চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘চলতি বাণিজ্য’
2023-09-29 19:14:03


 

চলতি বাণিজ্যের ৩৭তম পর্বে থাকছে:

১. ফল সংরক্ষণে বিপ্লব চীনের সিনচিয়াংয়ে, বাগানে পর্যটকদের ঢল

২. মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে চীনা কোম্পানি

৩. মোজাম্বিকে চীনের সেতু: পাল্টে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা

ফল সংরক্ষণে বিপ্লব চীনের সিনচিয়াংয়ে, বাগানে পর্যটকদের ঢল

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিক ফলমূল ও ফসলকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির এক বিশাল বলয় তৈরি হয়েছে চীনের উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিনচিয়াংয়ে। এখানকার আঙুর, মিষ্টি বরইসহ নানা ফল সংরক্ষণের জন্য নতুন করে গড়ে উঠছে কোল্ড স্টোরেজ। আবার উৎপাদিত ফল চীনের বিভিন্ন অঞ্চলসহ মধ্যএশিয়ার ৫ দেশে সরবরাহের লক্ষ্যে চালু হচ্ছে মালবাহী ট্রেন লাইন। কোন কোন জায়গায় গড়ে উঠছে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল শিল্প নয় বরং গড়ে তোলা ফলের বাগান ক্রমেই হয়ে উঠছে চীনা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা।

নানা রকম তাজা ফলের জন্য বিখ্যাত চীনের উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিনচিয়াং। বিশেষ করে এই অঞ্চলের আঙুর ও কিসমিসের সুনাম কেবল চীন নয়, সীমানা ছাড়িয়ে মন জয় করেছে সারা বিশ্বের ভোক্তাদের। এখানকার রোদ্রজ্জ্বল পরিবেশ ও তাপমাত্রা আঙুর চাষের জন্য বেশ উপযোগী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অঞ্চলে অন্তত সাড়ে ৫শ’ প্রজাতির আঙুর চাষ হয় এখানে।

আবার কুল জাতীয় ফলসহ নানা রকম রসালো ফল উৎপাদন হয় এই সিনচিয়াংয়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় কেবল চীনের কাশগড়ের চিয়াশি কাউন্টির ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে মিষ্টি কুল জাতীয় ফল। স্থানীয় কৃষি বিভাগ আরও জানায়, সিনচিয়াংয়ের ৩০ হাজার হেক্টর পরিমাণ জমিতে হয় আঙুর চাষ। তারা আশা করছেন চলতি বছর প্রায় দেড় মিলিয়ন টন আঙুর উৎপাদন হবে। 

কিন্তু এতো পরিমাণ উৎপাদিত সবই কি স্থানীয়ভাবেই কাজে লাগে? উত্তর হলো না। মূলত এসব তাজা ফলমূল সিনচিয়াংয়ের বিস্তর জমিতে চাষ হয়। তবে বিশাল এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা আর সংরক্ষণের নানা উপায় জানা না থাকায় প্রাচীন কাল থেকেই নিজেরাই তা সংরক্ষণ করে রাখে। বিশেষ করে আঙুর শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বানানো হয় কিসমিস। এসব কিসমিস স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে চীনের বিভিন্ন শহরে চলে যায়। তবে বর্তমানে সরবরাহ ব্যবস্থা যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি সংরক্ষণের জন্য গড়ে উঠেছে নানা রকম কোল্ড স্টোরেজ। (স্থানীয় বাসিন্দা আদিলিচিয়াং জানান, ফল শুকিয়ে সংরক্ষণ করার কৌশল এখানে সুপ্রাচীন এবং তারা খুব দক্ষ।)

                                                                                                                           আদিলিচিয়াং, স্থানীয় বাসিন্দা, তুরপান

“কৃষকরা এখন ফল শুকানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। অক্টোবরেই শুরু হবে কিশমিশ তৈরির কাজ। এখানে যেহেতু পরিবহন ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না তাই ৬০ শতাংশ আঙুর শুকিয়ে কিশমিস তৈরি করা হয়। এখন অবশ্য পরিবহন ব্যবস্থা কিছুটা ভালো হচ্ছে আর কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা আছে। তাই আমরা চাইলে ৬০ শতাংশ আঙুর বাজারে পাঠিয়ে ৪০ শতাংশ কিসমিস তৈরি করতে পারি।


