১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর চীন সফর করেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরর জন্য চীনকে বেছে নেন তিনি। বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে ফলপ্রসু বৈঠক করেন হুন। প্রেসিডেন্ট সি চীন-কম্বোডিয়া সম্পর্ককে লৌহদৃঢ় বন্ধুত্ব হিসেবে অভিহিত করেন এবং দু’দেশের কৌশলগত যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর দু'দেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বেশ কিছু নথিতে স্বাক্ষর করে ।
চীন এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬৫তম বার্ষিকী এবং সেইসাথে চীন-কম্বোডিয়া বন্ধুত্ব বছর হিসেবে চিহ্নিত বছরটিতে হুন মানেতের এ সফরকে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুক্রবার বেইজিংয়ে মহাগণভবনে হুন মানেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন চীনের প্রেসিডেন্ট। এ সময় তিনি হুনের চীন সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত দায়িত্ব নেওয়ার পর তার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরের গন্তব্য হিসেবে চীনকে বেছে নিয়েছেন, যা নতুন কম্বোডিয়ান সরকার চীন-কম্বোডিয়া বন্ধুত্বকে সুসংহত ও উন্নয়নে যে গুরুত্ব দেয় তা সম্পূর্ণরূপে প্রদর্শন করে।
চীন এবং কম্বোডিয়া বন্ধুত্বকে লৌহদৃঢ় হিসেবে অভিহিত করে সি বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৬৫ বছরে উভয়পক্ষ সর্বদা উচ্চমাত্রায় পারস্পরিক আস্থা বজায় রেখেছে, একে অপরের সঙ্গে সম-আচরণ করেছে, জয়-জয় ফলাফল অর্জন করেছে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন স্বার্থ রক্ষায় একে অপরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে।
কম্বোডিয়াকে তার জাতীয় অবস্থার সাথে উপযোগী একটি উন্নয়ন পথ অন্বেষণে চীন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে জানিয়ে প্রেসিডেন্ট সি বলেন, কম্বোডিয়ার সাথে নিয়মিত কৌশলগত যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং শাসনের অভিজ্ঞতা বিনিময়কে গভীর করতে প্রস্তুত রয়েছে বেইজিং।
সি চীন-কম্বোডিয়া "ডায়মন্ড হেক্সাগন" সহযোগিতা কাঠামোকে সমৃদ্ধ করার জন্য, যৌথভাবে "শিল্প উন্নয়ন করিডোর" এবং ‘ফিশ এন্ড রাইস করিডোর’ নির্মাণ এবং প্রাসঙ্গিক মূল সহযোগিতা প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য উভয় পক্ষকে আহ্বান জানান।
সি বলেন, ‘চীন-কম্বোডিয়া বুন্ধুত্ব বর্ষ’উদযাপনের জন্য দুই পক্ষের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া উচিত এবং যুব, শিক্ষা, পর্যটন ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা উচিত যাতে চীন-কম্বোডিয়া বন্ধুত্ব দুই দেশের জনগণের জন্য আরও সুবিধা বয়ে আনে।
হুন মানেত কম্বোডিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য চীনের দীর্ঘমেয়াদী শক্তিশালী সমর্থন এবং সহায়তার প্রশংসা করেন এবং দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্য হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে এবং আরও উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক বলে জানান।
‘ডায়মন্ড হেক্সাগন’ সহযোগিতা কাঠামোর অধীনে জ্বালানি, কৃষি, অবকাঠামো নির্মাণ, বিনিয়োগ এবং মানবিক বিষয়ে চীনের সাথে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিত করতে কম্বোডিয়ার গভীর আগ্রহের কথা জানান হুন।
একইদিন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন হুন মানেত। এ সময় চীন কম্বোডিয়ার সাথে দুই দেশের নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্য বাস্তবায়নে এবং চীন-কম্বোডিয়া অভিন্ন ভবিষ্যতের সম্প্রদায় গঠনে কাজ করতে বেইজিং প্রস্তুত বলে জানান লি।
দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে শিল্প, কৃষি অবকাঠামো, ডিজিটাল অর্থনীতি, সবুজ উন্নয়ন, পরিদর্শন ও কোয়ারেন্টাইন এবং উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নথি স্বাক্ষরিত হয়।
‘ডায়মন্ড হেক্সাগন’ সহযোগিতার কাঠামোটির বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট সি এবং তৎকালীন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন মতৈক্যে পৌঁছান। এর আওতায় ছয়টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র রয়েছে, যেমন রাজনীতি, উৎপাদন ক্ষমতা, কৃষি, জ্বালানি, নিরাপত্তা এবং জনগণের মধ্যে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়।
প্রেসিডেন্ট সি’র গুরুত্ব দেওয়া শিল্প উন্নয়ন করিডোর এবং ফিশ অ্যান্ড রাইস করিডোর কার্যকরের বিষয়টি হুন মানেতের বেইজিং সফরের পর গতি পাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কম্বোডিয়ার রয়্যাল একাডেমির থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ইনস্টিটিউট অফ কম্বোডিয়ার মহাপরিচালক কিন ফেয়া মনে করেন, শিল্প উন্নয়ন করিডোরের লক্ষ্য হল উপকূলীয় সিহানুকভিলেকে একটি মডেল বহুমুখী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে উন্নয়নে সহায়তা করা।
বর্তমান সিহানুকভিলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দুই দেশের মধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। এখন পর্যন্ত ১৭০টিরও বেশি কোম্পানিকে এখানে এসেছে এবং স্থানীয়দের জন্য হাজার হাজার চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে ।
টনলে স্যাপ লেক এলাকার কাছে আধুনিক পরিবেশগত কৃষির বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ‘ফিশ অ্যান্ড রাইস’ করিডোরটি প্রতিষ্ঠিত হবে।
এই দুটি করিডোর শ্রমিক ও কৃষকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কম্বোডিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাসে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন কিন ফেয়া।
প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে কম্বোডিয়ার রয়্যাল একাডেমির নীতি বিশ্লেষক সেউন স্যাম বলেন, এটি বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে, সেইসাথে কম্বোডিয়ার জন্য চীনের নতুন সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।