চলতি বাণিজ্যের ৩৮তম পর্বে থাকছে:
১. চীনে চালু হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎ ফার্ম
২. তানজানিয়ার মৎস্যখাতে চীনা বিনিয়োগ
৩. পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে চীনে ক্রেতা আকর্ষণ করছে সুয়েজ
চীনে চালু হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎ ফার্ম
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউন্ড টার্বাইনসহ একটি বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফার্ম চালু হয়েছে চীনে। এই ফার্ম থেকে জাতীয় গ্রিডে বছরে যোগ হবে ৩৬০ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ যা প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে খরচ হতো ১ লাখ ৩৮ হাজার টন কয়লা। কর্তৃপক্ষ বলছে, বায়ু শক্তি ব্যবহার করে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমবে বছরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৮শ’ টন। এদিকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী ব্যবহারের কারণে ২০১২ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চীনে প্রতি ইউনিট জিডিপির বিপরীতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চীনের স্টেট কাউন্সিলের ডেভেলপমেন্ট রিসার্স সেন্টার ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অ্যাসেট সুপারভিশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিশন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অফশোর উইন্ডটার্বাইনসহ একটি উইন্ড ফার্ম চালু হলো চীনে। এরইমধ্যে পুরোদমে এটি উৎপাদন শুরু করেছে। পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশে এই উইন্ডফার্মটি চালু হয়।
ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানায়, ফুচিয়ান প্রদেশে পিনটান কাউন্টির সমূদ্রতীর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে এই ফার্মটি স্থাপন করা হয়েছে। পুরো ফার্মটিতে স্থাপন করা হয়েছে মোট ১১ সেট টার্বাইন। ফার্মটি থেকে সব মিলিয়ে উৎপাদন হবে মোট ১১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই একটি টার্বাইন থেকেই পাওয়া যাবে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
কর্তৃপক্ষ জানায়, ফার্মটি পুরোদমে চালু হলে জাতীয় গ্রিডে বছরে যোগ হবে ৩৬০ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ যা ১ লাখ ৩৮ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদন করতে হতো।
চায়না থ্রি গর্জেস কর্পোরেশনের ফুচিয়ান শাখার বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিভাগের ব্যবস্থাপক ওয়াং চিয়ানপাও জানান, বায়ু শক্তি ব্যবহার করে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমবে বছরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৮শ’ টন।
ওয়াং চিয়ানপাও, ব্যবস্থাপক, চায়না থ্রি গর্জেস কর্পোরেশনের ফুচিয়ান শাখা
“৪ মাসেরও কম সময়ে নির্মাণকাজ শেষে আমরা দুটি বড় আকারের ও অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম টার্বাইন চালু করতে সক্ষম হয়েছি। এরমধ্যে একটি ১৩ মেগাওয়াট ও অন্যটি ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। এক ইউনিট অফশোর উইন্ড টার্বাইন হিসেবে এটি সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় টার্বাইনের জায়গা দখল করেছে।“
এদিকে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানী ব্যবহারের কারণে ২০১২ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চীনে প্রতি ইউনিট জিডিপির বিপরীতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সম্প্রতি চীনের স্টেট কাউন্সিলের ডেভেলপমেন্ট রিসার্স সেন্টার ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অ্যাসেট সুপারভিশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিশনের যৌথভাবে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
রাজধানী বেইজিংয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয় গ্লোবাল এনার্জি ট্রান্সফরমেশন ফোরাম। সেই ফোরামের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর ব্যবহার সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছে এবং জ্বালানী খাতের নানা রূপান্তর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনের স্টেট কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট রিসার্স সেন্টারের অঙ্গসংস্থা ইনস্টিটিউট ফর রিসোর্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল পলিসি। এই প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক কুয়ো চিয়াওফেং জানান, এই প্রতিবেদনে চীনের জ্বালানীখাতের নানা চড়াই-উতরাই তুলে ধরা হয়েছে।
কুয়ো চিয়াওফেং, উপ-পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর রিসোর্স অ্যান্ড এনভাইরোনমেন্ট পলিসি
“বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের উন্নয়ন এবং কীভাবে বিদ্যুৎখরচ বাঁচানো যায় সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। একইসঙ্গে আগামী এক দশকে চীনের জ্বালানীখাতের রূপান্তর কীভাবে ঘটবে, বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব ও কম কার্বন নিঃসরণ হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর ব্যবহার, ডিজিটাল ও বিকেন্দ্রীকরণ করাসহ চীনের জ্বালানী খাতের ভোক্তা ভোক্তা পর্যায়ের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। চীনের জ্বালানী খাতের এই পরিবেশবান্ধব ও কম কার্বন নিঃসরণ প্রক্রিয়ার রূপান্তরে এই প্রতিবেদনটি একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।“
