দেহঘড়ি পর্ব-০৩৭
2023-09-24 16:33:44

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

জেনে নিন হামের টিসিএম চিকিৎসা

হাম একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও তীব্র ভাইরাসঘটিত রোগ। রুবিলা নামেও এটি পরিচিত। মর্বিলিভাইরাসের অন্তর্গত একটি ভাইরাসের কারণে রোগটি হয়ে থাকে। ভাইরাসটির পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নাম মিজল্স মর্বিলিভাইরাস। এ ভাইরাসটি প্রথমে শ্বাসনালিতে সংক্রমণ ঘটায়, তারপর রক্তের মাধ্যমে দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির ২৪টি ধরন আবিস্কৃত হয়েছে, তবে বর্তমানে মাত্র ৬টি ধরন দেখা যায়। মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর হাম হয় না।

হামের লক্ষণ: হাম হলে প্রথমে জ্বর হয় এবং শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে বা হালকা ব্যথা লাগে। প্রথম এক-দুই দিন তীব্র জ্বরও হতে পারে; চোখ-মুখ ফুলে উঠতে পারে; চোখ লাল হয়ে যেতে পারে; চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে; নাক দিয়ে পানি ঝরতে পারে এবং হাঁচি হতে পারে। এ রোগ হলে শরীরে র‌্যাশ বা ছোট ছোট লালচে গুটি বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা সাধারণত দ্রুতই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

হাম সাধারণত শিশুদের হয়। এ রোগ হলে শিশুরা কিছুই খেতে চায় না এবং ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে। পূর্ণবয়স্কদেরও হাম হতে পারে। হামের প্রতিষেধক হিসেবে ‘এমএমআর’ টিকা দেওয়া হয়। এ টিকা দেওয়া না থাকলে হাম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত একবার হাম হলে দ্বিতীয়বার আর এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা তত্ত্ব বা টিসিএমে মনে করা হয়, হাম, মাম্পস বা চিকেন পক্স ভ্রূণের বিষের কারণে হয়, যা গর্ভধারণের সময় শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কিংবা গর্ভাবস্থায় বিকশিত হয়। এই বিষাক্ত পদার্থগুলো সুপ্ত থাকে যতক্ষণ না শিশুটি একটি বাহ্যিক রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাহ্যিক রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার পর বিষাক্ত পদার্থগুলো শরীরের উপরিভাগে প্রকাশিত হয় এবং ফুসকুড়ি বা ফোস্কা দেখা দেয়। বিষাক্ত পদার্থগুলোর কারণে শরীরের ‘ইয়াং’ বা তাপশক্তি বেড়ে যায়।

টিসিএমের সাহায্যে হামের সম্পূর্ণ নিরাময় এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোগ গড়ে তোলার জন্য এই ফুসকুড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর প্রকাশ দ্রুত করার জন্য নির্দিষ্ট ভেষজ ও ভেষজ ফর্মুলা রয়েছে। ফুসকুড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়ার পর যখন টিসিএমের মাধ্যমে সেগুলো দূর করা হয়, তখন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে তার শরীরে এই টক্সিন আর থাকে না।

হামের টিসিএম চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে শরীর থেকে তাপ ও বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়া এবং এর মধ্য দিয়ে শরীর শীতল করা। তাই, ত্বকের ফুসকুড়িগুলো দূর করার জন্য অতি-শীতল বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভেষজ ফর্মুলা প্রয়োগ করা হয়। ত্বকের তাপ ও বিষাক্ত পদার্থ যাতে দ্রুত ফুসকুড়ি আকারে প্রকাশিত হয়, সেজন্য শুরুতে তীব্র-ঠাণ্ডা প্রকৃতির ওষুধ দেওয়া হয়। পরে মৃদু ঠাণ্ডা বৈশিষ্ট্যের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, ‘ইয়িন’ ঠান্ডাশক্তিকে পুষ্ট করার এবং অবশিষ্ট তাপ দূর করার জন্য। ফুসকুড়ির দ্রুত প্রকাশের জন্য ওষুধ প্রয়োগের সময় শরীরে তরল গ্রহণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।

হামের চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর ভেষজ ফর্মুলাগুলোর মধ্যে একটি হল শ্যং মা ক্য ক্যন থাং অর্থাৎ ছিমি ছিফুকা ও পুয়েরারিয়া ক্বাথ। এটি একটি ধ্রুপদী চীনা ভেষজ সূত্র যা ফুসকুড়ির দ্রুত প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে হামের উপসর্গভিত্তিক ভেষজ ফর্মুলা দেওয়া হয়। যেমন জ্বর ও গলাব্যথার জন্য প্রয়োগ করা হয় ইয়িন ছিয়াও সান বা লোসিসেরা ও ফোরচিথিয়া গুঁড়ো; কাঁশি থাকলে দেওয়া হয় ছিং ছি হুয়া থান থাং ছি।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

