চীনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের গল্প
2023-09-25 16:00:15

গত সপ্তাহের অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে সারা চীনজুড়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষকের গল্প শেয়ার করেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আরও কয়েকজন শিক্ষকের গল্প তুলে ধরবো। তাঁদের গল্প আমাদের বেশ মুগ্ধ করে। চলুন, একসাথে তাদের গল্প শুনি।

 

শিক্ষক কু ইয়া-র গল্প

২০১৪ সালে কুইচৌ প্রদেশের বিশেষ শিক্ষক পরিকল্পনার পরীক্ষায় পাস করে, সেপ্টেম্বর মাসে স্থানীয় লিউপানশুই শহরের চংশান এলাকার তাওয়ান জেলার হাইকা গ্রামের একজন গ্রামীণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কু ইয়া। এ গ্রাম কুইচৌ প্রদেশের এমন একটি গ্রাম যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। দরিদ্র এই গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ২৭ বছর বয়সের কু ইয়া, যিনি ছিলেন রক ব্যান্ডের গিটারবাদক, তিনি পরিণত হলেন গ্রামীণ শিক্ষকে। যখন গ্রামের এ স্কুলে যোগ দেন, তখন তাঁর কাছে গ্রামীণ জীবনযাপন ও শিক্ষকতার কাজ ছিল পুরোপুরি অপরিচিত। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে ৩ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ করে তিনি অন্য জায়গায় চলে যাবেন। তবে, ধীরে ধীরে গ্রামীণ শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন নিয়ে আসে।

ছোটবেলায় কু ইয়া রক গায়ক হতে চেয়েছিলেন। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেজর ছিল সংগীত। স্নাতক হওয়ার পর তিনি প্রিয় সংগীত মহলে কাজ করার চেষ্টা করেন। তবে, বাস্তব জীবন এবং কল্পনার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সংগীতে তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়নে তিনি অনেক অস্থায়ী চাকরি করেছেন। ভূগর্ভস্থ টানেল ও পাবে তিনি গান গেয়েছেন। তাঁর বাবা-মা এ খবর শুনে অনেক দুঃখ পান। পিতামাতার চিন্তা দূর করতে তিনি শিক্ষকের চাকরি বেছে নেন।

চরম দরিদ্র ও দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলের গ্রামের স্কুলের জীবন এবং বড় শহরের জীবনের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। শুরুর দিকে একাকী লাগতো শিক্ষক কু-র। বিশেষ করে শীতকালে বেশ ঠাণ্ডা লাগে কুইচৌতে। তাই, গ্রামীণ শিক্ষকের কাজ তাঁর জন্য শুরুর দিকে আনন্দের ব্যাপার ছিল না।

শীতকালের একদিন তিনি ক্লাসের একজন ছাত্রের পায়ে স্যান্ডেল দেখে অবাক হন। তাঁর দৃষ্টিতে এমন ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় একটি বাচ্চার পায়ে শুধু স্যান্ডেল থাকাটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পরে তিনি বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে, বাচ্চাদের জন্য ঠাণ্ডা শীতকাল কাটানোর মতো মোটা কাপড়চোপড় ও জুতা সংগ্রহ করেন। তখন তাঁর মনে কিছু পরিবর্তন ঘটে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে: গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য আর কী কী করা যেতে পারে?

তখন থেকেই গ্রাম ত্যাগ করার আগ্রহ তাঁর ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। অবশেষে তিনি গ্রামেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন ক্লাসের পর তিনি নিজের রুমে বসে গিটার বাজাচ্ছিলেন। একসময় তিনি খেয়াল করেন যে, অনেক ছাত্রছাত্রী তাঁর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বাজনা শুনছে। তাদের চোখেমুখে ছিল সংগীতের প্রতি ভালোবাসা। তখন থেকে গ্রামীণ বাচ্চাদের জন্য সংগীত দল গঠনের একটি ধারণা তাঁর মনে উন্মোচিত হয়। তিনি নিজের বন্ধু ও আশেপাশের স্কুল থেকে কয়েক ধরনের বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করেন এবং বাচ্চাদের নিয়মিত সংগীতের তালিম দিতে শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “কম বয়সে বন্ধুদের সাথে নিয়ে সংগীতের দল গঠন করা আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিল। এখন গ্রামীণ বাচ্চাদের নিয়ে নতুন সংগীত দল গঠন করা আমার দায়িত্ব।”