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চীনে জ্বালানীখাতের ব্যবহার বাড়ার কারণে মোট কয়লার ব্যবহার বাড়ে ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন টন। এর ফলে দেশটির মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এখাতে দেশটিতে জ্বালানী খরচের পরিমাণ বাড়ে বছরে ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০১২ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চীনের নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বাড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই সময়ে জিডিপির তুলনায় জ্বালানী খরচের পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
ভিনদেশে চীন:
তানজানিয়ার মৎস্যখাতে চীনা বিনিয়োগ
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে চীনা বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে তানজানিয়ার দ্বীপ অঞ্চল জানজিবার এর মৎস্যখাতে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে চীনা কোম্পানি ছিরো গ্রুপ। এখানকার সিফুড শিল্পের প্রসারে প্রযুক্তি ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়েছে এই চীনা কোম্পানিটি।
তানজানিয়ার দ্বীপ অঞ্চল জানজিবারের মানুষদের দিনের শুরুটাই হয় এমন চিত্র দিয়ে। কেউ মাছ শিকার করে তীরে ভিড়ছে, কেউ মাছগুলো সাজিয়ে বিশেষ পাত্রে রাখছে আবার কেউবা বিভিন্ন জায়গা মাছ পাঠানোর কাজ করছে।
ভূ-প্রাকৃতিক কারণেই এখানকার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ মাছ ও মৎস। মৎস্য সম্পদ আহরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা হয় এই জানজিবার থেকেই। ফলে সহজেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই দ্বীপ দেশ।
সম্প্রতি এই অঞ্চলের মৎস্য শিকার ও সি ফুডের প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ করছে চীনা কোম্পানি ছিরো গ্রুপ। জানজিবারের ব্লু ইকোনমি অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আবোদ এস জুম্বি জানান, মৎস্য সম্পদের বাজারভিত্তিক ভ্যালু চেইন বিকাশে সহযোগিতা করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো।
আবোদ এস জুম্বি, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, ব্লু ইকোনমি অ্যান্ড ফিশারিজ, জানজিবার
“২০১৭-১৮ সালে জানজিবার সরকার কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণি ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল পাঠায় চীনে। লক্ষ্য ছিলো এসবখাতে সহযোগিতা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানা-বোঝা।“
তবে এই ছিরো গ্রুপের এই পথচলা এতোটা সহজ ছিলো না। ছিরো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াং হাও জানান, শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তিনি চেয়েছেন তানজানিয়াতেই তার ভবিষ্যত গড়তে।
ইয়াং হাও, প্রতিষ্ঠাতা, ছিরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড
“আমাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আমরা চীন থেকে কাচামাল ও প্রযুক্তি আনতে পারছি। অবশ্যই আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকেও অনেক কম দামে এগুলো আনতে পারবো। এর পাশাপাশি চীনের প্রযুক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। স্থানীয় উৎপাদনকারীরা এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানেনা কিন্তু আমরা জানি।“
তিনি জানান, বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নানা আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে এখানকার মৎস্য সম্পদ আহরণ ও বিপণন ব্যবস্থার পরিবর্তনে কাজ করছেন তারা।
কোম্পানি প্রোফাইল:
পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে চীনে ক্রেতা আকর্ষণ করছে সুয়েজ
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: পরিবেশবান্ধব নানা পণ্য নিয়ে চীনা ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে ফরাসি কোম্পানি সুয়েজ। ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় এবার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছে, চীনের সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী সুয়েজ।
চীনের পরিবেশবান্ধব নানা পন্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে এ বিষয়ক নানা পণ্য ও সেবার খোঁজে মানুষ। মানুষের এই চাহিদাই কাজে লাগিয়ে বাজারে প্রভাব সৃষ্টি করতে মরিয়া সুয়েজ।
তাইতো চীনের বাজার ধরতে আরও বেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসছে ফরাসী কোম্পানি সুয়েজ গ্রুপ। মূলত পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক নানা পণ্য বিপণন করে সুয়েজ। বিশেষ করে পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নানা সেবা দেয় তারা। চীনের বাজারে কাজ করার সুযোগকে অনেকটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে সুয়েজ।
সুয়েজ গ্রুপের চেয়ারওম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা সৌশান জানান, ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল নাগাদ সময়ের মধ্যে লাভের মুখ দেখার প্রত্যাশা তাদের। তিনি জানান, চীন সরকার এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোয় তারা এই দেশে ব্যবসা করতে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন।
চীনে পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর পর চীন কম কার্বন নিঃসরণ হয় এমন পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এই আগ্রহ চীনাদের মধ্যে এ ধরনের প্রযুক্তি ও পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করেছে। চীনের এই বিশাল বাজার ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে ভালো কাজে লাগবে বলেও মনে করেন তিনি।