সিনচিয়াংয়ে বিপুল উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিশেষ করে তাজা ফল সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগারের যে কোন বিকল্প নেই তা অনুধাবনের পরই পদক্ষেপ নিয়েছে চীনের সরকার। এসব এলাকায় গড়ে উঠছে আরও অনেক সংরক্ষণাগার। এসব পদক্ষেপে খুবই খুশি স্থানীয় কৃষকরা। পাশাপাশি উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অর্থনীতিও ক্রমেই সমৃদ্ধ হচ্ছে।

শুধু কি তাই? এর বাইরেও এই এলাকার সঙ্গে রেল পথে যুক্ত করা হচ্ছে চীনের অন্যান্য অঞ্চলের। এসব উৎপাদিত ফল পরিবহনের জন্য সম্প্রতি চালু হয়েছে কাশগড়-শেনছেন কোল্ড-চেইন ফ্রেইট ট্রেন। সম্প্রতি সিনচিয়াং থেকে ৬৪০ টন আঙুর ও মিষ্টি বরই বোঝাই ট্রেন গেছে শেনছেনের পিংহু রেলওয়ে স্টেশনে। আগে সড়ক পথে যেখানে ৬ দিনে এই পথ পাড়ি দিতে হতো সেখানে নতুন ট্রেন লাইন আসার কারণে দূরত্ব কমেছে ২ দিনের। আবার মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের হাব হয়ে উঠছে এই সিনচিয়াং। (কোল্ড চেইন ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের প্রধান জানান, ভবিষ্যৎ যোগাযোগের কথা মাথায় রেখেই এই বিপুল পরিকল্পনা নিয়েছে চীন।)

                                                                                                     উ সিয়াওচিয়ে, প্রধান, কোল্ড চেইন ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার

“আমরা সিনচিয়াংয়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় পুরো কাশগড় এলাকাকেই ফল সরবরাহের কেন্দ্র ও কোল্ডচেইন হাবে পরিণত করেছি। ভবিষ্যতে মধ্য এশিয়ার ৫টি দেশের সঙ্গে যে সংযোগ তৈরি হচ্ছে সেটাকে লক্ষ্য রেখেই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব দেশ থেকে নানা রকমের খাবার যেমন কাশগড় হয়ে পুরো চীনের বিভিন্ন জায়গায় যাবে তেমনি চীনের বিভিন্ন অংশ থেকেও উন্নত মানের খাবার ও ফলমূল এসব দেশে পাঠানো হবে।


চীনের ইন্টারন্যাশনাল মেরিন কন্টেইনার –সিআইএমসি’র তত্বাবধানে তৈরি করা এসব কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থাপনায় থাকছে শক্তিশালী টিম। ব্যয় করা হয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ইউয়ান বা ১৭ দশমিক ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কোল্ড স্টোরেজে ৩০ হাজার টন পর্যন্ত তাজা ফল সংরক্ষণ করা যাবে। এর পাশাপাশি এখান থেকে পাওয়া যাবে প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও সরাসরি বিক্রি করার মতো সেবাও। তারা বলছেন, সিনচিয়াংয়ের বিভিন্ন জায়গায় চালু করা কোল্ড স্টোরেজে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

এদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল থেকে তৈরি হচ্ছে নানা রকমের খাবার ও পানীয়। আবার আঙুর থেকে তৈরি হয় মদসহ বিভিন্ন পানীয়। এরইমধ্যে সিনচিয়াংয়ে চীনের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে নানা রকমের ফুড প্রসেসিং শিল্প।

অন্যদিকে আঙুরসহ নানা রকম ফলের বাগানও যেন পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ফলে হু হু করে বাড়ছে স্থানীয় অর্থনীতির আকার ও মানুষের কর্মচাঞ্চল্য। চলতি বছর সিনচিয়াংসের ফলের বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক ও গ্রামীন পর্যটনের নানা ইভেন্টে অংশ নিতে ২ কোটি পর্যটক আসতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

