চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-৩৬
2023-09-30 19:03:24


  

চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ: চীনের মধ্য-শরৎ উৎসব

হংকংয়ে জমকালো লণ্ঠন শো

২৯ সেপ্টেম্বর চীনে উদযাপিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মিড-অটাম ফ্যাস্টিভ্যাল বা মধ্য-শরৎ উৎসব।

মধ্য-শরৎ উৎসব ও ১ অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে হংকং বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছে জমকালো লণ্ঠন শো’র।

‘সিচুয়ান লণ্ঠন হংকংকে আলোকিত করে’ শিরোনামে অলড্রিচ বে পার্কে চলছে মাসব্যাপী প্রদর্শনীটি। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চিকং শহরের কারিগরদের হাতে তৈরি লণ্ঠনগুলোর মনোমুগ্ধকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো আনন্দ, মঙ্গল এবং একটি উজ্জ্বল অভিন্ন ভবিষ্যতের প্রতীক বহন করে।

চিকং লণ্ঠন তৈরির কৌশলের উত্তরাধিকারী ওয়ান সংতাও বলছিলেন তাদের ঐতিহ্যবাহী লণ্ঠন সম্পর্কে।

‘আমরা এই ইভেন্টের জন্য মোট ১১ সেট লণ্ঠন তৈরি করেছি। ১০০ জন লণ্ঠন কারিগর জিকংয়ে ৩০ দিন কাজ করে লণ্ঠনগুলো এই লণ্ঠন প্রদর্শনীর মাধ্যমে, আমরা হংকংসহ গোটা চীনের মানুষের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ জাতীয় দিবস এবং মধ্য-শরৎ উৎসব কামনা করছি’। 

হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক জিকং লণ্ঠন চীনের জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।

লন্ডনে মধ্য-শরৎ উৎসব উদযাপন

চীনের ঐতিহ্যবাহী মধ্য-শরৎ উৎসবের আমেজ শুধু চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রবাসী চীনারাও পালন করেছেন এ উৎসব। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী চীনারা রোববার লন্ডনে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করেন মধ্য-শরৎ উৎসব। লন্ডন চায়না টাউন চায়নিজ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে যুক্তরাজ্য প্রবাসী চীনারা এ উৎসব পালন করেন। উৎসবে চীনের কুয়াংতোং প্রদেশ থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীদল অংশ নেন।

ঐতিহ্যবাহী ক্যান্টনিজ অপেরা, অ্যাক্রোবেট, চায়নিজ স্টাইল নাচ, লায়ন ডান্স, রড-পাপেট শো ইত্যাদি পরিবেশনা উপস্থিত চীনা ও ইউরোপীয় দর্শকদের মুগ্ধ করে। উৎসাহী অনেক দর্শকও নাচে অংশ নেন।

মালয়েশিয়ায় মধ্য-শরৎ উৎসব উদযাপন

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে চীনা সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মধ্য-শরৎ উৎসব উপলক্ষ্যে রোববার এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে শিশুরা চীনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হানফু পরে ফ্যাশন শো করে।

ঢাকায় মধ্য-শরৎ উৎসব উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

এদিকে, চীনা সংগীত, নাচ ও মার্শাল আর্ট পরিবেশনার মাধ্যমে চীনের ঐতিহ্যবাহী মধ্য-শরৎ উৎসব উদযাপিত হয়েছে বাংলাদেশে।

ঢাকায় এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ারের দ্বিতীয় দিনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদযাপিত হয়।

ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট ও চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস এসোসিয়েশন বাংলাদেশ চীন নাচ, গান ও শরীরচর্চা পরিবেশন করে।

সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটি শুরু হয় ‘উজ্জ্বল চাঁদ ও ফোটা ফুল সমেত এক চমৎকার রাত্রি’ যন্ত্রসংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে। এরপর একে একে চীনা গান, মার্শাল আর্ট ও নাইফ টেকনিক পরিবেশন করেন কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও অন্যান্য পারফর্মাররা।

অনুষ্ঠানের পুরো সময়ই দর্শকরা তুমুল করতালির মাধ্যমে পারফর্মারদের উৎসাহ জোগান।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম/শান্তা মারিয়া।

 

২. লোককাহিনীতে মধ্য-শরৎ উৎসব

চীনের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব, মধ্য-শরৎ উৎসব হয়ে থাকে চীনের চান্দ্র পঞ্জিকা বা লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অষ্টম চান্দ্র মাসের ১৫তম দিনে বা ভরা পূর্ণিমার রাতে। মধ্য-শরৎ উৎসবকে ঘিরে অনেকগুলো লোকজ গল্প রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটি হলো চন্দ্রদেবী ছ্যাং ই কে ঘিরে।

অনেক অনেক বছর আগে আকাশে উঠেছিল দশটি সূর্য। সেই দশ সূর্যের তাপে মানুষের জীবন হয়ে পড়লো অতিষ্ঠ। তখন মানুষকে দুর্দশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন বীর তীরন্দাজ হোও ই। তিনি তীর ধনুক দিয়ে নয়টি সূর্যকে কুপোকাত করলেন। পৃথিবীর জন্য একটি সূর্যই যথেষ্ট বলে রয়ে গেল একটিমাত্র সূর্য।

