রাশিয়া থেকে আগত অ্যালেক্সান্দার চীনে ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণারত। চার বছর চীনে অধ্যয়ন ও বসবাস করার সময় তিনি কীভাবে চীনকে দেখেছেন এবং কী ধরনের সাংস্কৃতিক আকর্ষণ অনুভব করেছেন? তার চীনা নামের সাথে ‘ব্রিকস’র সম্পর্ক কী?
“চীনের সঙ্গে আমার ভাগ্য ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।”
‘ভাগ্যের সম্পর্ক’ - এই কথাটি সাক্ষাত্কারে বারবার উল্লেখ করেন অ্যালেক্সান্দার। এখন ২৫ বছর বয়সী অ্যালেক্সান্দার বর্তমানে সি’আন চিয়াও থোং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর পিএইচডি করছেন। চীনের সঙ্গে তার প্রথমবার যোগাযোগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সেটি ছিল তার ভাগ্যের এক অপূর্ব আয়োজন।
তিনি বলেন,
“আমি যখন হাইস্কুলে পড়ছিলাম, তখন আমার একজন ভূগোল শিক্ষক ছিলেন। একদিন তিনি আমাদেরকে বিদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য হোমওয়ার্ক দেন। শিক্ষক আমার জন্য বিষয় হিসেবে চীনকে নির্ধারণ করে দেন। আমি চীন সম্পর্কে অনেক বই পড়েছি। ওয়েবসাইট ব্রাউজ করার পর আমি ইয়ুন নান এবং সিছুয়ান প্রদেশ বেছে নিই। আমার প্রতিবেদনে মূলত সোনার বানর, দৈত্যাকার পান্ডা, হাতি ও কালো ঘাড়ের সারসের গল্প বলা হয়। সেসব ছবি ও গল্প আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। তখনই প্রথম আমার মনে ইচ্ছা জাগে যে, বড় হওয়ার পর আমি চীনে ঘুরে বেড়াবো। সেই সময়ই চীন আমার জীবনে প্রবেশ করে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আলেক্সান্দার চীনা ভাষা শেখার সুযোগ পান এবং রাশিয়ায় অধ্যয়নরত তিন চীনা ছাত্রের সঙ্গে দেখা করেন। তারা চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। অ্যালেক্সান্দারের চীনা নাম ‘ওয়াং ইছেন’। নামটি এই তিন চীনা বন্ধুর নামের সংমিশ্রণ এবং এই নামের অনুপ্রেরণা ছিল ‘ব্রিকস’ শব্দটি। তিনি বলেন,
“একদিন, আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, তারা আমাকে একটি চাইনিজ নাম দিতে পারে কি না। তারা এটি সম্পর্কে অনেকদিন ধরে চিন্তা করেন তবে খুব ভালো ধারণায় উপনীত হতে পারে না। তখন হঠাৎ আমার মনে আসে ‘ব্রিকস’। এটি পাঁচ দেশের ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি। তারপর আমি তাদেরকে বলি, তাহলে তোমাদের নাম থেকে একটি করে শব্দ নিয়ে তো আমার নাম তৈরি করা যায়। এভাবে আমার নাম হয় ওয়াং ইছেন। আমরা এখনও খুব ভালো বন্ধু এবং প্রায়ই একসাথে ভ্রমণ করি।”
২০১৮ সালে চীনা বন্ধুরা অ্যালেক্সান্দারকে বসন্ত উৎসবের জন্য শাংহাইয়ে আমন্ত্রণ জানান। অ্যালেক্সান্দার প্রথমবারের মতো চীনের ভূমি স্পর্শ করেন। সে সময়েই চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
তিনি বলেন,
“আমি যখন শাংহাই পৌঁছাই তখন আমি খুব অবাক হই। কারণ শাংহাই আমার চোখে ভবিষ্যতের একটি শহর। সেখানকার উন্নয়ন খুব দ্রুতগতির এবং খুব শক্তিশালী। শাংহাইয়ের স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে আমি উপলব্ধি করি, টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র থেকে চীনা জনগণের জীবন সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি, তা অনেক পেছনের এবং সময়ের সাথে সেটা তাল মিলিয়ে চলেনি।”
শাংহাইয়ের ওই সফরের সময়ই অ্যালেক্সান্দার গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন - প্রকৃত চীন কেমন? এমন চিন্তা সামনে রেখে তিনি উত্তর খুঁজতে থাকেন। তিনি বলেন,
“পরে আমি একটি স্কুলে ইন্টার্নশিপের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসি। সেখানে আমি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উন্মুক্ত ক্লাস নিই। বিষয় ছিল ‘আমার চোখে চীনের চিত্র’। আমি চীনা সংস্কৃতি ও জীবন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অনেক প্রশ্ন করি এবং আমি বুঝতে পারি, চীন সম্পর্কে তাদের জানাশোনা খুব কম এবং কোনও কোনও শিক্ষার্থী চীন সম্পর্কে একেবারে জানেই না। আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শাংহাই ও ছেংতুতে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি; চীনের দৃশ্য ও জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিই; চীনে ভ্রমণের সময় আমার নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করি এবং আমার তোলা অনেক ছবি ও ভিডিও দেখাই। শিক্ষার্থীরা সেগুলোর প্রতি খুব আগ্রহ দেখায়। ক্লাসের পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার সাথে চীনে পড়াশোনা এবং চীন ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করে।”
