দেহঘড়ি পর্ব-০৩৬
2023-09-17 16:47:17



‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’ এবং চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

সোরায়াসিস উপশমে অতুলনীয় টিসিএম

সোরায়াসিস হলো এমন এক ধরনের চর্মরোগ যা সাধারণত হাঁটু, কনুই, ধড় ও মাথার ত্বকে চুলকানি এবং আঁশযুক্ত দাগসহ ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে। সোরায়াসিস একটি ব্যাপকবিস্তৃত দীর্ঘস্থায়ী রোগ যার কোনো নিরাময় নেই। তবে চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা (টিসিএম) সোরায়াসিস উপশমে সাহায্য করতে পারে।

সোরায়াসিস একটি অটোইমিউন শারীরিক সমস্যা। অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিভ্রাটের কারণে এটি সৃষ্টি হয়৷ সোরায়াসিস হলে শরীরের আক্রান্ত অংশে অনেক বেশি ত্বক-কোষ তৈরি হয়, যার ফলে ত্বকে পুরু আঁশ সৃষ্টি হয়, যা ‘প্ল্যাকস’ বা ফুসকুড়ি নামে পরিচিত।

ত্বকের ফুসকুড়ি ও অন্যান্য সমস্যা যেমন একজিমা, ডার্মাটাইটিস ও লুপাসের মতো রোগের মতোই সোরায়াসিসের লক্ষণ মাঝে মাঝে তীব্র হয়ে ওঠে। খুব প্রদাহের কারণেও এর তীব্রতা বাড়তে পারে। এছাড়া এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সি’র মতো ভাইরাল সংক্রমণ কিংবা ক্যান্ডিডা বা ইস্টের মতো ছত্রাকের সংক্রমণও সোরায়াসিস জাগিয়ে তুলতে পারে৷

বিশ্বে বহু মানুষ এ রোগে ভোগে। সোরায়াসিসের ফুসকুড়ি তীব্র চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। কখনও কখনও এটা এতটাই তীব্র হতে পারে যে, আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজে মনোনিবেশ করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে৷

সোরায়াসিস কী কারণে হয়, তা এখনো নিরূপণ করতে পারেনি চিকিৎসা গবেষণা। তবে ধারণা করা হয়, এটি খানিকটা বংশগত কারণে এবং খানিকটা পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে।

সোরায়াসিস পাঁচ ধরনের হয় – প্লাক সোরায়াসিস, গুট্টেট সোরায়াসিস, পাস্টুলার সোরায়াসিস, ইনভার্স সোরায়াসিস এবং এরিথ্রোডার্মিক সোরায়াসিস। এগুলো মধ্যে সবচেয়ে কমন প্লাক সোরায়াসিস। একশ সোরায়াসিস রোগীর মধ্যে প্রায় ৮০ জনই এ ধরনের সোরায়াসিসে ভোগে।

প্ল্যাক সোরায়াসিস হলে আক্রান্ত স্থানে লাল বা গোলাপী রঙের পুরু আঁশ জন্মে, যার উপর একটি রূপালী আবরণ থাকে। এই আঁশে খুব চুলকাতে পারে। গুট্টেট সোরায়াসিস হলে ধড়, বাহু বা পায়ে ছোট লাল বা গোলাপী দাগ দেখা দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি প্লেকে পরিণত হতে পারে এবং স্ট্রেপ থ্রোটের মতো সংক্রমণ সৃ্ষ্টি করতে পারে।

পাস্টুলার সোরায়াসিস হলে পুঁজে ভরা ফুসকুড়ি হয়, যাতে তীব্র ব্যথা থাকে। এটা দ্রুত পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং জ্বর, মাথাব্যথা ও পেশী দুর্বলতার মতো অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এমন অবস্থা হলে চিকিৎসা নিতে হবে। ইনভার্স সোরায়াসিস এমন জায়গায় হয়, যেখানে ত্বকে ভাঁজ পড়ে। যেমন বগল, গোপনাঙ্গের চারপাশ ইত্যাদি।

ইতোমধ্যে কোনও ধরনের সোরায়াসিসে ভুগেছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে এরিথ্রোডার্মিক সোরায়াসিস হয়। এ ধরনের সোরায়াসিসে ত্বক খুব লাল হয়ে যায় এবং পুড়ে গেছে বলে মনে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব অসুস্থ বোধ করে এবং তাদের জ্বর হয় ও হৃদস্পন্দন বাড়ে। এমন সোরায়াসিস হলে অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

সোরায়াসিসের প্রচলিত চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে ত্বকের কোষের অতিরিক্ত উৎপাদনকে ধীর করা এবং ব্যথা ও চুলকানি থেকে মুক্তি দেওয়া। তবে টিসিএমে এ রোগের মূল কারণ দূর করার ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়। টিসিএম অনেক ধরনের ত্বকের রোগ ও অটোইমিউন সমস্যা উপশমে সাহায্য করতে পারে। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনে করা হয়, তাপ, বাতাস, ক্লেদ, শুষ্কতা ইত্যাদির মতো মৌলিক কারণগুলোই প্যাথোজেন হিসাবে কাজ করে এবং সেগুলো অতিরিক্ত হলে বা ঘাটতি দেখা দিলে তা শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

