দেহঘড়ি পর্ব-০৩৮
2023-10-01 18:47:27

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

অঞ্জনির টিসিএম চিকিৎসা কী?

আপনার চোখের চারপাশে কি কখনো এমন গোটা উঠেছে, যার ফলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এমন গোটাকে বলা হয় অঞ্জনি। কোথাও কোথাও এটাকে তেলাও বলা হয়। চোখে অনেক ক্ষুদ্র তেল গ্রন্থি আছে; বিশেষ করে চোখের পাতার ওপর। মৃত কোষ, ময়লা বা তেল জমে ওই ছোট ছোট তেল গ্রন্থিগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভেতরে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ায় অঞ্জনি হয়। অঞ্জনি হলে চোখ ফুলে লাল হয়ে যায় এবং পাতা ফেলতে গেলেই ব্যথা লাগে। এমন গোটায় অনেক সময় পুঁজও হয়ে যায়।

প্রাপ্তবয়স্করা অঞ্জনিতে বেশি আক্রান্ত হন। এর দুটি ধরন আছে - বাহ্যিক অঞ্জনি ও অভ্যন্তরীণ অঞ্জনি। এর মধ্যে বাহ্যিক অঞ্জনিই বেশি দেখা যায়। এটি চোখের পাতার বাইরের অংশে হয়। এ ধরনের অঞ্জনির কারণ চোখের পাতার ফলিকলে সংক্রমণ। অভ্যন্তরীণ অঞ্জনি চোখের পাতার ভিতরের অংশে হয়। এ ধরনের অঞ্জনির কারণ চোখের পাতার ভিতরের তেল-উৎপাদনকারী গ্রন্থিতে সংক্রমণ।

টিসিএমে মনে করা হয়, প্লীহা ও পেটে তাপ জমা হয়েছে এমন ব্যক্তির অঞ্জনি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে অতিরিক্ত মশলাদার, তৈলাক্ত ও ভাজা খাবার খাওয়ার কারণে এই তাপ জমা হতে পারে। পরিবেশ থেকে শরীরে প্রবেশকারী বহিরাগত বায়ু-তাপের কারণেও এটা হয়; এটা হয় তখন, যখন প্লীহা ও পেটের তাপ সেখানকার মেরিডিয়ানগুলোর মধ্য দিয়ে চোখের পাতায় পৌঁছায় এবং এর ফলে চোখের পাতায় মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত বাধাগ্রস্ত হয়। এই বাধাগ্রস্ত ‘ছি’ ও রক্ত এবং জমে থাকা তাপ টিস্যুতে প্রদাহ ও পুঁজ সৃষ্টি করে।

যদিও এটি সাধারণত নিজে নিজেই সেরে যায়, তবে চিরাচরিত চীনা চিকিৎসাপদ্ধতি বা টিসিএম এ থেকে মুক্তি পাওয়ার গতি দ্রুত করতে পারে, বিশেষ করে গুরুতর ক্ষেত্রে। অঞ্জনির টিসিএম চিকিৎসার মধ্যে আছে আকুপাংচার, টিসিএম ভেষজ ফর্মুলা ও রক্তপাত। আক্রান্ত স্থানের চারপাশে নির্বাচিত আকুপয়েন্টে আকুপাংচার করা হলে তা চোখের পাতায় জমে থাকা তাপ সরিয়ে দিতে সাহায্য করে। এছাড়া ‘আর চিয়ান’ এবং ‘তা চুই’র মতো আকুপয়েন্ট দিয়ে রক্তপাতও তাপ দূর করতে সাহায্য করতে পারে।

অঞ্জনি হলে টিসিএম ভেষজ চা ব্যবহার করতে পারেন। একটি চায়ের পাত্রে ৬ গ্রামের মতো হানিসাকল, ৮ গ্রামের মতো চন্দ্রমল্লিকা, ৮ গ্রামের মতো ড্যান্ডেলিয়ন এবং ৫ গ্রামের মতো প্রুনেলা ভালগারিস নিন। তারপর তাতে ফুটন্ত পানি ঢালুন এবং ৫ মিনিট রেখে দিন। দিনে ৩ বার এই চা পান করুন।

অঞ্জনি হলে সেটা যাতে দ্রুত সারে এবং খারাপের দিকে না যায়, সেজন্য কতগুলো পদক্ষেপ বা সতর্কতা অবলম্বন করা যায়। আক্রান্ত চোখে দিনে ৩ থেকে ৪ বার সেক দিতে হবে। এজন্য প্রথমে গরম পানিতে একটি পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে নিন তারপর কাপড়টি ভাজ করে ৫ থেকে ১০ মিনিটের জন্য চোখের উপর রাখুন।

এছাড়া চোখের পাতা পরিষ্কার রাখতে হবে। ফার্মেসিতে এক ধরনের আইলিড ওয়াইপ পাওয়া যায়। সেটা ব্যবহার করতে পারেন এর জন্য। কিংবা সামান্য বেবি শ্যাম্পু পানিতে মিশিয়ে নিন তারপর সেটা দিয়ে তুলা ভিজিয়ে আস্তে আস্তে চোখের ময়লা মুছে ফেলুন।

অঞ্জনি হলে চাপাচাপি করবেন না। যতটা সম্ভব হাতের স্পর্শ এড়িয়ে চলুন। তাছাড়া এটা সম্পূর্ণভাবে দূর না হওয়া পর্যন্ত মেকআপ বা কন্টাক্ট লেন্স পরা থেকে বিরত থাকুন।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