হোওইর এই বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে দেবরানী মা মতান্তরে দেবতারা হোওইকে দিলেন এক বোতল অমৃত। এই অমৃত খেলে তিনি অমর হবেন এবং দেবতায় পরিণত হয়ে অমৃতলোকে চলে যাবেন। হোওই তার স্ত্রী ছ্যাং ইকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। অমর হওয়ার চেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মর্ত্যলোকে বাস করাটাই তার বেশি কাম্য ছিল। তাই তিনি বোতলটি ঘরে এনে রেখে দিলেন।

এদিকে, ফাং মাং নামে হোওইর এক লোভী শিষ্য ছিল। একদিন হোওই  যখন বাইরে গেছেন তখন ফাং মাং সেই অমৃত চুরি করে খাওয়ার চেষ্টা করে। ফাং মাং-এর মতো খারাপ লোক যেন অমর হতে না পারে তাই ছ্যাং ই দ্রুত অমৃত পান করে ফেলেন। তার শরীর হালকা হয়ে যেতে থাকে এবং তিনি চাঁদে পৌছে যান। তিনি পরিণত হন চাঁদের দেবীতে। বিরহকাতর হোওই তাকে স্মরণ করে চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন এবং চাঁদের প্রতি নানা রকম নৈবদ্য উৎসর্গ করেন। প্রচলিত রয়েছে যে, মধ্য-শরৎ উৎসবের রাতে পূর্ণিমার চাঁদে ছ্যাং ইর ছায়া দেখা যায়।

আরেকটি গল্পে রয়েছে, অরণ্যে খরগোশের কাছে দেবতারা অতিথি হলে, অতিথি সৎকারের জন্য অন্য কোন খাদ্য না থাকায় আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকেই উৎসর্গ করে খরগোশ। তার এই আত্মত্যাগে মুগ্ধ হয়ে দেবতারা তাকে জেড পাথরের পবিত্র প্রাণীতে পরিণত করে চাঁদে স্থান দেন।

মধ্য-শরতের পূর্ণিমা রাতে চাঁদে খরগোশকেও দেখা যায়।

মধ্য-শরৎ উৎসবের দু’ হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। থাং রাজবংশের সময় খুব জাঁকজমকের সঙ্গে এ উৎসব পালন করা হতো।

 

মধ্য-শরৎ উৎসবে নানা রকম রীতি রেওয়াজ রয়েছে। এই সময় মুনকেক তৈরি হয়। মুনকেকে পদ্মফুলের বীজ পুর হিসেবে ব্যবহার হয় অথবা বিভিন্ন রকম পুর ব্যবহার করে মুনকেক তৈরি হয়। বন্ধুবান্ধবকে মুনকেক উপহার দেয়ার প্রথাও রয়েছে। দূরপ্রবাসীরা ঘরে ফিরে আসেন পরিবারের সঙ্গে উৎসব পালন করেন।

এ উৎসবের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো লণ্ঠন বা ল্যানটার্ন উৎসব এবং ফানুস ওড়ানো। এ সময় চীনা লণ্ঠন জ্বালানো হয় এবং ফানুস ওড়ানো হয়। মধ্য শরৎ উৎসবের প্রতীক হলো চাঁদ, খরগোশ, ছ্যাং ই, পদ্মফুল ও লণ্ঠন।

এ সময় নানা রকম সাংস্কৃতিক উৎসবেরও আয়োজন থাকে দেশজুড়ে। এ বছরও নানা রকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে মধ্য-শরৎ উৎসব।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

 

৩. হাংচৌ এশিয়াড: প্রযুক্তি-ঐতিহ্যে মেলবন্ধন

 

পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশে চলছে ১৯তম এশিয়ান গেমসের আসর। এর আগে চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই আসর।

এবারের আসরে ৪৫টি দেশ এবং অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার  ক্রীড়াবিদ ৪০টি খেলা, ৬১টি ডিসিপ্লিন এবং ৪৮১টি ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী হাংচৌর স্পোর্টস সেন্টার স্টেডিয়ামে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৯তম এশিয়ান   গেমসের আসর।

এতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সম্মিলন ঘটানো হয়।

পদ্ম আকৃতির হাংচৌ অলিম্পিক স্পোর্টস সেন্টার স্টেডিয়ামে, প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগের প্রাচীন লিয়াংচৌ সংস্কৃতির মোহনীয়তা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিশ্রিত সং রাজ বংশের সংস্কৃতি একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল ফিস্ট মঞ্চস্থ করে।

ঐতিহ্যবাহী চীনা পোশাকে নৃত্যশিল্পীরা ভার্চুয়াল নদীর ঢেউয়ের উপর নৃত্য পরিবেশন করে।

এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি অভূতপূর্ব ডিজিটাল লাইট শো এর আয়োজন করা হয়। লাখ লাখ মশালবাহী ডিজিটাল শিখাকে ছিয়ানথাং নদীর তীরে ডিজিটাল মানবচিত্রে রূপান্তরিত করা হয়। 

এদিকে, ১৯ তম এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সম্প্রচারের ক্ষেত্রে প্রথম ঐতিহাসিক অর্জন করেছে চায়না মিডিয়া গ্রুপ সিএমজি।

অনুষ্ঠানের সম্প্রচার ও কভারেজ প্রদানের জন্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পেশাদার রিপোর্টার এবং অন্যান্য সহায়ক পরিষেবা পাঠায় সিএমজি। এশিয়ান গেমসের প্রধান সম্প্রচার সংস্থা হিসেবে এই প্রথম সিএমজি কাজ করছে।   

২৩ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ১৯তম এশিয়ান গেমসের এই আসর আগামী ৮ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী/সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম।

---------------------------------------------------------------------------

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দি।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