২০১৮ সালে তিনি প্রথম সংগীত ব্যান্ড গঠন করেন। এখন  হাইকা প্রাথমিক স্কুলে মোট ৬টি ব্যান্ড রয়েছে। ২০২০ সালে শিক্ষক কু’র সংগীত ব্যান্ডের রিহার্সাল ভিডিও ইন্টারনেটে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চীনের কয়েকটি জনপ্রিয় সংগীত ব্যান্ডও হাইকা গ্রামে এসে স্কুলের বাচ্চাদের জন্য কনসার্ট আয়োজন করে।

মিডিয়ার মনোযোগ পাওয়ার পর শিক্ষক কু’র নেতৃত্বে হাইকা গ্রামের বাচ্চাদের সংগীত ব্যান্ড অন্য প্রদেশে প্রদর্শনীর সুযোগ পায়। বাচ্চারা পাহাড়াঞ্চলের বাইরের বিশ্ব দেখার পর অনেক আশাবাদী হয়ে ওঠে। এমন আত্মবিশ্বাস তাদের চরিত্র গঠনে ইতিবাচক ভুমিকা পালন করে। গ্রামীণ বাচ্চারা সংগীতের মাধ্যমে নিজেদের প্রিয় শখ খুঁজে পায় এবং অনেক অপরিচিত লোকের উত্সাহে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। অনেক বাচ্চা বড় শহরে যাওয়ার পর নিজের পড়াশোনায় আরও বেশি প্রচেষ্টা চালায়। কারণ, তাদের মনে সুন্দর জীবন কাটানোর স্বপ্ন আছে।

শিক্ষক কু মনে করেন, গ্রামীণ বাচ্চাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাইলে, ভালো করে লেখাপড়া করতে হবে। সেটি বাদ্যযন্ত্র শেখার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বাদ্যযন্ত্র শেখা যেন বাচ্চাদের মনে একটি বীজ বপনের মতো, যা বাচ্চাদের মনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

শিক্ষক কু’র দৃষ্টিতে সংগীত যেন তারার মতো মনকে উজ্জ্বল করে। তারার আলো বাচ্চাদের মনকে ঝলঝল করতে সক্ষম।

 

শিক্ষক ওয়াং লি ছুনের গল্প

চীনের শানসি প্রদেশের আর্থ-বাণিজ্য স্কুলের শিক্ষক ওয়াং লি ছুন শ্রেষ্ঠ কারিগরি শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমি নিজেই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করার পর শিক্ষক হয়েছি। আজকে আবার কারিগরি শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার লাভ করতে পেরেছি, যা আমার জন্য বেশ গর্বের ও উত্সাহব্যাঞ্জক ব্যাপার।”

শিক্ষক ওয়াং লি ছুনের অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে কিছু পার্থক্য রয়েছে। তিনি শুধু শিক্ষক নন, বরং একজন পাচক, চীনের শ্রম পুরস্কার বিজয়ী, চীন সরকারের বিশেষ ভর্তুকি লাভকারী। গত ৩০ বছর ধরে তিনি দেশের কারিগরি শিক্ষা খাতে অবদান রেখে আসছেন। শানসি প্রদেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক খাবার ও ডিশের উন্নয়নে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান। তা ছাড়া, ধৈর্যের সাথে ছাত্রছাত্রীদের তিনি রান্না শেখান। তাঁর সহায়তায় অনেক শিক্ষার্থী দক্ষ পাচকে পরিণত হয়েছে।

রান্নার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন, “ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে থাকতাম। সেই সময় আমরা ছিলাম গরীব। তাই, সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সুযোগ খুবই কম পেতাম। ধীরে ধীরে বড় হই এবং রান্নার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। তখন শুধু ভাবতাম যে, নিজে রান্না শিখলে সুস্বাদু খাবার বেশি খাওয়া যাবে। এ চিন্তা থেকেই আমার পাচকজীবনের শুরু।”