নানা চিকিৎসাব্যবস্থার সম্মিলন ঘটেছে ক্লিফোর্ড হাসপাতালে

ক্লিফোর্ড হাসপাতাল চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুয়াংতং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংচৌয়ে অবস্থিত একটি বৃহৎ আকারের আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষ বলছে, এটিই বিশ্বের একমাত্র হাসপাতাল, যেখানে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএম, পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসা অনুশীলনের মধ্যে একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতের এ হাসপাতালটি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, ৯০ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে এবং এর শয্যাসংখ্যা ৬শ’। এখানকার পরিবেশ গতানুগতিক হাসপাতালের মতো নয়; অনেকটা শান্ত হোটেলের মতো।

ক্লিফোর্ড সর্বোচ্চ স্তরের একটি হাসপাতাল হিসাবে স্বীকৃত। সর্বাধুনিক চিকিৎসাপ্রযুক্তি ও চিকিৎসাসুবিধা সম্বলিত এ হাসপাতালে কর্মরত এক হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক পেশাদার চিকিৎসাকর্মী। এখানে রয়েছে একটি বিস্তৃত বহিরাগত রোগী বিভাগ, ইনপেশেন্ট বিভাগ এবং জরুরি বিভাগ। পাশাপাশি এখানে রয়েছে বহিরাগত রোগীদের জন্য প্রায় দুশো পরামর্শ কক্ষ এবং টিসিএম, পশ্চিমা চিকিৎসাসুবিধা, অভ্যন্তরীণ ওষুধ, সার্জারি, গাইনোকোলজি, প্রসূতি ও শিশুরোগসহ ৪০টিরও বেশি ক্লিনিকাল ইউনিট। বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর মধ্যে আছে অনকোলজি সেন্টার এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসাকেন্দ্র। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার বহিরাগত রোগী এ হাসপাতাল থেকে সেবা নেয়।

ক্লিফোর্ড হাসপাতাল ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল বা জেসিআই’র স্বীকৃতি অর্জন করে। এটিই জেসিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চীনের প্রথম হাসপাতাল। জেসিআই স্বীকৃতির অর্থ হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃত স্বাস্থ্যসেবার সর্বোচ্চ মানের নিশ্চয়তা রয়েছে এখানে।

এরপর ২০০৬, ২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৫ সালেও শীর্ষ গ্রেড নিয়ে জেসিআই স্বীকৃতি পায় ক্লিফোর্ড হাসপাতাল। বছরের পর বছর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে ক্লিফোর্ড বিশ্বের একমাত্র সমন্বিত মেডিসিন হাসপাতাল হয়ে উঠেছে, যেখানে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে জেসিআই-স্বীকৃত টিসিএম, পশ্চিমা চিকিৎসা এবং প্রাকৃতিক মেডিসিনের সম্মিলন ঘটেছে। এছাড়া ক্লিফোর্ড অর্ধশতাধিক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বীমা কোম্পানি দ্বারা স্বীকৃত এবং ৬০টিরও বেশি দেশে এক দুর্দান্ত খ্যাতি তৈরি করেছে।

ক্লিফোর্ড হাসপাতাল ইতোমধ্যে অঙ্কোলজি, আকুপাংচার ম্যাসেজ চিকিৎসা, কার্ডিওলজি ও হৃদরোগ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, নেফ্রোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও হেপাটোলজি, নিউরোলজি, প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক্স, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের এবং আকুপাংচারে প্রাদেশিক পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

 

#ভেষজের গুণ

অসাধারণ ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ সর্পগন্ধা

ভারতীয় স্নেকরুট বা সর্পগন্ধা অসাধারণ ঔষধি গুণসমৃদ্ধ এক ধরনের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর শিকড় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সর্পগন্ধা হালকা উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, নিদ্রাহীনতা এবং সাইকোসিস ও উন্মাদনার মতো মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সাপ ও অন্যান্য বিষাক্ত সরীসৃপের কামড়, জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্ত্রের রোগ, যকৃতের অসুখ, বাতসহ অস্থিসন্ধিতে ব্যথা এডিমা, মৃগীরোগ ও সাধারণ দুর্বলতার ওষুধ হিসাবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

উচ্চ রক্তচাপ: সর্পগন্ধা সবচেয়ে বড় গুণ হলো এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এই ভেষজে রেসারপাইন নামক এক ধরনের রাসায়নিক আছে, যা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

মানসিক চাপ: সর্পগন্ধায় প্রচুর প্রশান্তিদায়ক ও উপশমকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর শিকড় চিবিয়ে খেলে তাৎক্ষণিকভাবে মন শান্ত হয় এবং মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা দূর হয়। যাদের ঘুমের সমস্যা হয়, তাদের জন্যও এটি খুবই উপকারী।

পেটের পীড়া: সর্পগন্ধা পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার চিকিৎসার এক দুর্দান্ত ভেষজ। এটি পেট পরিষ্কার করে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পেটকে সাহায্য করে। ডায়রিয়ার চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যায় এ ভেষজ।

চর্মরোগ: ফোড়া, ব্রণ, একজিমা ও সেলুলাইটিসের মতো ত্বকের সমস্যার চিকিৎসায় আয়ুর্বেদে সর্পগন্ধা ব্যবহার করা হয়। এই ভেষজটি সংক্রমণের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে কারণ এতে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক মেরা ফেলার উপাদান।

মাসিকের সমস্যা: পিরিয়ডের সমস্যায় ভুগছেন এমন নারীদের সাহায্য করতে পারে সর্পগন্ধা। জরায়ু গহ্বর থেকে বিষ অপসারণ করতে এবং পেশিসংকোচন ও ফোলাভাব দূর করতে পারে এই ভেষজ।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।