ক্যান্সারের এ-টু-জেড চিকিৎসা সেইন্ট স্ট্যামফোর্ড হাসপাতালে

‘সেইন্ট স্ট্যামফোর্ড মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল কুয়াচৌ’ হলো চীনের শীর্ষস্থানীয় বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালগুলোর একটি। কুয়াংতুং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংচৌয়ে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেসরকারি খাতের এ হাসপাতালটি। সিঙ্গাপুর পেরিনিয়াল রিয়েল এস্টেট হোল্ডিংস লিমিটেড এবং চায়না বোয়াই মেডিকেল গ্রুপ এটি স্থাপন করে, যৌথ উদ্যোগের আওতায়। সর্বাধুনিক ‘ন্যূনতম আক্রমণাত্মক’ ক্যান্সার চিকিৎসা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এ হাসপাতালে রয়েছে বিভিন্ন চিকিৎসাবিভাগের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চ পেশাদার মেডিকেল টিম।

সেইন্ট স্ট্যামফোর্ড মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল কুয়াংচৌ ২০১৪ সালে জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনালের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতির অর্থ হলো হাসপাতালটি চিকিৎসা সেবা এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে এবং কঠোর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মূল্যায়নে পাশ করেছে।

হাসপাতালটি আমেরিকান লার্জ-স্কেল ফ্ল্যাট-প্যানেল ডিজিটাল সাবট্রাশন এনজিওগ্রাফি, জিই ১২৮-স্লাইস স্পাইরাল সিটি, ডিজিটাল ম্যামোগ্রাফি সিস্টেম, তোশিবা ডিজিটাল রেডিওগ্রাফি, জাপানি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অ্যানালাইজার, জার্মান কালার ডপলার, ল্যাপারোস্কোপি ও হিস্টেরোস্কোপি, জার্মান ড্র্যাগার আর্গন-হেলিসিয়াম নাইফ, ন্যানো-নাইফ, অলিম্পাস ফাইবার ব্রঙ্কোস্কোপ, মোরেস্টেপ এন্ডোজেনাস ফিল্ড থার্মাল থেরাপি সিস্টেম এবং জার্মান নেউরেরোসকোপির মতো শতাধিক বড় আকারের চিকিৎসা সরঞ্জাম স্থাপন করেছে।

প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা দেওয়া হয় এই হাসপাতালে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, কোলোন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, সার্ভিকাল ক্যান্সার, স্টমাক ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার, অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার, খাদ্যনালী ক্যান্সার, ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সার, অ্যাড্রিনাল ক্যান্সার, টেস্টিকুলার ক্যান্সার, মলদ্বারে ক্যান্সার,  কিডনি ক্যান্সার, জিহ্বা ক্যান্সার, পেনাইল ক্যান্সার, ভ্যাজাইনাল ক্যান্সার, থাইরয়েড ক্যান্সার,  ত্বকের ক্যান্সার, পিত্তনালীর ক্যান্সার, গলব্লাডার ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, চোখের ক্যান্সার, মূত্রাশয় ক্যান্সার,  হাড়ের ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্যান্সার ইত্যাদি।

সেন্ট স্ট্যামফোর্ড মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল কুয়াংচৌ নির্মিত হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে। এখানে কর্মরত রয়েছে ৪ শতাধিক কর্মচারী।

চীনের পাশাপাশি সেইন্ট স্ট্যামফোর্ড মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতালের শাখা রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ায়। এ হাসপাতালের গবেষণা ও চিকিৎসা সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন দেশের খ্যাতমানা ২০টিরও বেশি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

 

#ভেষজের গুণ

গুণের শেষ নেই মেথির

মেথি ঔষধি গুণে ভরা একটি ভেষজ। ইউনানী, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এটা। মেথিকে পথ্য, মসলা, খাবার - তিনটাই বলা চলে। মেথির স্বাদ তিতা ধরনের। এতে রয়েছে রক্তে চিনির মাত্রা কমানোর বিস্ময়কর শক্তি। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে কিংবা এক গ্লাস পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি পান করলে শরীরের রোগ-জীবাণু দূর হয়, বিশেষত কৃমি মরে এবং রক্তের চিনির মাত্রা কমে।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মেথি শ্রেষ্ঠ পথ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত মেথি খান, তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা কমে। নিয়মিত মেথি খেলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রাও কমে।

গরমে ত্বকে যে ঘা, ফোড়া ও গরমজনিত ত্বকের অসুখ হয়, সেগুলো দূর করে মেথি। বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এ ভেষজ। দীর্ঘদিন ধরে যাদের হজমের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য মেথি প্রাকৃতিক আশীর্বাদস্বরূপ। মেথিতে থাকা বায়োএকটিভ উপাদান যেমন স্যাপোনিনস, মিউসিলেজ ইত্যাদি ছাড়াও এলকালয়েডস যৌগ রয়েছে, যা খাবার ভালোভাবে ভেঙ্গে যেতে সহায়তা করে। মেথি থেকে ষ্টেরয়েডের উপাদান তৈরি হয়।

ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, নেপাল ইত্যাদি দেশে ব্যবহার করা হয় মেথি। মশলা হিসাবেও মেথির প্রচুর ব্যবহার হয়। এটি পাঁচ ফোড়নের অন্যতম উপাদান। এর পাতা শাক হিসাবেও খাওয়া হয়।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।