তবে নীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি অনেক শক্তিশালী শত্রু সৃষ্টি করেন। অনেক সময় শাসকের বিরাগভাজনও হন। একসময় তিনি লু রাজ্য ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।

৬৮ বছর বয়সে খোংচি লু রাজ্যে তার জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তিনি ৭০ বা ৭২ জন্ শিষ্যকে উপদেশ দেন। তার প্রিয় পুত্র এবং প্রিয় কয়েকজন শিষ্যের মৃত্যুতে শোকার্ত হওয়ায় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। ৭১ বা ৭২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। ছুফু শহরের খোং লিন সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

খোংচি বা কনফুসিয়াসকে মানবসভ্যতার অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাগুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি যে শিক্ষা ও বাণী মানবজাতিকে দিয়েছিলেন তা অমরত্ব পেয়েছে।

তার একটি কবিতা শোনাচ্ছি

একটি অভিযোগ

তিনি আমাদের একটি প্রশস্ত বাড়িতে রাখলেন

এবং আমাদের ভাড়া ছিল প্রচুর।

কিন্তু এখন প্রতিটি আহার হয় অতি সংক্ষেপে

বাড়তি কোন খাদ্যই নেই।

হায়রে! আফশোস, এই ভালো মানুষ

যেভাবে জীবন শুরু করেছিলেন

সেভাবে চলতে পারেননি।

কনফুসিয়াস চীনা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব রেখেছেন। আজও পর্যন্ত কনফুসিয়াসের নীতিশিক্ষা ও দর্শন চীনের শিক্ষা সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং কনফুসিয়াস ক্লাসরুম। প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বরের আগে ২৭ সেপ্টেম্বর কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

---------------------------------------------------------------------------

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দি।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