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ২৪ বছর বয়সের ওয়াং লি ছুন শানসি প্রদেশের সবচেয়ে দক্ষ জুনিয়ার পাচকে পরিণত হন এবং প্রায় ১০ বছর পর তিনি শানসি প্রদেশের সবচেয়ে কম বয়সের সিনিয়র শেফে পরিণত হন। ১৯৯৩ সালের জুন মাসে তিনি শানসি প্রদেশের দক্ষ যুব শেফ প্রতিনিধি হিসেবে চীনের রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং চীনের শ্রেষ্ঠ শেফ পুরস্কারও লাভ করেন। বেইজিংয়ের গণমহাভবনে তিনি শ্রেষ্ঠ শ্রমিক হিসেবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দদের সাথে দেখা করার সুযোগও পান।

গত ৩০ বছর ধরে তিনি দক্ষ পাচক তৈরির নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রমেও তিনি অংশ নিয়েছেন। একবার তিনি কারাদন্ডপ্রাপ্ত ৩ শতাধিক বন্দীকে প্রশিক্ষণ দেন। প্রতিবছর বিভিন্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কারিগরি প্রশিক্ষণও দেন তিনি।

বহু বছর ধরে শিক্ষক ওয়াং’র সহায়তায় ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী দক্ষ পাচকে পরিণত হয়েছেন। তাঁরা চীনের সুস্বাদু খাবার বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বিদেশে চীনা পাচক হিসেবে চাকরি করেন এবং কেউ কেউ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে রান্নার কাজ করেন। কারিগরি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষক ওয়াং সবসময় ছাত্রছাত্রীদের বলেন, “আজ আমি তোমাদের মাস্টার। একদিন তোমরা স্নাতক হয়ে বড় মাস্টার হবে।”

শিক্ষার্থী লিউ হুই শিক্ষক ওয়াং’র প্রিয় ছাত্র। তিনি এখন থিয়ানচিন কারিগরি কলেজের সিনিয়র শিক্ষক এবং চীনের শ্রেষ্ঠ সিনিয়র প্যাস্ট্রি কারিগর। তিনি ভালো করে ময়দা দিয়ে বহু ধরনের সুস্বাদু খাবার রান্না করতে পারেন। চীনের পাচক পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি দু’বার গিনেস বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন এবং ৪০টিরও বেশি টেলিভিশন চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান করেছেন। পাচক ওয়াং হাও শিক্ষক ওয়াং’র আরেকজন প্রিয় ছাত্র। তিনি থাইইউয়ান কারিগরি একাডেমির প্যাস্ট্রি বিভাগের সিনিয়র মাস্টার এবং শানসি প্রদেশের পয়লা মে শ্রম পুরস্কার লাভকারী।

এ সম্পর্কে শিক্ষক ওয়াং লি ছুন বলেন, “আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকে স্নাতক হওয়ার পর সুবিখ্যাত হয়েছে। তাদের প্রচেষ্টায় শানসি স্বাদের খাবারও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।”

নিজের পড়াশোনার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শিক্ষক ওয়াং বলেন, “আমি যখন রান্নাকে মেজর হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, তখন অনেক কষ্টে রান্না শিখতে হতো। প্রতিদিন ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুল ও বাসা থেকে যাওয়া-আসা করতে হতো; প্রতিদিন শাকসবজি ধোয়ার মাধ্যমে শুরু হতো শেখার কাজ।” তবে, কষ্ট করেই তিনি সিনিয়র পাচকদের কাছ থেকে অনেক দক্ষতা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন।

শিক্ষক ওয়াং’র প্রয়াসে এখন শানসি স্বাদের ডিশ নতুন করে উন্নত হয়েছে। অতীতকালে কেবল নুডলসসহ কয়েকটি ডিশ শানসির স্বাদ হিসেবে সুপরিচিত ছিল। তবে, এখন মাছ ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন কাঁচামাল দিয়ে তৈরি শানসি স্বাদের খাবার ক্রেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়।

কোভিড মহামারীর সময় শিক্ষক ওয়াংয়ের শরীরে মোট ৪টি বড় অস্ত্রপচার করা হয়। সেই সময় তাঁর শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে, একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি কম্পিউটারের সামনে বসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরুর করেন। শিক্ষক ওয়াং মনে করেন, পাচক বা শেফ যেন শিল্পীর মতো, নিজের দক্ষতা বাড়াতে পরিশ্রম করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এমন চেতনা তৈরিতে চেষ্টা করেন। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)