২০১৯ সালে অ্যালেক্সান্দার চীনে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। আরও গভীরভাবে চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানার জন্য তিনি প্রাচীন রাজধানী সি’আনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে লেখাপড়া করতে মনস্থির করেন।
ভর্তি বিজ্ঞপ্তির জন্য কয়েক মাস ধরে অপেক্ষা করার সময় অ্যালেক্সান্দার আবার চীন ভ্রমণ করেন। এবার চীন সম্পর্কে তার উপলব্ধি আরও গভীর হয়। তিনি বলেন,
“আমি চীনের অনেক জায়গায় গিয়েছি। যেমন, তিব্বতি জাতি, হুই জাতি, তোং জাতিসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি-অধ্যুষিত এলাকা।”
চীনে অধ্যয়নের জন্য আসার পর অ্যালেক্সান্দার চীনা সংস্কৃতি জানার আরও বেশি সুযোগ পান। তিনি মনে করেন, চীনা অভিব্যক্তি কেবল একটি ভাষা ও সংস্কৃতি নয়, বরং জীবনের একটি শিল্পও। তিনি বলেন,
“একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনা ভাষায় ‘আপনি কি খেয়েছেন?’ আসলে এ বাক্য দিয়ে কেউ আপনাকে জিজ্ঞাসা করছেন না, আপনি খেয়েছেন কিনা। এটি একটি অভিবাদন এবং আপনার প্রতি তার যত্নের প্রকাশ। আমার মতে, চীনের সংস্কৃতিতে খাদ্য সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
অ্যালেক্সান্দার বিশ্বাস করেন, আপনি যদি আজকের চীনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে চান তবে শুধু দৈনন্দিন জীবন, খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান ও পরিবহন দিয়ে সেটা সম্ভব নয়; আপনাকে দীর্ঘস্থায়ী চীনা সভ্যতাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাই তিনি প্রচুর চীনা সিনেমা এবং ও নাটক দেখেন।
তিনি বলেন,
“আমি যখন সেন্ট পিটার্সবার্গে ছিলাম, তখন একটি থিয়েটারে একটি চাইনিজ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। টানা সাত দিন ধরে প্রতিদিন বিভিন্ন চাইনিজ ফিল্ম দেখানো হয়। আগে থেকেই সেখানে অর্ডার করতে হয়। কারণ সেখানে প্রচুর ভিড় ছিল। সেই সময় আমি ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’, ‘হোমকামিং’ এবং ‘রেড সোর্গাম’ দেখি। রাশিয়ান সাংস্কৃতিক টিভি স্টেশনে চীনা টিভি নাটকও সম্প্রচার করা হয়, যা আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরাও দেখে থাকেন। চীনে আসার পর, আমি প্রায়ই সিনেমা দেখি। আমাদের বিদেশিদের জন্য চীনা ইতিহাস বোঝার একটি ভালো সুযোগ হলো টিভি সিরিজ বা মুভি দেখা।”
চীনে চার বছর অধ্যয়নকালে অ্যালেক্সান্দার অনুভব করেন, তিনি প্রতিদিন চীন সম্পর্কে আরও বেশি জানছেন। একইসঙ্গে তিনি অনুভব করেন, চীন সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন না তিনি। অ্যালেক্সান্দার বলেন, তিনি কেবল আজকের চীনকে বুঝতে চাননি, বরং প্রাচীন চীনকেও বুঝতে চান এবং ভবিষ্যতের চীনকে দেখার জন্য উন্মুখ থাকেন।
তিনি বলেন,
“আজ চীনের অর্থনীতির বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। সক্রিয়ভাবে মহাকাশ অন্বেষণ করছে এবং এক অঞ্চল এক পথ নির্মাণ করছে। এখন চীন কেবল তার নিজের জনগণকেই রক্ষা করতে পারে না; মানবিক সহায়তা ও অন্যান্য উপায়ে অন্য দেশের মানুষদেরও সাহায্য করতে পারে। চীনের দ্রুত উন্নয়ন আরও বেশি দেশের সহযোগিতা আকৃষ্ট করেছে এবং রাশিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থনীতি ও শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গভীর সহযোগিতা রয়েছে। ভবিষ্যতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ ও শক্তিশালী বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”