টিসিএম তত্ত্ব অনুসারে, সোরায়াসিস অত্যধিক তাপ ও শুষ্কতার প্যাথোজেনিক ফ্যাক্টরগুলোর সাথে সম্পর্কিত। একটি রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান হিসাবে তাপ ত্বকে লালভাব ও চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে বাতাস রক্তের শুষ্কতা সৃষ্টি করতে পারে। এই দুটির সংমিশ্রণে রক্তে স্থবিরতা তৈরি হয় এবং তা থেকে সোরায়াসিস সৃষ্টি হতে পারে।

সোরিয়াসিসের ভেষজ ওষুধ ও আকুপাংচার চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে শরীরে তাপ দূর করা, রক্ত শীতল করা এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করা। পাশাপাশি প্রদাহ কমাতে এবং শুষ্কতা ও চুলকানি প্রশমিত করতে সহায়তা করে ভেষজ।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

১৩৫ বছরের পুরনো ইয়ি চিশান হাসপাতাল

ইয়ি চিশান হাসপাতাল চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশের উহু শহরে অবস্থিত একটি জেনারেল হাসপাতাল। ওয়ান্নান মেডিকেল কলেজের প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল নামেও পরিচিত এটি। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ১৩৫ বছর ধরে অসাধারণ চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে চীনের সর্বোচ্চ স্তরের হাসপাতালগুলোর প্রথম ব্যাচের এই চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানটি। ‘একটি জাতীয় শিশু-বান্ধব হাসপাতাল’, ‘জনগণের আস্থার শত শীর্ষ হাসপাতালের একটি’, ‘চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতি প্রদর্শনকারী একটি জাতীয় হাসপাতাল’, ‘একটি জাতীয় মানবিক হাসপাতাল’ এবং আনহুই প্রদেশের ‘একটি সভ্য প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে এই হাসপাতালটি। চিকিৎসা, চিকিৎসাশিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, রোগ প্রতিরোধ ও পুনর্বাসন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে আনহুই প্রদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে ইয়ি চিশান হাসপাতাল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেকবার নাম বদল হয়েছে এটির। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এর নাম ছিল উহু জেনারেল হাসপাতাল।

৩ হাজার ১৪৭ শয্যার হাসপাতালটি ২৯৭ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে রয়েছে ৩০টি কার্যকরী বিভাগ, ৬৭টি ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ এবং ৩৬টি শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ রয়েছে। এসেনিসিয়াল সায়েন্স ইন্ডিকেটর বা ইএসআই গ্লোবাল র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১ শতাংশ হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি ইয়ি চিশান হাসপাতাল।

সুদীর্ঘ কার্যক্রম পরিচালনাকালে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত চীনা চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই হাসপাতালে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শান খ্যফেই, ছান ছুইচ্যন, উয়ু শাওছিং, লিউ রুইহেং এবং ইয়িন ইউচাং। এছাড়া এ হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছেন অসংখ্য খ্যাতিমান চিকিৎসক ও শিক্ষক, যাদের মধ্যে আছেন ‘মাস্টার অব ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন’ এবং চাইনিজ বিজ্ঞান একাডেমির চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রথম সদস্য অধ্যাপক লি চিরেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্কিস্টোসোমিয়াসিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রাক্তন সদস্য অধ্যাপক চাই ছিংচুন, চীনের আধুনিক নিউরোসাইকিয়াট্রির প্রতিষ্ঠাতা লিউ ইয়ি ত্য, বিখ্যাত ভেষজবিদ অধ্যাপক শাং চিচুন, এবং ফার্মাকোলজির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সুন রুই ইউয়ান।

হাসপাতালে কর্মরত মোট ৩ হাজার ৪৫০ জন চিকিৎসাকর্মী, যাদের মধ্যে ৫৫৫ জন জ্যেষ্ঠ পেশাদার খেতাবপ্রাপ্ত, ১৭৫ জন ডক্টরেটধারী, ৭৬২ জন স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, ১৫ জন আনহুই প্রদেশের ‘বিখ্যাত চিয়াংহুয়াই ডাক্তার’ এবং ৯ জন প্রাদেশিক পর্যায়ের একাডেমিক নেতা।

একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল হিসাবে এখানে রয়েছে স্পাইরাল টমোগ্রাফি সিস্টেম, পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি এবং ডুয়াল-সোর্স সিটির মতো উন্নত ডায়াগনস্টিক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম, এক্সট্রাকর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন প্রযুক্তি এবং ট্রান্সক্যাথেটার অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপনের সুবিধা। শল্যচিকিৎসা ক্ষেত্রে ইয়ি চিশান হাসপাতাল অসাধারণ আস্থা অর্জন করেছে সাধারণ মানুষের। যেসব শল্যচিকিৎসা এখানে দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার ও সেরিব্রোভাসকুলার ইন্টারভেনশনাল সার্জারি, মস্তিষ্কের টিউমারের ত্রিমাত্রিক ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি, কার্ডিওপালমোনারি বাইপাস ও বিটিং হার্ট করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি, এবং থোরাকোঅ্যাবডোমিনাল ও পেলভিক সার্জারি। স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন ও রক্ত পরিশোধনে এটি চীনের একটি শীর্ষ পর্যায়ের হাসপাতাল।

ওয়ান্নান মেডিকেল কলেজে সরাসরি অধিভুক্ত একটি হাসপাতাল হিসাবে, এখানে শিক্ষাদান করা হয় ক্লিনিকাল মেডিসিনে একটি প্রথম-স্তরের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের এবং ক্লিনিকাল মেডিসিন ও স্টোমাটোলজিতে পেশাদার স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসাপেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এখানে।

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।