ভিনদেশে চীন:

মোজাম্বিকে চীনের সেতু: পাল্টে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পাল্টে গেছে চীনের তৈরি করা এক সেতুর কারণে। দেশটির রাজধানী মাপুটোকে দুই ভাগে ভাগ করে মাপুটো উপসাগর। দীর্ঘ ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই বিশাল জলমগ্ন এলাকা পার হতে একমাত্র অবলম্বন ছিলো ফেরি। ফলে ব্যাপক সময় যেমন ব্যয় করতে হতো তেমনি নাগরিকদের চরম যাতাযাত সমস্যা ছিলো। নতুন তৈরি করা এই সেতুর কারণে পুরো রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় চাঞ্চল্য ফিরেছে। এখন নির্বিঘ্নে যাওয়া আসা করতে পারছে দুই পাড়ের মানুষ।

কেবল রাজধানী নয়, এই সেতুর ফলে দেশটির আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে গতি ফিরেছে, স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং মানুষের জীবন মান উন্নয়ন হয়েছে। এর পাশাপাশি আফ্রিকান এই দেশটির শিল্প ও পর্যটন খাতেও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মাপুটো সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ছেন হাওচু জানান, আফ্রিকা অঞ্চলে মোজাম্বিকের এই সেতুটি চীনের প্রস্তাব করা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অন্যতম মাইলফলক প্রকল্প। তিনি জানান, ৬৮০ মিটার স্প্যানের এই আধুনিক সেতুটি মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুটোর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।  

দীর্ঘ দিন ধরেই দুই তীদের বাসিন্দাদের সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো উপসাগরটি। এই উপসাগরের উপর দিয়ে একটি ব্রিজ তৈরি করা মোজাম্বিকের মানুষের দীর্ঘ দিনের চাওয়া ছিলো। চীনের তৈরি করা এই ব্রিজটির কারণে সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের এই চাওয়া পূরণ হয়। এখানকার এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, এই সেতু তৈরির কারণে তাদের অনেক উপকার হয়েছে। তিনি জানান, ফেরিতে করে তাদের এতোদিন যাতায়াত করতে হয়েছে। তবে এখন তারা বাসে খুব অল্প সময়ে আসা যাওয়া করতে পারেন। 

 

কোম্পানি প্রোফাইল:

মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে চীনা কোম্পানি

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: মহাকাশ গবেষণায় একের পর এক নাম লেখাচ্ছে বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ক্রমেই সফলতার মুখ দেখছে ব্যক্তমালিকানাধীন এসব কোম্পানি। এমনই একটি কোম্পানি ওয়ান স্পেস।

সম্প্রতি মহাকাশের কক্ষপথে একটি রকেট পাঠায় চীনা প্রাইভেট মহাকাশ গবেষণা ও উৎক্ষেপণের বাণিজ্যিক কোম্পানি ওয়ান স্পেস।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ছোংছিং লিয়াংচিঙাং স্টার ওএস-এক্সওয়ান নামের এই রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ওয়ান স্পেসের উৎক্ষেপণ করা দ্বিতীয় রকেট।

ওয়ানস্পেস মূলত চীনের রাজধানী বেইজিং ভিত্তিক একটি কোম্পানি। কোম্পানিটির উৎপাদন কারখানা বা উৎপাদন ঘাঁটি অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চীনের ছংছিং মিউনিসিপ্যালিটিতে।

ওয়ান স্পেস উদ্ভাবিত রকেটের দুটি সিরিজ –ওএস-এক্স এবং ওএস-এম। এর আগে মহাকাশ সেবা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজে অপেক্ষাকৃত ছোট স্যাটেলাইট পাঠায় ওয়ান স্পেস। 

ওয়ান স্পেসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠাতা শু চ্যাং জানান, ছোট স্যাটেলাইটের বাজার ধরতেই মূলত তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল অনেক দেশ রকেট প্রস্তুত করা ও স্যাটেরাইট উৎক্ষেপণের কার্যক্রম শুরু করছে। এসব দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অপেক্ষাকৃত কম দামের স্যাটেলাইটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শু চ্যাং জানান, তারা সেই বাজারটি ধরতে চান।